মিঠুর বিয়েতে গেছিলাম বহরমপুর। দুদিন চেম্বার বন্ধ ছিল। আজ তাই একটু বেশিই ভিড়। আমার সহকারী সঞ্জয়দা সামলাতে পারছে না। খানিকক্ষণ বাদে বাদেই রোগীদের সাথে ঝামেলা লাগছে। সঞ্জয়দা আগে এতো ঝগড়া ঝাটি করতো না। কিন্তু ইদানীং বিয়ে করার পর থেকেই সবসময় মেজাজটা তিরিক্ষে হয়ে থাকে।
আমারও বিয়ের পরে পরে প্রায় একই ব্যাপার হয়েছিল। তবে একসাথে দুজনে বছর দশেক কাটানোর পরে একে অপরকে বেশ সহ্য হয়ে এসেছে। আজকাল বরঞ্চ স্ত্রীকে অনেকক্ষণ না দেখলেই মনটা কেমন করে।
সঞ্জয়দার মেজাজ হারানোয় তাই আমি বিশেষ মাথা ঘামাই না। কারণ আমি জানি এই পর্ব সাময়িক। বনের পাখিকে খাঁচায় ঢোকালে প্রথম কয়েকদিন খুব ঝাপটা ঝাপটি করে। সঞ্জয়দা সেই ঝাপটা ঝাপটির ফেজে আছে। এর পর আবার শান্ত শিষ্ট হয়ে যাবে।
বাইরে কোলাহল বেশ জোরদার হয়েছে। প্রায় সকলেরই দাবী তাঁর রোগীর অবস্থা অত্যন্ত আশংকাজনক অথবা তিনি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এসেছেন তাড়াতাড়ি না গেলে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
হঠাৎ সব কোলাহল থেমে গেল। শুনলাম, সঞ্জয়দা রোগীর নাম ধরে ডাকছে, ‘রানু মণ্ডল, রা…নু… ম…ণ্ড…ল, রানু মণ্ডল কি নেই নাকি। রানু…উ…উ মণ্ড…ও…ল?’
একজন পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের তাম্বূল মুখশ্রীর তন্বী তরুণী সঞ্জয়দার দিকে কড়া দৃষ্টিপাত করে বলল, ‘এতো চিৎকার করার কি হ’ল, অ্যাঁ… নন সেন্স!’
সঞ্জয়দা বলল, ‘যাহ বাবা, চিৎকার করে না ডাকলে তো পরে বলবেন শুনতে পাইনি।’
‘তাই বলে আপনি রানু মণ্ডল বলে চিৎকার করবেন!’
‘খাতায় তো তাই লেখা আছে। এই দেখুন পরিষ্কার লেখা আছে… রানু মণ্ডল। আপনি রানি মুখার্জি লিখলে আমি তাই বলে চিৎকার করতাম।’
তরুণীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি হয়েছে?’
‘আর বলবেন না ডাক্তারবাবু। যবে থেকে ঐ রানু মণ্ডলের গান ভাইরাল হয়েছে, তবে থেকে আমার রাতের ঘুম উবে গেছে। সারাক্ষণ বুকের মধ্যে কাঁপে। খিদে নেই। বমি বমি পায়। হাত পা ঝিন ঝিন করে। আপনি আমাকে বাঁচান ডাক্তারবাবু।’
আমি কি করে বাঁচাবো? নিজেই “তেরি মেরি” আতঙ্কে ভুগছি। আমার ছোটো কন্যা কোথা থেকে শুনেছে কে জানে সারাক্ষণ “তেরি মেরি, তেরি মেরি, তেরি মেরি কাহানী” গেয়ে চলেছে।
একটি অ্যাংজিওলাইটিক ওষুধ লিখে বললাম, ‘এইটা হল টেম্পোরারি সমাধান, তবে স্থায়ী সমাধানের জন্য এখনই এফিডেভিট করে নাম পাল্টানোর দরকার নেই। কটা দিন অপেক্ষা করুন।’
মেয়েটি বিমর্ষ মুখে উঠে দাঁড়াল। বেচারা এতটাই মনকষ্টে ভুগছে যে আমাকে ভিজিট দিতেই ভুলে গেল। এখন আর চাকরি বাকরি কিছুই করিনা, এই ভিজিটটুকুই সম্বল। তবুও মেয়েটির মুখের অবস্থা দেখে চাইতে পারলাম না।
ওদিকে ঝগড়া ঝাটি বন্ধ করে রানু মণ্ডলকে নিয়ে আলোচনা চলছে। সঞ্জয়দা আবার ডাকতে শুরু করল, ‘অভদ্র… অভদ্র… অভদ্র। দাদা, আমি কিন্তু ইচ্ছে করে কাউকে অপমান করছি না। এই দেখুন তাই লেখা আছে।’
ভদ্রলোককে আমি চিনি। ওনার নাম অজয় ভদ্র। সি এস টি সি বাসের কন্ডাকটর। বললেন, ‘ঘাবড়িয়ো না সঞ্জয়দা। সারাদিন প্যাসেঞ্জারের খিস্তি খাই। খিস্তি খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে। আজ শরীর খারাপ বলে ছুটি নিয়েছিলাম। সারাদিনে কোনও গালি খাই নি। মনটা খারাপ লাগছিল। তাই ইচ্ছে করেই অ.ভদ্র লিখেছি।’
অজয় বাবু লোক বড় সুবিধের নন। হাঁপানিতে ভুগছেন। কিন্তু বিড়ি ছাড়বেন না। আমার খারাপ মেজাজ আরও খারাপ করে ইনি বিদায় নিলেন। তাও ভাগ্য ভালো ভিজিট দিয়েছেন।
ইতিমধ্যে ই সি জি তাপস এসে হাজির। তাকে দেখেই সঞ্জয়দা উৎসাহে চিৎকার শুরু করল, ‘ডাক্তারবাবু তাপস পাল এসে গেছে। তাপস পাল এসে গেছে।’
তাপস পাল সারাদিন ঘুরে ঘুরে ই সি জি করে। সন্ধ্যেয় আমার কাছে এসে রিপোর্ট করিয়ে নিয়ে যায়। ইদানীং তার মন মেজাজ ভালো নেই। একদিন বলেই ফেলল, ‘ডাক্তারবাবু, মহিলারা আমার নাম শুনলে আর ই সি জি করতে রাজি হচ্ছে না। এমনকি অনেকেই নাম শুনলে ঘরে ঢোকাতে চাইছে না। ভাবছে, যদি ছেলেপুলে সমেত ঘরে ঢুকি।’
তাপস তাই তার ই সি জি’র প্যাডে নাম পরিবর্তন করে শুধু তাপস হয়ে গেছে। ফেসবুক প্রোফাইল “তাপস-তাপস” করেছে। মহীপাল, বিগ্রহপালের পাল বংশের অতীত গরিমা নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই।
তাপস আসার পরেই রোগীদের মধ্যে লাইন নিয়ে ঝামেলা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। তাদের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু হল। আর রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে পারলে অধিকাংশ বাঙালীর সময়ের দিকে খেয়াল থাকে না।
একজনের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। অন্যদের থেকে গলার আওয়াজ অন্তত ত্রিশ ডেসিবেল বেশী। তিনি বলছেন, ‘বলুন তো, কোন রাজ্যে সি পি এম এর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ?’
একজন বলল, ‘পশ্চিমবঙ্গ?’
আরেকজন বলল, ‘জম্বু আর কাশ্মীর…’
‘ধুর, সে তো এখন কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল।’
‘তাহলে?’
ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, ‘সি পি এম এর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ত্রিপুরায়। বিপ্লব দেব মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তারা “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক” এই কথাটাও মনের থেকে বলতে পারছে না।’
আমি ভেতরে রোগী দেখতে দেখতে হাসলাম। এতো রোগ-ভোগের মধ্যেও বাঙালির সেন্স অফ হিউমার যথেষ্টই।
সামনে একজন শীর্ণ চেহারার মাঝ বয়সী মহিলা বসে আছেন। কলম বাগিয়ে বললাম, ‘নাম আর বয়স বলুন।’
মহিলা অত্যন্ত কুণ্ঠিত ভাবে বললেন, ‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, আমার নাম মমতা ব্যানার্জি।’
নাও… এবার সামলাও ঠেলা।
©c