শীত চলে গেছে প্রায়। অন্য বছরের তুলনায় খানিকটা আগেই। এই আগে, অসময়ে চলে যাওয়া এখন আর মোটেই ভালো লাগে না। না মানুষের, না শীতের। এতো যাই যাই কেন বাপু? এলি তো সেই ডিসেম্বরের শেষে! থাক না আর ক’টা দিন! সেই তো ফ্যানের হাওয়া খেতে খেতে বুক ছাড়িয়ে পেটের ভেতর জমবে গ্যাস। তারপর – কোনরকমে জোগাড় করা এক থালা ডিম ভাত অব্দি হজম হবে না! সবার গায়ে তখন ঘামের গন্ধ – পথে নেমে আর আলাদা করে চেনা যাবে না, কে করে এসেছে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর কে ঘেমে নেয়ে এসেছে মিথ্যা ভাষণ দিয়ে!
থাক না শীত! এতো কিসের তাড়াহুড়ো? যাবি কোথায়? আমার ঘরেই থাকতে পারিস একটা জীবনকাল!
তবু এখনো, বুকের গভীরে চলে যাওয়া প্রেমিকা কোথাও না কোথাও তো আছে ঠিক, তাকে শীত ভেবে আমি কম্বল টেনে ঘুমাতে চেষ্টা করি। টের পাই, কম্বলের নিচে জীবনের খানিকটা ওম বাকি আছে আজো!
আসলে আমার মায়া আছে। অতএব মায়ারানীও। আছে তাঁর বুক ভরা অভিমানও। তাঁকে ভালোবাসা নাম দিয়ে আমি জমে যেতে চাই ঘুমে, আমি জমে যেতে চাই উত্তাপেও। পশ্চিমের জানালার বাইরে কুয়াশায় ভিজে যায় চাঁদ। চাঁদের কলঙ্কও। অর্ধেক রাতের শেষে অর্ধেক মৃত্যু হলে যন্ত্রণাই পড়ে থাকে শুধু।
ভুলু আর কয়েকটি কুকুরের নিয়মিত চিৎকার – বোঝা দায়, কে কখন কার দলে। শুধু বোঝা যায়- অন্ধকারেও ওরা লড়ছে খুব। ডাস্টবিনে হয়তো বা সুস্বাদু হাড় পাওয়া গেছে কোন এক মুরগির। ওদেরও কি মানুষের মতো এতো খিদে পায়? হয়তো ওদের কোন কম্বল নেই। হয়তো ওদের কোন মায়ারানী নেই। শুধু খিদে আছে।
নির্ঘুম রাত কেটে যায় আমার … পাহাড়ের পাদদেশে আছি বহুকাল, তবু এখনো আমি ঘুমাতে শিখিনি ঠিক পাহাড়ের মত! শীত, ঘুম নিয়ে আসে না আমার জন্য। আমি ঝিমুনির মধ্যে যেন গন্ধ পাই – সূর্য ওঠে। কোথাও না কোথাও তো সূর্য ওঠে।
আমার গন্ধ পেলেই পোষ্য ভুলু দৌড়ে আসে দরজায়। ভুলুকে কয়েকটি মারি বিস্কুট খেতে দিয়ে আমিও বেরিয়ে পড়ি – খাবারের তালাশে। তারপর – আমার সে মায়ারানী ঘর জুড়ে জানালায়, দরজায়, দেয়ালে দেয়ালে যেন অপেক্ষায় থাকে দিনমান। তার ম্লান মুখ যেন ক্রমশঃ মায়ের মুখ হয়ে ওঠে অজান্তেই।
শীত, কম্বল আর মায়ারানী- এই লোভে আমিও আকাশ ছেড়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরি রোজ।
পাখি- আর কতকাল উড়বি এমন?
এখনো সময় আছে- ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধর।
বাইরের শীত চলে গেছে যদিও বা অসময়ে, খানিকটা শীত ধরে রাখ তোর কম্বলের নিচে।
বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম – আমাকে ডাক্তারি পেশা ছাড়তে হবে। না .! আর পারা যায় না। এ আমার জন্য নয়। যার জন্য ঘর আছে, ঘরের মায়া আছে, ঘর জুড়ে মায়ারানী আছে, শীত চলে গেছে তবু কম্বল আছে – এই বিশ্বাস আছে, এই ডাক্তারি তার জন্য নয়!
অথচ কোন বিকল্প কাজ জুটছে না আমার! কেউ আমাকে বলছে না – অমুক দিন অমুক জায়গায় গেলে এই রঙ মেখে নিও। ডাক্তারি ছাড়া আমার কোন দল নেই, কোন দলে থেকে কাজ করতে না পারার হতাশা নেই, ‘মানুষের জন্য কাজ’ করতে না পেরে আমি গিরগিটি হতে পারি না!
আমার ভালো লাগে না যেখানে সেখানে ডাক্তারি করতে। রাস্তাঘাটে, ফোনে কেউ রোগী নিয়ে কথা বললে, রোগীর কথা বললে চূড়ান্ত বিরক্ত হই। অথচ – এই সেদিন, সকাল বেলা রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে বসে ছিলাম। এক মহিলা, কি জানি কেন হঠাৎ এসে ধপাস করে বসে পড়লো আমার পাশে। বয়স কত? চল্লিশ বিয়াল্লিশ। পেছন পেছন এসে বসলো একজন পুরুষ। দু’জনের মধ্যে যে খানিকটা কথা কাটাকাটি হয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম। কেন কে জানে ?
কিন্ত হঠাৎ বসে পড়ায় যেটি ঘটলো, আমি প্রস্তুত ছিলাম না। নড়বড়ে বেঞ্চের দৌলতে চায়ের কাপের গরম চা পড়ে গেল আমার হাতে, জামা কাপড়ে। চায়ের দোকানদার তাড়াতাড়ি জল ঢাললো। মহিলা পুরুষ – দু’জনেই আফসোস করলো।
বললাম – আচ্ছা আচ্ছা। আপনার দোষ নয়। আসলে আমিই একটু আলগা করে ধরে ছিলাম চায়ের কাপ।
হাসলাম। আমার এই আলগা করে ধরার অভ্যেস আর গেল না! শীত শীত ভাবটাও কেটে গেল গরম চা পড়ে।
শুনলাম, বুঝলাম মহিলা তার স্বামীকে নিয়ে এসেছে সামনের এক ডাক্তারের কাছে। এদিকে ডাক্তারের কাছে লাইন পাওয়া যাচ্ছে না। কেন আরো আগে, রাত শেষ হবার আগেই ঘুম ভেঙে উঠে আসতে পারেনি, সেই নিয়ে দু’জনের ঝগড়া। মাঝখান থেকে একজন এসে বলে গেল – তিনশো টাকা ভিজিট আর একশো বেশি দিলে ডাক্তারের কাছে লাইন পাওয়া যাবে!
আমি কিছুই বললাম না। কোন ডাক্তারের কত ভিজিট, তার কাছে কিভাবে লাইন দিতে হয় – আমার জেনে কি হবে? হয়তো এই ডাক্তারের জন্য এমনই হয়! হয়তো সারাদিন রাত ধরে মানুষ তীর্থের কাকের মত বসে থাকে ওনার জন্য। হয়, এমনই হয়! হায় ডাক্তার বাবু, আপনি তবু ভগবান নন এই দেশে!
চা এর দোকানদারের কি হলো কে জানে !
বললো – স্যার , আপনি একটু ওই ডাক্তার বাবু কে বলে দিন না । আপনি বললে হয়ে যাবে।
আমি চোখ কটমট করে তাকালাম। মানে হলো – এখানে নো ডাক্তারি ।
মহিলা হঠাৎ যেন হাতে চাঁদ পেলেন । – এট্টু কইয়া দ্যান না! ম্যালা দিন ধইরে প্যাটে ব্যাথা । এখন ফুইলা গ্যাছে। হোমিও খাইতো। কাম অয় না। এট্টু কইয়া দ্যান।
একি মায়ারানী ?
চেনা চেনা লাগছে কি ?
আমি ছদ্ম গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম – তা কি করে হয় ? ওনার কতজন রোগী আছে আমি জানি না। এভাবে বললে উনি খারাপ ভাববেন।
পুরুষ টি পাশ থেকে বললো – আপনি ও ডাক্তার ?
কেন জানি না, এই একটি প্রশ্নে আবার ফিরে এলো প্রিয় শীত ।
শীত , কম্বল আর মায়ারানী ঘিরে ধরছে । বুঝলাম- আমি এদের মায়া এখনো কাটাতে পারিনি ।
লোকটিকে জবাব না দিয়ে ফোন থেকে সেই এরিয়ার ভগবানের মতো ডাক্তারের ফোন নাম্বার বের করে ডায়াল করলাম।
– গুড মর্নিং স্যার।
– গুড মর্নিং। বলো , বলো কি ব্যাপার? হঠাৎ এতোদিন পরে ফোন করলে যে ? আছো কোথায়?
হেসে বললাম – বিরক্ত করা ছাড়া আপনাকে তো ফোন করি না । এবার ও তাই। এই আপনার বাড়ির সামনের চা এর দোকানে ই আছি।
স্যার ও হাসলেন – আরে না না । এখনো রোগী দেখা শুরু করিনি। কি ব্যাপার? অবাক কাণ্ড!
দোকানে বসে ফোন করছো কেন ? ঘরে আসো। চা খেয়ে যাও।
– না স্যার । সকাল বেলা আপনাকে একটু ডিস্টার্ব করবো। তারপর আমি ও বসবো।
– আচ্ছা বলো।
– একজন রোগী লাইন পায়নি আপনার ওখানে। মনে হয় জটিল । একটু যদি সবার শেষে ….
– আরে ঠিক আছে ঠিক আছে। তুমি এখনই সবার আগে পাঠাও, আমি দেখছি । আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট সমীর কে বলছি।
– অনেক ধন্যবাদ স্যার ।
সময় পেলে একবার আসবো বিকেলে।
– আচ্ছা এসো।
ফোনটা কেটে দিয়ে দ্রুত ঘরে ফিরি। না , আমি এরকম ডাক্তারি তে অভ্যস্ত নই।
কাজ করছি।
ঘন্টাখানেক পর ই ফের স্যার এর ফোন। – হ্যাঁ স্যার বলুন।
– তোমার ওই রোগীর তো সমস্যা আছে অনেক। তোমার কাছে পাঠালাম। এখুনি একটা ইউএসজি করে রিপোর্ট দিয়ে পাঠাও ফের । আর হ্যাঁ , বুকের এক্স-রে টা ও রিপোর্ট করে দিও। আমার সন্দেহ ….
– বুঝেছি । আচ্ছা স্যার । পাঠিয়ে দিন।
বুঝলাম, কাজ বাড়লো।
শীত ? হয়তো বা! হয়তো না !
আধ ঘন্টা পর যখন সেই রোগীর ইউএসজি শেষ করলাম , তখন আমার নিজের কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি প্রায়।
পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন মহিলা। নিশ্চুপ ।
সেকি এই পুরুষের মায়ারানী ?
জানি না!
সহকারী কে পুরো ডেসক্রিপশন লিখিয়ে বললাম – impression লেখো – Ultrasonographic findings suggestive of – Adenocarcinoma of stomach with innumerable secondaries in multiple groups of abdominal lymph nodes , peritoneal cavity and liver.
বুকের এক্স-রে রিপোর্ট লিখলাম সংক্ষেপে – both lung parenchyma studded with large nodular opacities suggestive of secondaries.
( বাংলায় দাঁড়ায় – পাকস্থলীর ক্যান্সার, ছড়িয়ে পড়েছে পেটে , পেট ছাড়িয়ে বুকে ) ।
ভদ্রলোক কে উঠতে বললাম।
বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে মহিলা কে বললাম – এই রিপোর্ট নিয়ে এখুনি স্যার এর কাছে যাবে।
– কি অইছে স্যার ?
– যা হয়েছে সেটা ভালো নয়। বহুদিনের সমস্যা।
– কন তো কি অইছে ?
আমার শীত কেটে গেছে। ভেতর থেকে জেগে উঠেছে পুরানো রোগ । এদিক ওদিক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিছু বলা আমার দ্বারা হয় না।
বললাম – ক্যান্সার । পাকস্থলী তে। ছড়িয়ে পড়েছে পেট ছাড়িয়ে বুকে ও ।
মহিলা যেন তীব্র যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠলো – ও মাগোওওও।
তারপর , বসে পড়লো নোংরা মেঝেতে।
মায়ারানী ! মায়ারানী ! এই তো আমার সেই মায়ারানী !
প্রথম দিন যখন এক রোগীর বর্ণনা শুনেছিল আমার মুখে – ঠিক এভাবেই আর্তচিৎকার করে উঠেছিল। মুখ ঢেকেছিল ।
তাকে আমি আর কোনদিন কোন রোগীর গল্প বলিনি ।
মায়ারানী চিৎকার করে যাচ্ছে – কত্তোদিন কইচি , তিনডা জোন দিয়া ডাক্তার দেহাও । কেডা হোনে মোর কতা ! কোতায় কোতায় কি মলম আর চিনির দানা খাইয়া পইড়া রইলো ।
এহোন কি করমু মুই ? ও ডাইক্তার , কি করমু কও ?
আমার শীত চলে গেলে রাগ হয়।
মায়ারানী কাঁদলে রাগ হয়।
কম্বল ছেড়ে উঠতে হলে রাগ হয়।
আর রাগ হলে – আমি কঠিন হয়ে যাই।
কঠিন হলে আমি গলতে চাই। যত দ্রুত সম্ভব।
আমি ডাক্তার হয়ে উঠি ফের ।
কঠিন গলায় বললাম – স্যারের কাছে যাও । যদি প্যাথলজিস্ট থাকে কাল এসো । বায়োপসি করে দেব । টাকা লাগবে না।
তারপর সরকারি হাসপাতালে যাও। দেখো যদি কিছু হয়।
আমি একটু শীতের ছোঁয়ার জন্য জন্য দৌড়ে চলে যাই বেসিনে ।
জল দিয়ে জল ধুয়ে ফেলি । দুই জল মিলে মিশে কোথায় যেন চলে যায় ….
শীত লাগে না।
অ্যাপ্রনে হাত মুখ মুছে নিই অজান্তেই।
স্যার কে একটা মেসেজে রিপোর্টের শেষটা লিখে পাঠিয়ে দিই।
আমি বুঝতে পারি – ঘর ছেড়ে , মায়ারানী কে ছেড়ে, কম্বলের ওম ছেড়ে বেরোলে, বাইরের পৃথিবীতে আমাকে ঘিরে থাকে শুধুই – অ্যাপ্রনের রঙ – কাফনের মতো , সাদা ।
কিছুদিন ধরেই টের পাচ্ছি – অসংখ্য মৃত্যু সে কাফনের নিচে ঢুকে যেতে চাইছে।
থেকে যেতে চাইছে নিশ্চল হয়ে।
অ্যাপ্রনের এই কাফনে কি মৃত্যুর জন্য আমার কম্বলের মতোই খানিকটা শীত আর ওম রাখা আছে ?
মৃত্যু , শীত আর কম্বলের ওম তুমি ও কি ভালোবাসো ?
তাহলে অ্যাপ্রনের নিচে , একটা ছিন্নভিন্ন পাঁজরের খাঁচার ভেতর আগুন জ্বালাতে আসো কেন ?
বোঝো না যে – আগুন জ্বললে শীত চলে যায় ?
চুপিসারে এসো।
দেখো , এই কম্বল আর মায়ারানী যেন টের না পায় ।
ওই পুরুষের লাস্ট স্টেজ ক্যান্সারের মতো
পেট ছাড়িয়ে বুকে ছড়িয়ে পড়ো … অজান্তে। তারপর স্বান্তনায় থাকো চিরকাল।
থাকো না !