#প্যানডেমিক ডায়েরি ১৫
২ জুন, ২০২০
ধরিত্র
দোলনচাঁপা
মধুশ্রী তখন সাতাশ। লাবণ্যে থই থই। কোঁকড়া চুলের ঘের, মুখমন্ডলে এনেছে নিবিড় প্রশান্তি। মাতৃমহিমা এমনই। গর্ভের সন্তান সাত মাসের। তাই নিয়েই ডিউটি করতে গেছিল মধুশ্রী।
সাত বছর আগের কথা। অংশুমান , মধুশ্রী সদ্য বাড়ি কিনেছে । ইংল্যান্ডের কেন্দ্রে। যাকে বলে হার্ট অফ ব্রিটেন। জায়গাটার নাম লেস্টার। স্টেশন থেকে নেমে স্টোনি গেট বললেই লোকে দেখিয়ে দেবে। ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে। স্হানীয় লোকজন একদম কলকাতার মতো। রাস্তা গুলিয়ে গেলে দেখিয়ে দেয়। আগ বাড়িয়ে কথা বলে। এখানে না এলে বিলেত সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা গড়ে উঠত মধুশ্রীর। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। গুজরাতি, পাঞ্জাবি, দক্ষিণ ভারতীয়দের বাস। কয়েক ঘর বাঙালিও আছে ।
টিউবে চেপে মধুশ্রী অন্য দিনের মতোই গ্লস্টারে গেছিল। এইসময় একা ড্রাইভ করা উচিত নয়। নব্বই মাইল দূরে গ্লস্টার। মেট্রো থেকে নেমে হেঁটে মিনিট তিনেকের রাস্তা। গ্লস্টার হাসপাতালে ঢুকতে না ঢুকতেই একটা মেয়ে এসে মধুশ্রীর হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। সোনালি চুল, নীল চোখের তরুণী। একঝলক তাকিয়েই বুঝে ফেলেছিল মধুশ্রী। গর্ভবতী।
তারপর সেই অষ্টাদশীর গর্ভপাত করতে হয়েছিল সেদিন। কাজটাই তো এমন। রিপ্রোডাকটিভ অ্যান্ড সেক্স মেডিসিন। মায়েদের শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তার গুরুদায়িত্ব। ভ্রূণ কোনওভাবেই যেন মায়ের ক্ষতি না করতে পারে। অপরিকল্পিত গর্ভাদানের ফসলকে পৃথিবীতে না আসতে দেওয়াই শ্রেয়। পরিত্যক্ত অনাথ তো কম দেখেনি । বিমর্ষ হয়ে ভাবত মধুশ্রী, এমন বাবা মা কীভাবে হয়, যারা সন্তানদের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে যায়! এর থেকে ভ্রূণ অবস্থায় উপড়ে নেওয়া ভাল।
গর্ভপাত করানোর সময় কুলকুল করে ঘামছিল মধুশ্রী। এ পর্যন্ত প্রায় শ’খানেকের বেশি অ্যাবরশন করেছে কিন্তু সেদিন যে নিজের পেটের মধ্যে একজনের উপস্থিতি টের পাচ্ছিল ! টুকুস টুকুস নড়ছে!
সেই মুহূর্তে বড্ড কঠিন লাগছিল কাজটা। দেশে থাকতে প্রথম সন্তান হওয়ার সময় মা কিছুতেই ফলন্ত আম গাছটা কাটতে দিতে চায়নি। গাছটা পোকায় ভরে গেছিল। আমগুলো কাঁচা অবস্থাতেই ঝরছিল। ওষুধ দিয়েও কাজ হয়নি। তার উপর এক বিশাল মৌমাছির চাক। হুল ফুটাচ্ছিল বাড়ির প্রায় সবাইকেই। তবু সেই মৌমাছির চাকে আগুন ধরাতে দেয়নি মা। বলেছিল, এসময়ে সহ্য করতে হয়। ধরিত্রী হতে হয়। প্রথমেই কন্যা সন্তান হয়েছিল। মিঠি। খুব খুশি হয়েছিল অংশুমান।
নীল চোখের ব্রিটিশ তরুণীর কান্না সেদিন মুহ্যমান করে দিয়েছিল মধুশ্রীকে । ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মায়ের ইচ্ছেই শেষকথা। কাজেই রোগিনীর সেই ভ্রূণ নষ্ট করতে হয়েছিল মধুশ্রীকে । হৃদয়সমুদ্র উথালপাথাল । একটা কচি ফোঁপানোর শব্দ নিজের নাভি থেকে উঠে আসছিল দুই কানে।
‘মা, মাগো’
তারপর তিনদিন কাজে যেতে পারেনি মধুশ্রী। দিনরাত এক করে ঘুম আসতনা। শেষপর্যন্ত কোল আলো করে এসেছিল তার সন্তান। ফুটফুটে ছেলে ম্যাম্বো। তবুও সেই ধূসর দিনগুলো ভুলতে পারেনি মধুশ্রী। তারপর কত হাসি , আনন্দে কেটে গেছে দিন। ছেলেমেয়ে দুজনেই বড় হচ্ছে তরতরিয়ে। মধুশ্রী এখন তৃপ্ত নিজের কর্মজগতে। অজস্র মহিলারা নিজেদের জরায়ুর স্বাধীনতা উদযাপন করতে পারে মধুশ্রীর মতো ডাক্তারদের জন্য। প্রাথমিকভাবে সে তার রোগিনীদের পরামর্শ দেয় যাতে শিশুর জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়। একান্তই রোগিনী রাজি না হলে এবং ভ্রূণের বয়স তেইশ সপ্তাহের কম হলে তবেই মধুশ্রীরা রাজি হয়। মাতৃত্ব তো নারীর বাধ্যবাধকতা নয়, চয়েস।
তবে হঠাৎ পৃথিবী গিয়েছে পাল্টে। গত দু’মাস ধরে গ্রহটা রোগশয্যায় বিপর্যস্ত । এখানেও হু হু করে বাড়ছে গর্ভপাত। লন্ডনে একজন মাত্র মায়ের সদ্যোজাত বাচ্চা কোভিড আক্রান্ত হয়েছে। বাকি মায়েদের চার মাসের পর থেকে সংক্রমণের খবর আসছে যদিও সংখ্যাটা এমন কিছু বেশি নয়। মধুশ্রী জানে, আসলে মায়েরা ভয় পাচ্ছে। অনাগত সন্তান ভাইরাসে আক্রান্ত হবে সেই ভয়ের থেকেও বেশি হল কীভাবে সন্তানকে তারা বাঁচিয়ে রাখবে। হয়তো পরিকল্পনা করেই সন্তান নিয়েছিল। এখন লকডাউনের জেরে সঙ্গী অনেকদূরে আটকে । একাকী সন্তান প্রসব, যত্নআত্তি বড্ড মুশকিল। বিশেষত এই কঠিন সময়ে। খিলকুলুপ আঁটা গ্লস্টার শহরে এখন অবাঞ্ছিত মাতৃত্বও বেড়েছে। চার দেওয়ালের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর অনর্গল দিনরাত যাপন। এখন সেই অপরিকল্পিত ফসল জন্ম দিতে চাইছেন না দম্পতিরা। হয়তো তাদের কারও কারও একাধিক সন্তান।
আসল সমস্যা হল আর্থিক মন্দা। দোকান, বাজার , শপিং মল , রেস্টুরেন্ট বন্ধ। ক্যাব ড্রাইভাররা বেকার। হোটেল , ক্লাব, পার্লার বন্ধ । অসংখ্য মানুষ কর্মহীন। আয়হীন। বেকার অবস্থায় কে বা চায় অনাগত সন্তানকে জন্ম দিতে ? মানুষ তো শুধু প্রাণী নয়! জৈবিক ধর্ম ছাড়াও তো তার মন আছে। গর্ভের সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন আছে। মধুশ্রী তাই যখন মায়েদের থেকে গর্ভপাতের কারণগুলো জানতে পারে , হা হুতাশ করা ছাড়া তার উপায় থাকে না। নৈতিকভাবে মায়ের পাশে দাঁড়াতে হবে এমনই নির্দেশ আছে সরকারের। মধুশ্রী বর্ম এঁটে, মাস্ক পরে চলে যায় সেইসব ভ্রূণদেরকে ছেঁটে ফেলতে । একের পর এক।
আজকাল কিছুই ভাল লাগে না মধুশ্রীর। এমনিতেই কাতারে কাতারে মৃত্যু গোটা ইংল্যান্ড জুড়ে। আমেরিকা, ইতালিতে ভয়াবহ মৃতের সংখ্যা। ভারতবর্ষের জন্য মন আনচান। এই পরিস্থিতিতে তার হাতেও এত বেড়ে গিয়েছে ভ্রূণমৃত্যুর হার যে মধুশ্রী ক্লান্ত, বিধ্বস্ত । এত এত শিশুমৃত্যু তার জন্য?
গ্লস্টার যাওয়া আসা করতে গিয়ে গাড়িতে আনমনে ধাক্বা লাগিয়ে ফেলে। পথের পাশে সার সার পিটুনিয়া, গুচ্ছ গুচ্ছ লাল, হলুদ গোলাপ কিছুই তার মনকে চাঙ্গা করতে পারেনা। পৃথিবীর বাইরে কোন এক ব্ল্যাকহোল থেকে প্রচুর শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে হঠাৎ করে।
ভুল করে রাস্তার পাশে আচমকাই গাড়িটা দাঁড় করিয়ে ফেলেছিল মধুশ্রী। জানলায় পুলিশের টকটক শব্দ ।
“ম্যাডাম, এনি প্রবলেম? ”
এদেশে ট্র্যাফিক নিয়মকানুন খুব কড়া।
“প্লিজ শো ইওর লাইসেন্স।”
ফাইন দেওয়ার খবর দ্রুত পৌঁছে গেল অংশুমানের কাছে।
– “কী হয়েছে তোমার? এ তো নতুন নয়। তোমার স্পেশালাইজেশনটাই তো এমন। যাতে এইসব মায়েদের জন্য সার্ভিস দেওয়া যায়। ভারতবর্ষে এই মায়েদের জন্য তুমি এতকিছু করার ক্ষমতা পেতেনা। তাহলে ?”
মধুশ্রী চুপ।
সে যখন ট্রেনিং নিয়েছিল ইংল্যান্ডে এসে, একজন প্রবাসী বাঙালি, প্রবীণ চিকিৎসক তাকে বলেছিলেন, “এইসব ম্লান মূঢ় নারীদের মুখে দিতে হবে ভাষা। পারবে তো ? ”
– “লুক, মধুশ্রী। আমার দিকে তাকাও।” অংশুমান একটা ড্যাফোডিল ঝোপের কাছে তাকে নিয়ে গেল। এই বাগান দেখাশোনা করে অংশুমান। ভারি সুন্দর ফুলে প্রজাপতিতে ছাওয়া।
-“আমাদের হাতে কিছুই নেই মধুশ্রী। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো যেমন ধর সুইডেন , নরওয়েতে গত কুড়ি বছর ধরে এমনিই মহিলারা মাতৃত্ব নেয়না।”
এক কাপ কফি বানিয়ে আনল অংশুমান ।
– “তুমি তো অবুঝ নও মধু। এই পৃথিবী শুধু মানুষের নয়। প্রতি দিন , প্রতি মুহূর্তে প্রচুর প্রাণ চলে যাচ্ছে। নিরন্তর মৃত্যু । কখনও ভেবেছ , আমরা ,মানুষেরা দিনে দিনে বাড়তে বাড়তে কত প্রাণী, কত প্রজাতিকে অবলুপ্ত করে দিয়েছি ?”
– “ইয়েস মাম্মা, থিংক অ্যাবাউট ডোডো। দ্য বার্ড টোট্যালি এক্সটিঙ্কট ফ্রম আর্থ।” ম্যাম্বো বলে উঠল।
অংশুমান কফির কাপে চুমুক দিল। – “প্রতি বছর প্রায় দশ হাজার প্রজাতির প্রাণী আমরা হারিয়ে ফেলছি চিরতরে। এই পৃথিবী তো একদিন ওদেরও ছিল, তাই না?”
মধুশ্রী তাও উদাসীন। মিঠি ঘর থেকে ছুটে এল ।
-“এরপরও তুমি এত ভাবছ মা? কী হত যদি তুমি আমাকে চাষের জমিতে কুড়িয়ে পেতে ? কী নাম রাখতে মা ? সীতা ?”
মধুশ্রীর কাঁধ ঝাঁকাতে থাকে মিঠি।
বাগানের প্লাম গাছে থোকা থোকা লাল প্লাম। এই গ্রীষ্মে তাদের মরিশাস ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান ছিল। অস্থির চোখে মরিশাসের সৈকতে একটা কল্পনার ডোডোপাখি খুঁজতে থাকে মধুশ্রী।
নীল সমুদ্রের পাড়ে খয়েরি পালকের অজস্র ডোডো। সোনালি হলুদ ঠোঁট। ধরিত্রীর এমন ভ্রূণহত্যা কারা করে ? সভ্য মানুষ?
Photo credit: Dr. Gautam Biswas