জানো টাকোদা,
তোমার সাথে কত্তো কথা হয়েছে! একসাথে কাগজে পত্রে আর্টিকল লিখেছি। তোমাকে নিয়ে বই লিখেছি। কোরাস গেয়েছি। মিছিলে হেঁটেছি। তবু এতো বছরের সম্পর্কে তোমায় কখনো চিঠি লিখেছি বলে মনে পড়ে না। আর আজ প্রথম লিখতে বসে কী বিপত্তি দেখো। তোমার ঠিকানাটাই খুঁজে পাচ্ছি না! যাকগে এখন চিঠিটা তো লিখে ফেলি। তারপর না হয় ছেড়ে দেবো আকাশের ঠিকানায়। এই তো দেখলাম নিমতলা থেকে তুমি সেখানে মিশে গেলে। ও হ্যাঁ, খামে তোমার নামটা সুব্রত গোস্বামীই লিখেছি। শুধু প্রয়াত শব্দটা লিখতে পারিনি। প্লিজ কিছু মনে কোরো না।
মনে পড়ে চার তলা কুড়ির সেই দিনগুলোর কথা? সাতাশি সাল। মফস্বলের তেলচিট গা নিয়ে মেডিকেলে এলাম। ভয়ে সংকোচে ঘুরছি। তুমি পরম আদরে নিজের ঘরে তুলে নিলে। তারপর কলেজ চেনালে। মহানগর চেনালে। ভালো ডাক্তার হতে বললে। দরদী মানুষ হতে বললে। বললে তুমিও গ্রামে বড় হয়েছো। বোঝালে আমাদের গড়ে ওঠার গল্পগুলোয় কত মিল!
আস্তে আস্তে তুমি বব ডিলান শোনালে। পীট সিগার চেনালে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের গল্প পড়ালে। বিভিন্ন মেডিকেল ক্যাম্পে তোমার মধ্যে আমরা নরম্যান বেথুনকে খুঁজে পেলাম। ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায়ের আন্দোলনে তোমার মধ্যে চে গ্যেভারাকে খুঁজে পেলাম। এমনই ছিল তোমার ক্যারিশমা। এরপর জীবন বইতে থাকলো নিজের খাতে। এলো সব চড়াই উতরাই। নিলো বিভিন্ন বাঁক। তুমি থেকে গেলে ধ্রুবতারার মতো। আমার মতো আরও অসংখ্য সম-অসমবয়সীর “Go to” person হয়ে রয়ে গেলে তুমি।
তোমাকে নিয়ে বই লেখাটা ছিল একটা দৈনন্দিন লড়াই। প্রথম ক’দিন শিয়ালদা ESI হসপিটালে যেতাম। যেখানে রয়েছে তোমার নিজে হাতে গড়া পেইন ইন্সটিটিউট। রুমে ঝোলানো হিউম্যান স্কেলিটনটার দিকে তাকাতাম। আর কি যেন একটা মনে হতো। তারপর বাড়ি চলে আসতাম। তোমাকে নিয়ে যে একটা বই লিখতে চাই সেটাই বলে উঠতে পারতাম না। কঠিন পরিস্থিতিতে রোগী/আত্মীয়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তার অনেক ওয়ার্কশপ করেছি। কিন্তু প্রিয় বন্ধুকে বলে উঠতে পারছিলাম না যে তুমি তো আর আমাদের সাথে বেশীদিন থাকবে না তাই তোমাকে নিয়ে বই লিখতে চাইছি। প্রাথমিক এই আইস- ব্রেকিংটা ছিল বড্ড কঠিন।
একটা স্টেজে কথা শুরু হলো। তুমি নিজে আমকে Mitch Albom এর Tuesdays with Morrie বইটা পড়তে বললে। আমাদের ইনটারভিউগুলো শুরু হলো। দু তিনটে দিন পরেই দেখা গেল ওই রুমে সদাই এত মানুষের আনাগোনা (অবশ্যই প্রয়োজনীয়) যে সেখানে নিরিবিলি কথা বলা যাচ্ছে না। প্ল্যান পরিবর্তন করে আমরা চলে গেলাম Zoom meeting এ। সপ্তাহে প্রতি বুধবার সন্ধ্যে সাতটা থেকে ঘড়ি ধরে চল্লিশ মিনিট। একদিকে ফিজিওথেরাপিস্ট তোমার হাত পা নিয়ে টানা হেঁচড়া করছে। অন্যদিকে আমি আর অনুপ তোমায় কথা বলাতে চাইছি। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। কাজ চলতে থাকলো। মিটিং শেষে তুমি চলে যাবার পর আমার আর অনুপের মধ্যে থাকতো কিয়ৎ নীরবতা অথবা বোবা কান্না। যাইহোক সে সব মিটিংয়ের চাক্ষুষ ফল দাঁড়ালো এই “অবেদন”।
ভবিতব্য যা ছিল আজ ঘটলো। সারাদিন তোমার সাথে থাকলাম। একটিও কথা বললে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তোমার দিকে চেয়ে রইলাম। আচ্ছা, তুমি কি ম্যাজিক জানতে? একদিকে কলকাতায় মন্ত্রী সান্ত্রীরা অনবরত তোমার খোঁজ নিচ্ছেন। অন্যদিকে বাঁকুড়া বড়জোরা দাতব্য ক্লিনিকে রোগীরা তাদের প্রিয় ডাক্তারবাবু চলে যাওয়ায় স্মরণ সভা করছেন। ভিডিও তে দেখছি এক চাষীভাই গান গাইছেনঃ
“এ কটা দিন চালানো যে দায়
রুগে ভুগছে বউটা
সঙ্গে বেটা বিটিটা
আমার ওষুধ কেনার পয়সা ঘরে নাই
এ কটা দিন চালানো যে দায়..”
রিটার্নের আশা না করে, আদর্শে বুক বেঁধে, লক্ষ্যে অবিচল থাকলেই বোধহয় এই ভালোবাসা পাওয়া যায়। বলতে বটে তুমি এই কথাগুলো, কিন্তু শিখতে আর কতটুকু পেরেছি!
শেষ ক’টা মাস বড্ড কষ্ট পেলে তাই না টাকোদা। তুমি তো জানতে, মোটর নিউরন ডিজিজ রোগটাই এমন। শরীরের সব পেশীগুলো বিকল করে দেয়। শুধু বাদ রাখে চিন্তাশক্তি, দৃষ্টি আর শ্রবণ ক্ষমতা। অর্থাৎ তোমার অক্ষমতাগুলো সম্পর্কে তুমি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলে! রোগটা প্রথমে তোমার হাঁটাচলা কেড়ে নিলো। তখনো তুমি সৃষ্টিশীলতায় ভরপুর। ব্যথা উপশম নিয়ে বই লিখছো, সেমিনারে বক্তব্য রাখছো কখনো ক্রাচে ভর দিয়ে, কখনো হুইলচেয়ারে বসে। সর্বগ্রাসী রোগের তাতেও সাধ মিটলো না। একে একে বেঁচে থাকার সব উপকরণগুলো ছিনিয়ে নিলো। কথা বলা, খাওয়াদাওয়া, শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া এগুলোও যে কতো কঠিন কাজ হতে পারে তা শেষ ক’টা দিন তোমাকে দেখে বুঝেছি। ভালো হয়েছে তুমি আর এগুলোর তোয়াক্কা করছো না। নিজের মতো হাওয়ায় মিশে গেছো। এবার যার দরকার সে খুঁজে নিক তোমাকে।
সবাই বলছে যা হবার হয়ে গেছে। এবার এসব ভুলতে হবে। শুধু তোমার পজিটিভ সাইডগুলো মনে রাখতে হবে। কিন্তু তা কি অত সহজে সম্ভব বলো? তাছাড়া তোমাকে যে কি ভাবে মনে রাখবো সেটাই তো ভেবে পাচ্ছিনা। তোমার আদর্শবাদী চরিত্র? সার্বিক মূল্যবোধ? নিঃস্বার্থ পরোপকার? আপসহীন মনুষ্যত্ব? পেইন ক্লিনিক? না কি নির্মল রসবোধ? কোনটা আগে আর কোনটা পরে রাখবো বুঝে উঠতে পারছি না। যাকগে অত ভেবে কাজ নেই। বন্ধুত্বটুকু থাকলেই হলো।
ভালো থেকো। আর হ্যাঁ, তুমি থাকছো…