ট্রেন ধীরে ধীরে শিয়ালদহ স্টেশনে ঢুকতে শুরু করতেই একটা ভয়ানক ঠেলাঠেলি শুরু হলো।কোনক্রমে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে জানালার ধারে একটা সিটে বসলাম, ২০ বছর বয়স তখন, বিংশ শতাব্দীর শেষ কটাদিন বাকি, ছোটাছুটি ভালোই পারি। একজন কুলিকে ফিট করেছিলাম একটা বার্থ (লাগেজ রাখার জায়গা) ধরার জন্য রাতে ঘুমনোর জন্য, তা সে হিন্দুস্থানি কুলি সেটা গামছা দিয়ে ধরেও ছিলেন হঠাৎ আট দশজন মাঝ বয়েসি রাজবংশী গ্রামের মহিলা একগাদা বস্তা মাথায় চাপিয়ে ট্রেনে তুলে সব বার্থ সিট দখল করে নিলেন। কুলি কাকু অনেক চেঁচামেচি করলেও অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন। অগত্যা বুঝে গেলাম তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেসে আগামী ১৬ ঘন্টা আমাকে ওই জানালার ধারে সিঁটিয়ে বসে কাটাতে হবে।
বস্তায় কি আছে কে জানে, শুকনো লংকা আছে কোনটাতে নিশ্চয়ই কারণ ঝাঁঝে চোখ জ্বলে গেল। সেই বস্তাবাহী মাসিরা মলিন কাপড়ে ঘাম মুছে ততক্ষণে বস্তার ফাঁকে, সিটের কোনায়, মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছেন। এমন সময় এক পুলিশ কনস্টেবলের আবির্ভাব হল। বিস্তর দরকষাকষি হল, প্রথমে বাবা বাছা তারপর চেঁচামেচি, ঝগড়া করে রফা হলো। মাসিরা বীর বিক্রমে পুলিশকে ম্যানেজ করলেন।
আমি মনে মনে ভাবছি কি দুর্ভোগ আছে কপালে কে জানে, দুদিনের হঠাৎ পাওয়া ছুটি, মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সবাই বাড়ি গেল তাই আর সামলাতে পারলাম না, কিন্তু কাউকেই তো আর আমার মতো উত্তর বঙ্গ যেতে হয় না।
ট্রেন গড়াচ্ছে, মাসিরা চিঁড়ে মুড়ির প্যাকেট খুলে খাওয়া শুরু করলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “কি রে ভাত খাবি না? যাবি কোথায়? ”
আমি মনে মনে ভাবছি এই অত্যাচারের পর আবার জিজ্ঞেস করছে দেখো! বিরক্তি চেপে বললাম “জলপাইগুড়ি। আমি খেয়ে এসেছি। ”
“ও আমরা রানিনগর যাবো।” জলপাইগুড়ির আগের স্টেশন, হলো তার মানে। এদিকে জল শেষ নবদ্বীপ আসছে, জল ভরতে হবে, ঊঠলে আবার জায়গা দখল না হয়ে যায়। খালি বোতল হাতে ভাবছি, একজন মাসি বলল “জল ভরবি? যা নিয়ে আয় বাপ, নব্দ্বীপের জল মিষ্টি।”
“জায়গাটা দেকবে একটু”
“আমরা থাকতে কেউ জায়গা নিতে পারবে না রে” মাসিদের মুখে গর্বের হাসি।
গ্রীষ্মের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, সন্ধ্যা নামে, ট্রেনের জানালা দিয়ে আসা হাওয়া তাপমাত্রা কমিয়ে শরীর জুড়িয়ে দেয়, তার সাথে প্রাথমিক বিরক্তি কেটে সহযাত্রিনীদের সাথে ভাব জমে, এঁনারা কলকাতা থেকে মাসে একবার দুবার মাল নিয়ে যান, শুকনো মশলা, বড়বাজারের কাপড় এইসব। নিয়ে মহাজনের কাছে বিক্রি করেন, সংসার চলে। কারো স্বামী মারা গেছেন, কারো মাতাল কিছু করে না, কারো স্বামী ছেড়ে চলে গেছে…। এভাবেই এঁরা ছেলে মেয়ে মানুষ করেন। ট্রেনে রেগুলার যাতায়াত করে আঁটঘাট সব জানা, কি করে পুলিশকে ম্যানেজ করতে হয়, কি করে স্টেশনে গাড়ি ঢোকার আগেই মাল নামিয়ে ফেলতে হয়…. এইসব জানলাম।
রাত হলে এঁরা সব বস্তা এদিক ওদিক করে মেঝেতে, এমনকি সিটের নিচেও শোওয়ার ব্যাবস্থা করে নিলেন, আমি বসে আছি, ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে, মাসিরা বললেন “কিরে বার্থ নিস নাই? কুলিকে দিয়ে নিবি তো একটা, ঘুমাবি কোথায়?”
আমি মনে মনে বললাম নিইনি আবার, তোমরা তো দখল করে নিলে। মুখে কিছু বললাম না, শুকনো হাসি দেখে তাঁরা নিজেরাই বস্তার ওপর বস্তা চাপিয়ে, ঠেলেঠুলে সিটে একটু জায়গা করে দিলেন। গুটিশুটি মেরে শোওয়া গেল।
“নে এবার ঘুমা, রানিনগরে ডাইকে দিব”
সারাদিনের ক্লান্তি, চোখ জড়িয়ে এল। রানিনগরে ঠেলেঠেলি করে মাসিরা তুলে দিলেন, গাড়ি থামার আগেই বস্তাগুলো লাইনে ফেলে দিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে গেলেন, টিকিট যে কারোর নেই। গোটা কুপটা এখন ফাঁকা, কত জায়গা। পূব দিক সবে লাল লাল হচ্ছে, আবছা অন্ধকারে ওঁরা মিলিয়ে গেলেন, কাররই নাম জানা হয়নি সেবার।
গতকাল শুনলাম আন্তর্জাতিক নারী দিবস ছিল, না না “শ্রমজীবী” নারী দিবস ছিল। অনেকেই দেখলাম ফুল চকলেট গিফট পেয়েছেন। নতুন শতাব্দীর বছর কুড়ি পেরোল, এই মাসিরা কি কিছু পেলেন? কে জানে?
৯ই এপ্রিল, ২০২১