দ্বিতীয় পর্ব—হল্যান্ডের ক্ষুধার্ত শীত, ১৯৪৪
১৯৪৪ সাল, ৬ জুন। ডি-ডে। স্থলে জলে অন্তরীক্ষে আক্রমণ চালিয়ে ফ্রান্সের নরম্যান্ডি উপকূলের দখল নিল মিত্রবাহিনী। আর তার সাথেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে গেল। তখন মুসোলিনি ক্ষমতাচ্যুত, ইতালি মিত্রবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। হিটলারের দিন গোনা শুরু হল। কিন্তু তখনও ফ্রান্স, বেলজিয়াম আর হল্যান্ড (নেদারল্যান্ড) হিটলারের দখলে।
সেপ্টেম্বর ১৯৪৪। প্রায় সমগ্র হল্যান্ড জুড়ে শুরু হল রেল শ্রমিক ধর্মঘট—উদ্দেশ্য বুকের ওপর চেপে বসা নাজি পুতুল সরকারের কাজে যতটা সম্ভব বাধা দেওয়া। হিটলারের জার্মান সেনা আর হল্যান্ডের পুতুল নাজি সরকারের সেনার সম্মিলিত বাহিনীর রসদ যোগানোর কাজে বাধা পড়ল। রেললাইন জায়গায় জায়গায় তুলে ফেলল লুকিয়ে থাকা বিদ্রোহীর দল, ছিঁড়ে ফেলল টেলিগ্রাফ লাইন। একদিক থেকে মিত্রবাহিনী নিশ্চিত গতিতে এগিয়ে আসছে হল্যান্ড সীমান্তের দিকে, অন্যদিকে দেশের মধ্যে তাদের পক্ষে লড়ছে ‘দেশদ্রোহী’র দল—নাজিরা ক্রোধে উন্মাদ হয়ে গেল। তারা হল্যান্ডের মানুষের খাবার প্রায় বন্ধ করে দিল। অবশ্য এমনিতেও তখন জার্মান বাহিনীর রসদ নিয়ে টানাটানি ছিল। (তথ্যসূত্র ১)
হল্যান্ডের কুখ্যাত ১৯৪৪-এর মন্বন্তর শুরু হল। দেশের সমৃদ্ধ পশ্চিমাঞ্চলে, এমনকি আর্মস্টারডাম শহরে, মাথাপিছু খাদ্য এতটাই কমল যে তা থেকে দিনে মাত্র ১০০০ ক্যালোরি শক্তিও পাওয়া যেত না। এমনকি অনেকের ৪০০ থেকে ৮০০ ক্যালোরির বেশি জুটত না। ওদেশের নারীদের এমনিতে দিনে ২০০০ ক্যালোরি প্রয়োজন। আর গর্ভাবস্থায় প্রয়োজন ২৫০০ থেকে ৩০০০ ক্যালোরি।
১৯৪৫ সালের মে মাসে সমগ্র হল্যান্ডকে নাজিদের হাত থেকে মুক্ত করা গেল। কুড়ি হাজার মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে মারা গেছেন। এর পাশাপাশি এই কথাটাও রাখা যাক, মিত্রবাহিনী তথা চার্চিলের বদান্যতায় এর একবছর আগে বাংলার মন্বন্তরে মারা গেছেন কুড়ি থেকে ত্রিশ লক্ষ মানুষ। তবে তাতে বিশ্বমানবতা তেমন ‘অশনি সংকেত’ দেখেনি। কিন্তু চার্চিল কর্তৃক কৃত্রিম খাদ্যভাবজনিত বাংলার মন্বন্তর নয়, আজকের আলোচনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হল্যান্ড নিয়ে। বা বলা ভাল, সেখানকার গর্ভবতী মায়েদের সন্তান নিয়ে, সেই সব সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কম ঘটেছে যেখানে একটি বিশাল অঞ্চলের সমস্ত গর্ভবতী মায়েরা নির্দিষ্ট তিন-চারমাস সময় ধরে অর্ধাহারে থেকেছেন। সেই সময়ের আগে তাঁরা ভালমন্দ খেয়েছেন, সেই সময়ের পরেও তাঁরা ভালই খাদ্য পেয়েছেন। বৈজ্ঞানিকরা বুঝেছিলেন এই শিশুগুলির ভবিষ্যৎ শারীরিক ও মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে মায়ের পেটের শিশুর পুষ্টির অভাবের ফলাফল নিয়ে অনেক কিছু জানা যেতে পারে। গর্ভবতী মায়েদের খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা এমনিতে সম্ভব নয়, নাজি-ফ্যাসিস্ত ছাড়া আর এমন পরীক্ষা দুনিয়াতে কোনও মানুষ করবেনও না। যদি বা করেন তবে ইউরোপ বা আমেরিকাতে অন্তত করবেন না, ভারতে কিংবা আফ্রিকায় করবেন, যেমনটি চার্চিল সাহেব করেছিলেন।
হল্যান্ডের নারীদের ওপর ‘গর্ভাবস্থায় সীমিত সময়ের জন্য অর্ধাহার’ পরীক্ষাতে একটা বৈজ্ঞানিক সুবিধা ছিল। রাষ্ট্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া অর্ধাহারের সময়টুকু বাদে বাকি সময়ে মায়েদের অন্যসময়ে পুষ্টি ভালই ছিল, তাদের সন্তানদের পুষ্টিও খারাপ ছিল না। ফলে গর্ভাবস্থার কোনও নির্দিষ্ট সময় জুড়ে অপুষ্টির প্রভাব কী কী হতে পারে, সেটা বোঝা সম্ভব ছিল।
‘ডাচ হাঙ্গার উইন্টার কোহর্ট’। ১৯৪৪-এর শীতে হল্যান্ডে ক্ষুধাতুর মায়েদের পেটে থাকা সমস্ত শিশু। বিজ্ঞানের ইতিহাস এদের মনে রাখবে। শুধুমাত্র ভ্রূণের পুষ্টি আর বিকাশের সম্পর্ক বোঝার জন্যই তাদের মনে রাখবে, এমন নয়। মনে রাখবে এইজন্যই যে, এই নিষ্ঠুর পরীক্ষা প্রমাণ করতে পেরেছে যে, গর্ভাবস্থায় অজাত শিশুর পুষ্টি তার জন্মগত বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। ‘ভ্রূণের অভিজ্ঞতা’ জীবনের চক্রব্যূহে প্রবেশের জন্য মানুষকে প্রস্তুত করে। কেমন করে?
‘হল্যান্ডের ক্ষুধার্ত শীতের নিরীক্ষাধীন দল’-এর ওপর গবেষণার সরল সারাৎসার হল এইরকম।
১) যে সব বাচ্চারা গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে নাজিদের চাপানো অনাহারের শিকার হয়েছিল তাদের চেহারা গড়পড়তায় ছোটখাটো হয়ে গেল। জন্মানোর পরে তারা পুষ্টিকর খাদ্য পেয়েছিল, তাতে তাদের চেহারার কাঠামোর উন্নতি হয়নি। এরা যখন মধ্যবয়সী তখন ইউরোপ অতিপুষ্টিতে ভুগছে, স্থূলত্বের রোগ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে ঘরে। কিন্তু এই শিশুরা পরবর্তীকালেও মোটা হয়নি।
২) যে সব শিশুরা মায়ের অপুষ্টির সময়ে গর্ভ-জীবনের মাঝপথে, তাদের জীবনে কিন্তু এই অপুষ্টি অন্যরকম প্রভাব ফেলেছিল। মায়েরে অপুষ্টির সময় এই শিশুদের ভ্রূণের বয়স ছিল তিন মাস থেকে ছয় মাস। পরবর্তীকালে এদের কিডনির নানা অসুখ দেখা দেয়।
৩) যে সমস্ত ভ্রূণের বয়স ছিল সবথেকে কম (সদ্য ভ্রূণ তৈরির সময় থেকে ভ্রূণের তিন মাস বয়স পর্যন্ত), তারা বড় হয়ে অধিকাংশই অতিরিক্ত মোটা হয়ে যায়, তাদের রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়, এবং হৃদযন্ত্রের রোগ (হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি) দেখা যায়। আরও পরে যখন এদের বয়স ৫৫ বছর বা তার বেশি, তখন এদের এক বড় অংশ মানসিক সমস্যায় পড়ে। (তথ্যসূত্র ২)
হল্যান্ডের শিশুরা গর্ভাবস্থায় অকস্মাৎ এক খাদ্য-সঙ্কটে পড়েছিল। মায়ের পেটে শিশুর খাদ্য আসে মায়ের রক্ত থেকে। ক্ষুদ্রতম ভ্রূণ, যারা তিন মাস বা তার কম সময় মায়ের গর্ভে এসেছে, তারা খাদ্য-সঙ্কটের মোকাবিলার জন্য একরকম পদ্ধতি নিয়েছে। তারা মায়ের রক্ত থেকে খাদ্যের শেষতম কণাটি সদ্ব্যবহার ও সঞ্চয় করার জন্য নিজেকে তৈরি করেছে। এভাবেই সে মায়ের পেটে পরিবেশের মোকাবিলা করেছে। এই শিশুরা খাদ্যের ব্যাপারে ‘কিপটেমির ‘জিন’-কে কার্যকর করেছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘Thifty’ জিন, অর্থাৎ ‘মিতব্যয়ী’ জিন। ‘মিতব্যয়ী’ জিন ভ্রূণাবস্থায় কাজ শুরু করেছে, আর জন্মানোর পরে খাদ্য যথেষ্ট থাকার পরেও শরীর সেই জিনকে অকেজো করতে পারেনি। ফলে পরিণত বয়সে এদের শরীরে চর্বির পাহাড় জমে গেছে, অথচ শরীর সেই চর্বি ভাঙ্গিয়ে শক্তি উৎপাদন করেনি। ঠিক যেমন হাড়-কিপটের ব্যাঙ্কে টাকার পাহাড় জমে গেলেও সে ছেঁড়া জামাটাই পড়ে।
কিন্তু ‘মিতব্যয়ী জিন’ এল কোথা থেকে? একই বাবা-মায়ের অন্যান্য সন্তান, যারা মায়ের পেটে খাদ্য-সঙ্কটে পড়েনি, তাদের শরীরে এই মিতব্যয়ী জিনের কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি কেন? আসলে আমরা যাকে ‘মিতব্যয়ী জিন’ বলছি, তাকে ক্রোমোজোমের সমস্ত জিন ঘেঁটেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ এই শিশুদের জিনগত গঠন বদলে যায়নি। তবে ভ্রূণাবস্থায় তাদের বেশ কিছু ‘জিন’ স্থায়ীভাবে অকেজো হয়ে যায়। একে বলে জিনের ‘সুইচিং অফ’। জিনের নিয়ন্ত্রণের বদলের ফলে এইরকম বদলকে বলে এপিজেনেটিক পরিবর্তন, বা জিনের ওপরের স্তরে বদল। তা জিনের গঠন না বদলিয়ে জিনসমূহের কাজকে বদলে দেয়। (তথ্যসূত্র ৩)
মায়ের পেটে ভ্রূণের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিন সুইচিং-এর তারতম্য হয়। তাই মায়েরা গর্ভাবস্থার ঠিক কোন সময়ে অকস্মাৎ খাদ্য-সঙ্কটে পড়েছিলেন, তার ওপর বাচ্চার স্থূলত্ব বা ডায়াবেটিসের প্রবণতা নির্ভর করে।
- মায়ের পেটে নিষেক থেকে প্রথম তিনমাসের বাচ্চারা জিন সুইচিং-এর মাধ্যমে শরীরের ভেতরকার খাদ্য ব্যবহারে ‘মিতব্যয়ী’ হয়েছে।
- কিন্তু গর্ভাবস্থার চার মাস থেকে ছয় মাসে শিশু মায়ের রক্তে খাদ্যের অভাব মোকাবিলা করেছে অন্য জিন সুইচিং-এর মাধ্যমে। তাদের কিডনির জল ধরে রাখার প্রবণতা বেড়ে গেছে, আর জন্মানোর পরে সেই প্রবণতা কিডনির রোগের জন্ম দিয়েছে।
- আবার গর্ভাবস্থায় সাত থেকে নয়মাসে মাস বয়সী শিশুদের অন্য জিন সুইচিং হয়েছে। ফলে তাদের শরীরের কাঠামো স্থায়ীভাবে ছোটখাটো হয়ে গেছে। (পাদটীকা ৪)
হল্যান্ডের এই মানুষদের শৈশব ও প্রাপ্তবয়সের রোগের বর্ণনা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কিন্তু এর সঙ্গে ল্যামার্ক বা তাঁর অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুক্রমিক চলনের সম্পর্ক কী? না, সরাসরি সম্পর্ক কিছু নেই। তবে কিনা, মানুষ বা যে কোনও প্রাণী তাদের জিন উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। যেসব জিন শরীরে আছে, তাদের সবাই সব সময়ে কাজ করে না। বিশেষ জিন কাজ করে বিশেষ পরিবেশে। আর পরিবেশের তেমন বদল ঘটলে জিন সুইচ অফ বা অন করার ফলে কোনও জিনের কাজ স্থায়ীভাবে বন্ধ হতে পারে। ডিএনএ অণুর ‘মেথিলেশন’ নামক রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বারা সাধারণত এই স্থায়ী পরিবর্তন ঘটে। আমরা এর পরে দেখব, তার প্রভাব বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে পরের প্রজন্মেও পৌঁছাতে পারে।
বিজ্ঞানী ভাইজম্যান অনেক ইঁদুরের লেজ কেটেছিলেন। কিন্তু ইঁদুরের কিছু অর্জিত বৈশিষ্ট্য যে পরের প্রজন্মে পৌঁছয়, সেটা বুঝতে আরেকটু জটিল পরীক্ষার দরকার ছিল।
পরের পর্বে সে প্রসঙ্গে আসব।
তথ্যসূত্র ও পাদটীকা
১) Marshal T. Canada and the Dutch Hunger Winter. The Canadian Encyclopaedia. https://www.thecanadianencyclopedia.ca/en/article/canada-and-the-dutch-hunger-winter#:~:text=)
২) Schulz LC. The Dutch Hunger Winter and the developmental origins of health and disease. Procedure National Academy of Science USA. 2010; 107(39): 16757–16758. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC2947916/)
৩) Alberts B, Johnson A, Lewis J, et al. Molecular Biology of the Cell. 4th edition. New York: Garland Science; 2002 https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK26872/
৪) এর পাশাপাশি একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে রাখা দরকার। আগস্ট ১৯৪২ থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ নাজি জার্মানির সেনারা স্তালিনগ্রাদ অবরোধ করে। সেখানকার মানুষের খাদ্যের অবস্থা হল্যান্ডের বা অ্যামস্টারডামের চাইতে বিশেষ ভাল ছিল না। কিন্তু সেখানে তখন যে গর্ভবতী মায়েরা ছিলেন তাদের বাচ্চারা পরবর্তীকালে এমন ডায়াবেটিস ইত্যাদির শিকার হয়েছে, এমন প্রমাণ নেই। এর দুটো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা আছে। প্রথম ব্যাখ্যা হল, স্তালিনগ্রাদের তথ্যসংগ্রহে খামতি ছিল। আর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হল, স্তালিনগ্রাদের মায়েদের পুষ্টি অ্যামস্টারডামের মায়েদের থেকে আগে থেকেই কম ছিল, আর স্তালিনগ্রাদে জার্মান অবরোধ শেষ হবার পরেও বহুদিন সেখানে খাদ্যের অভাব ছিল। সোভিয়েত দেশ তখনও হল্যান্ডের মত অত স্বচ্ছল হয়নি। জন্মের পরে স্তালিনগ্রাদের বাচ্চাদের এইরকম স্থূলত্ব বা ডায়াবেটিস ইত্যাদির প্রবণতা বাড়েনি। কারণ তারা ক্ষুধার রাজ্যের জন্য ভ্রূণাবস্থায় নিজেদের তৈরি করে ক্ষুধার রাজ্যেই জন্মেছিল, জন্মের পর হঠাৎ অতি-প্রাচুর্যের সমাজে অতি-আহারের মধ্যে পড়েনি। জন্মের আগের পরিবেশের সঙ্গে জন্মের পরের পরিবেশের সাযুজ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
চিত্রপরিচিতি
১) হল্যান্ডের ক্ষুধার্ত শীত—পথে মৃত্যুর ঢল (চিত্রঋণ নিউ ইয়র্ক টাইমস)
২) হল্যান্ডে ১৯৪৫-এর শুরুতে আকাশ থেকে মিত্রশক্তি খাদ্য ফেলা শুরু করে (চিত্রঋণ ডাচ ন্যাশনাল আরকাইভস)