যুদ্ধের মেটাফর – মেডিসিনে মেটাফর – মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স
১৯৮০ সালে মান্য মেডিক্যাল জার্নাল নিউ ইংল্যান্ড অব মেডিসিন-এর তৎকালীন সম্পাদক আর্নল্ড রেলম্যান একটি সাড়া জাগানো প্রবন্ধ লিখেছিলেন ঐ জার্নালের ২৩ অক্টোবর সংখ্যায়। শিরোনাম – The New Medical-Industrial Complex। সে প্রবন্ধে তিনি পাঠকদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে এটা একেবারে অভূতপূর্ব এক ঘটনা এবং “troubling implications for the future of our medical-care system”-এর ক্ষমতা এর মাঝে রয়েছে। আমরা পরবর্তী সময়ে একথার অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলন দেখেছি এই মুহূর্তের প্রায় ২১ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ক্ষমতাসম্পন্ন হেলথ কেয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে। কারা নিয়ন্ত্রণ করে এই ইন্ডাস্ট্রি? কে আবার? দানবীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এখনকার পরিস্থিতিতে একে আমরা বায়োটেকনোলজিকাল মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স-ও বলতে পারি, বলতে পারি মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল-স্টেট-পলিটিক্স কমপ্লেক্স। এদের বিশেষ প্রয়োজন টাকে চুল গজানোর কিংবা পৌরুষ জাগ্রত করার (ভায়াগ্রা) মতো ওষুধের। এসমস্ত অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ওষুধ (!) বিলিয়ন ডলারের মুনাফা দেয়। কিন্তু টিবি বা ফাইলেরিয়াসিস বা কৃমির জন্য ওষুধ প্রায় তৈরিই হয়না। মুনাফা সামান্য। এরা orphan drugs-এর দলে পড়ে।
অন্য একটি বেজায় লাভজনক ক্ষেত্র হচ্ছে ক্যানসারের চিকিৎসা – ওষুধ, প্রযুক্তি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদি। ক্যানসার-আক্রান্ত রোগী, পরিবার এবং স্বজনদের অসহায়তা সর্বোচ্চ মুনাফা তৈরি করে।
মানুষ মেটাফর ব্যবহার করে কেন? একটি বিষয়ের বোধগম্যতা, ব্যঞ্জনা এবং আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলার জন্য আমরা একটি শব্দ, শব্দবন্ধ বা রূপকল্প দিয়ে আরেকটি বিষয়ের সাহায্য নিই, অবতারণা করি। যবে থেকে (প্রায় ১৫০ বছর হবে) অ্যান্টিবায়োটিকের আদিরূপ আবিষ্কার হয়েছে তখন থেকে মেডিসিনে তার নাম হয়ে গেছে “ম্যাজিক বুলেট”। আমরা খেয়াল করবো বুলেট শব্দটি ব্যবহারের মাঝে সামরিক মেটাফরের প্রতিচ্ছবি। আরো আগের থেকে, গবেষকেরা দেখিয়েছেন হোমারের সময় থেকে (ভারতে সুশ্রুত), মেডিসিনে যুদ্ধের মেটাফর বারেবারে এসেছে। ১৯০০ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ক্যানসারের সাথে “যুদ্ধ” ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সাথে এক করে দেখা হত। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ক্যানসারকে “নৈরাজ্যবাদী” হিসেবে তুলনা করা হয়েছে। ক্যানসার কোশগুলোকে বলা হয়েছে “বলশেভিক” কোশ। (Ornella Moscucci, “Gender and Cancer in Britain, 1860-1910: The Emergence of Cancer as a Public Health Concern”, American Journal of Public health, August 2005, পৃঃ ১৩১২-১৩২১) পৃথিবীর তমসাবৃত আফ্রিকার সাথেও তুলনা করা হয়েছে ক্যানসারকে – “In a reference to the tradition of state-sponsored exploration and exploitation of distant lands, the disease was also described as the “darkest Africa” on the map of medicine.”
খোলা মনে ভেবে দেখলে বোঝা যায়, ক্যানসার বা অন্য কোন রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মেটাফর সাধারণ মেটাফরের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, এই প্রক্রিয়ার ফলে একদিকে রোগকে রোগির দেহ থেকে বিযুক্ত করে ফেলা যায় এবং সেটা সফলভাবে করা হয়। ফলে রোগীর দেহের চাইতে অধিকতর বা একমাত্র গুরুত্বসম্পন্ন হয়ে ওঠে রোগ। আগে যেটা বলেছি, এরকম পরিস্থিতিতে রোগীর সাফারিং বা ক্লিষ্টতা কোন আলোচ্য প্রসঙ্গ হিসেবে মেডিসিনের ডিসকোর্সে স্থান পায়না। ময়দানে নেমে পড়ে বায়োটেকনোলজিকাল মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স এদের সমস্ত “সামরিক সম্ভার” নিয়ে। অন্যদিকে, যখন যুদ্ধের মেটাফর বারংবার ব্যবহৃত হতে থাকে মেডিসিনের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জগতে চিকিৎসকদের হাত ধরে তখন যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের কুহকী চেতনায় ঢাকা পড়ে যায় চিন্তার স্বচ্ছতা, স্বাভাবিক বিচারের যুক্তি কাঠামো এবং, সর্বোপরি, ঢাকা পড়ে যায় এর পেছনে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তিকে ভেবে দেখার ক্ষমতা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করবো আমেরিকান জার্নাল অব বায়োএথিক্স-এর ২০১৬ সালের একটি সংখ্যার (২১ সেপ্টেম্বর) বিষয়বস্তু ছিল কেবলমাত্র মেডিসিনে যুদ্ধের মেটাফরের ব্যবহার নিয়ে। প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো ছিল – “War Metaphors in Health Care: What Are They Good For?”; “Healing Without Waging War: Beyond Military Metaphors in Medicine and HIV Cure Research”; “Military Metaphors in Health Care: Who Are We Actually Trying to Help?”; “Military Metaphors and Their Contribution to the Problems of Overdignosis and Overtreatment in the “War” Against Cancer”; “Killing the Pain and Battling the Lethargy: Misleading Military Metaphors in Palliative Care” ইত্যাদি।
তাহলে আমরা দেখলাম কেবলমাত্র ক্যানসারের ক্ষেত্রেই নয় এইডস-এর মতো রোগের ক্ষেত্রেও সামরিক উপমা ও ব্যঞ্জনা একইভাবে কাজ করে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে দুটো রোগই আন্তর্জাতিক মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে সমান কার্যকরী। সমস্ত সামরিক মেটাফর প্রধানত ব্যবহৃত হচ্ছে high-end যে সমস্ত রোগ যেমন ক্যানসার, HIV, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদি ধরনের অসুখ নিয়ে। ক্রনিক ইলনেস বলতে যা বোঝায় যেমন হাঁপানি ইত্যাদি নিয়ে ব্যবসায়ীদের মাথাব্যথা কম। অথচ এধরনের রোগে রোগীর সত্তা, জীবনের অর্থ আরো গভীরভাবে বদলে যায়। সাফারিং পড়ে থাকে নিজের একান্ত জগতে।
মেডিসিনের এই গ্লোবাল শিক্ষা-সংস্কৃতিতে চিকিৎসকেরা অজ্ঞানে কিংবা সজ্ঞানে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং বাহক হয়ে যায়। হিংসার এ এক নতুন চেহারা। ভাবলে একটু বিস্মিত হতে হয় বৈকি যে দেহকে এমনকি জাতি-রাষ্ট্রের সাথেও তুলনা করা হয়েছে – “Towards an Anthropology of Immunology: The Body as Nation State” (Emily Martin). দেহকে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ভাবলে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলাও জমে যায়!
মৃত্যুর দূত, মৃত্যুর সহকারী যখন হয়ে ওঠে মেডিসিন
আমরা নাৎসী অত্যাচারের কথা জানি। ডাক্তারদের একাংশ কিভাবে মানুষকে নানান ধারার মৃত্যুদণ্ড দিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পেত সেকথাও আমাদের বহুপঠিত, বহুশ্রুত। কিন্তু বর্তমান সময়ে ইরাকের আবু ঘ্রাইব বা গুয়ান্তানামো-তে যে পর্যায়ের নারকীয়, পৈশাচিক অত্যাচার চলে এবং তারপরে ডাক্তাররা আবার “ফিট” সার্টিফিকেট দিয়ে আরেকপ্রস্থ অত্যাচারের জন্য প্রস্তুত করে দেয় সে খবর আমরা কম রাখি। কয়েকটি প্রবন্ধের উল্লেখ করব – “Abu Ghraib: its legacy for military medicine” (Lancet, August 21, 2004); “Without Conscience” (New England Journal of Medicine, April 14, 2005); “When Doctors Go to War” (NEJM, January 6, 2005).
আমরা যারা ফুকোর Discipline and Punish বইটি পড়েছি তারা ঐ বইয়ের প্রথম দুটি অধ্যায়ে দেখেছি প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দানের গ্রাফিক বর্ণনা। গা শিউড়ে ওঠা, দেহের প্রতিটি অনুভূতিকে অবশ করে দেওয়া সে বিবরণে আমরা জেনেছি দেহের ওপরে রাষ্ট্রের, রাজনীতির এবং দণ্ডনীতির কি ভয়াবহ পরিণামচিহ্ন এঁকে দেওয়া যেতে পারে – “দুবার কিংবা তিনবার চেষ্টার ঘাতক স্যামসন এবং আরেকজন যে চিমটে ব্যবহার করছিল শরীর থেকে মাংস ছিঁড়ে নেবার কাজে, পকেট থেকে একটা ছুরি বের করলো পায়ের সন্ধি থেকে পা কেটে নেবার বদলে উরুদুটোকে কেটে ফেললো। এরপরে চারটি ঘোড়া দুপাশ থেকে টেনে উরুদুটিকে আলাদা করে দিল – প্রথমে ডান উরু, পরে বাঁদিকেরটি। যখন চারটি অঙ্গই ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে তখন যাজক এল তার কানে মন্ত্রোচ্চারণের জন্য।” (পৃঃ ৫) এরকম বীভৎস, বিবমিষা উদ্রেককারী শাস্তির বর্ণনা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।
এলেইন স্কারি তাঁর অধুনা ক্ল্যাসিক গ্রন্থ The Body in Pain-এ যন্ত্রণা এবং ব্যথা নির্দিষ্টভাবে কি করে বোঝাতে গিয়ে বলছেন, দৈহিক যন্ত্রণা প্রকাশের ভাষাকে শুধু রোধ করেনা, একে সক্রিয়ভাবে ধ্বংস করে “bringing about an immediate reversion to a state anterior to language, to the sounds and cries a human being makes before language is learned.” (p. 4) আমাদের আশ্বস্ত হবার অন্য কারণ আছে। হার্ভার্ড এবং আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে cognitive neuroscience নিয়ে বিপুল উদ্যমে গবেষণা ও চর্চা চলছে। এ গবেষণার একটি অভিমুখ হল যারা আমেরিকান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে অর্থাৎ হার্ডকোর টেররিস্ট তারা দৈহিক এবং মানসিক অত্যাচারের ঠিক কোন পর্যায়ে ভেঙ্গে পড়তে পারে (to the sounds and cries a human being makes before language is learned) তার ব্রেইন ম্যাপিং করা এবং মস্তিস্কের অ্যানাটমিতে কিরকম বায়োকেমিকাল পরিবর্তন হয় সেগুলোকে পরিমাপ করা। দেহ-রাজনীতির এ অন্য এক অধ্যায়। মেডিসিন এর অন্তরঙ্গ সাথী হয়ে যায়।
কিন্তু রাষ্ট্র দেহ-শাস্তি-রাজনীতি-ক্ষমতা এই ন্যারেটিভকে বদলাতে চাইল। সমগ্র ঘটনাই ঘটবে, কিন্তু অন্তরালে – “the disappearance of punishment as spectacle.” চমকপ্রদ ভাষায় ফুকো ব্যাখ্যা করেন – “From being an art of unbearable sensations punishment has become an economy of suspended rights.” এখানে ডাক্তারের ভূমিকা কি? একজন ডাক্তার রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে মৃত্যুর সমস্ত প্রক্রিয়াটি দেখাশোনা করবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। একজন “agent of welfare” হিসেবে ডাক্তার দেখবে মৃত্যু প্রক্রিয়াটি যেন যন্ত্রণা ছাড়া শান্তিময় হয়ে ওঠে। কিন্তু নিয়তির বা মেডিসিনের বা রাষ্ট্রের এমনই পরিহাস চিকিৎসকের রাষ্ট্র–নির্ধারিত দায়িত্ব হচ্ছে একজন মানুষের জীবনকে মৃত্যুর সীমানা ছাড়িয়ে পার করে দেওয়া।
দেহের ওপরে রাষ্ট্রের কর্তৃ্ত্ব খুব প্রকট হয়ে ওঠে মৃত্যুদণ্ড দেবার সময়, যেমন ফুকোর বর্ণনায় আমরা দেখলাম। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতেও এর খুব তীক্ষ্ণ, নির্মম এবং অভ্রান্ত চেহারা দেখা যাবে আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ডের বিবর্তনের মাঝে। এর পূর্ণাঙ্গ চেহারা ধরা পড়ে স্টুয়ার্ট ব্যানারের The Death Penalty : An American History-তে।
১৯৭৬ অবধি আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত “death by firing squad” দিয়ে। কিন্তু সময়ের সাথে বিচারব্যবস্থা দেখলো এধরনের মৃত্যু “too bloody and uncontrolled”। একাধিক মানুষকে গুলি করার পরেও তক্ষণাৎ মৃত্যু হয়নি। এ কেমনতর কথা? গণতান্ত্রিক দেশে একজন “অপরাধীকে” মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে অথচ সে একবারে মারা যাচ্ছেনা। সমাজের চোখে খারাপ দেখানোর চাইতেও, আমার বিচারে, রাষ্ট্রের অভ্রান্ততা প্রশ্নের মুখে পড়ছে এরকম মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতিতে, এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
এরপরে এল ফাঁসী। কিন্তু এটাও “came to be regarded as still more inhumane”। তারপরে এলো নাৎসী হিটলারের মতো গ্যাস চেম্বারের মৃত্যু। কিন্তু ১৯৯২ সালে অ্যারিজোনা রাজ্যে ডোনাল্ড হার্ডিং-এর মৃত্যু ঘটতে ১১ মিনিট সময় লেগেছিলো। ১৯৭৬ থেকে আজ অব্দি ২ জন বন্দীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হয়েছে, ৩ জনকে ফাঁসীকাঠে ঝুলিয়ে এবং ১২ জনকে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ইলেক্ট্রিক শক (২৬০০ ভোল্ট) দিয়ে মারার পদ্ধতি চালু হল এবং এখানে এসে আবার একটি গোল বাঁধলো। ১৯৭৯-তে এক বন্দীকে ২৬০০ ভোল্টের শক পরপর দুবার দেবার পরেও ২০ মিনিট ধরে তীব্রতম যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন মুখ নিয়ে বেঁচে ছিল। রাষ্ট্রের অসম্পূর্ণতা, অকার্যকারিতা আরেকবার প্রমাণিত হল। দেহের ওপরে রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার এবং মৃত্যুদণ্ডের রাজনীতি পূর্ণত প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও “মুক্তচিন্তার” রাষ্ট্র সুচারুভাবে কাজটি সুসম্পন্ন করতে পারছেনা। দেহের ওপরে রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্বের সাফল্যের ক্ষেত্রে এক বড়োসড়ো প্রশ্ন চিহ্ন উঠে যায়। রাষ্ট্রের পক্ষে একে হজম করা সম্ভব নয়। তখন ডাক পড়ে মেডিসিনের। আর ল্যান্সেট-এর মতো একাধিক মান্য পত্রিকায় সমচরিত্রের প্রশ্ন ওঠে – “How complicit are doctors in abuses of detainees?” (আগস্ট ২১, ২০০৪) এই রিপোর্টটিতে বলা হচ্ছে – “Even more disturbing is the emerging evidence that doctors and other medical personnel have helped, covered up, or stood by silently when humiliation, degrading treatment, and physical abuses have taken place.”
ফুকোর গবেষণার এক নতুন চিত্রনাট্য যেন দেখতে পাচ্ছি একবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকায়। গ্যাস চেম্বার পরবর্তী পদ্ধতি হল “lethal injection”। কি দিয়ে তৈরি এ ইঞ্জেকশন? ২৫০০-৫০০০ মাইক্রোগ্রাম সোডিয়াম থায়োপেন্টাল (জীবিত দেহে অপারেশনের সময়ে এর সর্বাধিক ডোজ ২৫০ মাইক্রোগ্রাম), ৬০-১০০ মিলিগ্রাম pancurium বলে একটি রাসায়নিক পদার্থ যা সবকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবশ করে দেয় এবং এই ডোজ স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। এরপরেও দেওয়া হয় ১২০-২৪০ মিলি ইকুইভ্যালেন্ট পটাশিয়াম। চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে মান্য পত্রিকা নিঊ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর নিবন্ধে একটি মন্তব্য করা হল – “Officials liked the method”, কারণ মৃত্যু ঘটানোর জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিকগুলো অ্যানাস্থেসিয়াতে ব্যবহৃত হয়। আরেকটি বড়ো কারণও ছিল – “The Eighth Amendment to the U.S. Constitution prohibits punishment that is “cruel and unusual.” The central question before the Court in Baze is whether the use of sodium thiopental, pancuronium bromide, and potassium chloride violates that constitutional prohibition.” (Gregory D. Curfman, NEJM, “Physicians and Execution”)
রাষ্ট্র-নির্ধারিত মৃত্যু, ব্যক্তি দেহের মৃত্যু, যাতে নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক না হয় সেজন্য রাষ্ট্র চিকিৎসাবিজ্ঞানকে সাথী করে। রাষ্ট্রের কি গভীর “মানবিক” অনুভব! নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর উদ্যোগে ২০০৮ সালে একটি প্যানেল ডিসকাশন হয়েছিল – “Discussion of Lethal Injection” শিরোনামে। সে আলোচনায় আইনের পরিচিত অধ্যাপক ডেবোরা ডেনো খুব মিহি করে জানিয়েছিলেন – The Eighth Amendment has never said, nor have the petitioners ever argued, that executions are to be pain-free. The question is whether or not that pain is unnecessary, whether there are alternatives. কিন্তু “pancuronium bromide is used in order to enhance the dignity of the inmate who’s dying, because without pancuronium, there might be some jerking or involuntary movements that would disturb some of the witnesses.” যে মানুষটির legalized killing হচ্ছে তার “dignity” ত্বরাণ্বিত করার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে ১০গুণ বেশি ডোজে দেওয়া হচ্ছে pancuronium! অথচ রাষ্ট্রের তরফে সজোরে এবং সগর্বে প্রকাশ করা এ যুক্তিকে অস্বীকারও করা যাবেনা। কারণ আমরা অর্থাৎ সামাজিক মানুষ ও নাগরিক আগেই এর পূর্ববর্তী স্তর দেহের ওপরে মৃত্যুদণ্ড কায়েম করার নৈতিক, আইনী ও সাংবিধানিক অধিকার মেনে নিয়েছি। সাধারণভাবে সামাজিক মান্যতা পেয়েছে রাষ্ট্রের operating techniques, রাষ্ট্র উৎপাদিত জ্ঞান বা logos, রাষ্ট্রের বিভিন্ন sign ও signifier। এর পেছনে রাষ্ট্র উদ্ভাবিত কারণ হল – “it made execution like familiar medical procedures rather than the grisly, backlash-inducing spectacle it had become. (মিসৌরিতে এমনকি হাসপাতালের ঘরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।)” (অতুল গাওয়ান্ডে, “When Law and Ethics Collide – Why Physicians Participate in Executions?”) গাওয়ান্ডে তাঁর Better পুস্তকে একটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছেন – “Medicine is being made an instrument of punishment.”
নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে “Without Conscience” (এপ্রিল ১৪, ২০০৫) প্রবন্ধে আফগানিস্তান এবং ইরাকের আবু ঘ্রাইবের বন্দীদের ওপরে অত্যাচার সম্পর্কে মন্তব্য করা হচ্ছে – “how can the recent, shameful torture to which Muslim prisoners were subjected by American soldiers be justified?” পরবর্তী মন্তব্য – “আমি কি এতটাই ছেলেমানুষ যে এখনো বিশ্বাস করব মেডিসিন একটি মহৎ পেশা যেখানে নৈতিকতার সর্বোচ্চ নীতিমালাকে তুলে ধরে?” স্টিভেন এইচ মাইলস “মেডিক্যাল টর্চার” নিয়ে একটি বৃহৎ পুস্তক লিখেছেন The Torture Doctors: Human Rights Crimes and the Road to Justice (২০২০)। এই বইয়ে তিনি বলছেন – “Few are psychopaths. Torture doctors are mostly careerists who collaborate to obtain government positions or simply choose to overlook the tortured people they see in their practice. They devise and oversee methods of torture, treating persons undergoing torture to keep them alive for future interrogation.”
লিওনার্ড রুবেনস্টাইন ল্যান্সেট-এ এই পুস্তকটিকে নিয়ে আলোচনা (“Accountability for medical participation in torture”, জুন ১৩, ২০২০) করতে গিয়ে বলেছেন – “এ ঘটনাগুলো (আবু ঘ্রাইব, গুয়ান্তানামো বে বা আফগানিস্তানের টর্চার কেন্দ্রগুলোতে যা ঘটে), যাহোক, এটা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যে হেলথ প্রফেশনালদের কিভাবে অত্যাচারের জঠরগুহার মধ্যে চুষে নেওয়া হয়।”
এরকম এক বহুমুখী সংকট-মুহূর্তে আমাদের নিজেদের দিকে আরেকবার ফিরে তাকানো দরকার, নতুন করে যত্ন নিয়ে ভাবা দরকার, প্রয়োজন পুনর্বিবেচনার।
(১) চিকিৎসার দর্শন নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। আধুনিক মেডিসিন বা বায়োমেডিসিনের কোন বিকল্প নেই। এর চেয়ে উন্নত কোন ব্যবস্থাও নেই চিকিৎসার জগতে। কিন্তু বায়োমেডিসিনের জন্মলগ্ন থেকেই এর মাঝে হিংসা বা ভায়োলেন্সের বীজ উপ্ত হয়ে আছে – জীবনানন্দের ভাষায় “আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর”-এর মতো। উইলিয়াম হান্টার বলেছিলেন “necessary inhumanity”.
(২) আমাদের প্রাত্যহিক যাপনে, মেডিসিনের জগতে, একটি বিশেষ স্থান নিয়ে আছে ভাষার সহিংসতা – ভায়োলেন্স অব ল্যাংগুয়েজ। এটা পশ্চিমী দর্শনের একটি বড়ো সমস্যা।
মানুষ কি দর্শন বাদ দিয়ে চলতে বা ভাবতে পারে? সেতো অদৃশ্য, অধরা, অনির্ণেয় এই ঊর্ণজালেরর মাঝেই রয়েছে। অনেকটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা সম্পর্কের মতো। আমরা রাষ্ট্রের ক্ষমতার মাঝে অবগাহন করে আছি – capillaries of power – তা সে তাবড় রাজনৈতিক বড়দা হোক, পাড়ার লুম্পেন বা সাংস্কৃতিক “পতঞ্জলি” হোক বা বাড়ির পুরুষ হোক।
আমাদের এ বিষয়গুলো নিয়ে গভীরে ভাবতে তো হবেই। আমরা চিকিৎসক হিসেবে আলোকসন্ধানী। মানুষকে নিরাময় করে তোলার আয়ুধ আমাদের আয়ত্তে আছে। মানবজাতির সামনে আমরা আশার আলোকস্তম্ভ। এজন্যই তো নিজেদের জীবনীশক্তি, মানুষের নতুন করে জীবন ফিরিয়ে দেবার সুবিপুল সুপ্ত ক্ষমতা শুধু অন্ধকার ঘেঁটে অপচয় করা যাবেনা – ‘ও আলোর পথযাত্রী’!
অসাধরন লিখেছেন। আপনার লেখা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারি।
Khub sundor lekha.
Toder mato chikitsakra achhe bolei amra ashay buk bandhi.Valo thakis.
কঠিন সত্যগুলো বড় ভয়ঙ্করভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য।
এইভাবে চোখে আঙুল দিয়ে সব দেখিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা তো চলছেই।
কিন্তু আমাদের চোখ তাতে খুলছে কি! বিশাল কর্পোরেট হাউসগুলি তো ক্রমশঃ বাড়াচ্ছেই তাদের আন্তর্জাতিক ব্যবসা মানবমনের দুশ্চিন্তাকে হাতিয়ার করে।
রাষ্ট্রযন্ত্রগুলিও তাদের আজ্ঞাবহ।
আপনার মত মননশীল মানুষদের চেষ্টা করে যাওয়া চলতেই পারে নতুন আলোর সন্ধানে।
সময়োপযোগী লেখা। পরবর্তী অংশের অপেক্ষায় রইলাম।