বিপ্লবের ঠিক পরে পরেই লেনিন জার্মানির সাথে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ব্রেস্ট লিটভস্ক চুক্তি। রাশিয়া তার বেশ কিছু ভূখণ্ড হারায়। এই চুক্তির সময় বলসেভিক পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বড় অংশ লেনিনের বিরোধিতা করেছিলেন যার নেতৃত্বে ছিলেন বুখারিন। আর একটা অংশ ছিল দোদুল্যমান যার নেতৃত্বে ছিলেন ট্রটস্কি। লেনিন প্রত্যেককে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করেন। শেষমেষ লেনিনের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে সাতটি, বিপক্ষে চারটি এবং ট্রটস্কি সহ চারজন ভোটদানে বিরত থাকেন। এর আটমাস পড়ে ট্রটস্কি লেখেন, খুব সাহসের সাথে নিজের ভুল স্বীকার করেই লেখেন যে “অন্যান্য অনেক জনের মতো তাঁর অবস্থান ভুল ছিল,. লেনিন ঠিক ছিলেন। লেনিন যদি জেদ ধরে না থাকতেন তাহলে চুক্তি সই হত না এবং দেশের তথা বিশ্ব ব্যাপী বিপ্লবী সংগ্রামের তাতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেত।”
এখানেই শেষ নয়। ওই দিনই তুরিদে প্রাসাদে পেড্রোগ্রাদ সোভিয়েত এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সভা বসে। সেখানেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছিল। লেনিন সহ অন্যান্য নেতৃত্ব সেখানে গিয়ে পৌঁছান সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। লেনিনের আগের বক্তারা বিশেষ করে বুখারিন গোষ্ঠীর
কার্ল রাদেক এই চুক্তির বিপক্ষে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। উপস্থিত প্রতিনিধিরা উত্তেজিত। আরও নেতৃত্ব একই সুরে বক্তব্য রাখেন। লেনিন চুপ করে বসে শুনছিলেন। তার পালা আসলে বলতে ওঠেন। এর আগে রাদেকের সাথে তাঁর কথা কাটাকাটি হয় গেছে।
লেনিনের শাণিত যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যের পর ভোটাভুটি হয় এবং শান্তি চুক্তি সই করার প্রস্তাব সংখ্যাধিক্য সহ পাশ হয়। যে জটিল কূটনৈতিক-সামরিক চিন্তাভাবনা তার পেছনে ছিল সেটা আজকের লেখার প্রতিপাদ্য নয়। পরে প্রমাণিত হয়েছিল যে আরো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে না জড়িয়ে শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য লেনিনের ওই সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল, সমর্পণ করা ওই সব ভূখণ্ড এর অধিকাংশ পরে সোভিয়েত এর হাতে ফিরে আসে।
এতক্ষণ কেবল ভূমিকা গেল। আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য লেনিনের সাথে রাদেকের কথোপকথন। রাদেক বারবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাঁদের মতামতের সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি দিচ্ছিলেন। লেনিন খুব অবাক বিস্ময়ে রাদেকের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ? কিন্তু রাশিয়ার অধিকাংশ মানুষতো শান্তিই চায়।” রাদেক প্রতিবাদ করে বলেন, “আপনি জানলেন কি করে?” লেনিন উত্তর দেন যে “রাশিয়ার অধিকাংশ মানুষতো ইতিমধ্যেই শান্তির সপক্ষে ভোট দিয়ে ফেলেছে।” “কি ভাবে?” “কেন তাদের পদযুগল দিয়ে। কমরেড রাদেক আপনি দেখেন নি সৈনিকরা কি ভাবে ফ্রন্ট ছেড়ে পালিয়ে আসছে জোরসে পা চালিয়ে? আর এই সৈনিকরা কাদের প্রতিনিধিত্ব করে? কৃষকদের। আর কৃষকরা হলেন রাশিয়ার জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।”
জনগনের নেতা হতে গেলে, জননেতা হতে গেলে কেবল পার্টির বড় নেতা হলেই চলে না, জনগণের মন পড়তে জানতে হয়। জনগণকে সত্যিকারের ভালোবেসে মার্ক্সবাদের অনুশীলন করা মহান কম্যুনিস্ট নেতা লেনিন সেটা পারতেন। তিনি পালিয়ে আসা জোরসে পা চালানো দেখে জনগণের বক্তব্য শুনতে পেতেন, মনোভাব বুঝতে পারতেন,। সব সময় জনগণকে মুখে কিছু বলতে হয় না। ভাষাহীন এক জোড়া ত্রস্ত পদ যুগলও অনেক মনের ইচ্ছে জানিয়ে দিতে পারে।
লেনিনকে নিয়ে অধিকাংশ আলোচনায় এটাই বারবার উঠে আসে যে তিনি অসাধারণ তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন, পার্টির মধ্যেকার বিতর্কে তিনি বারবার সঠিক পার্টি লাইনের দিশা দেখিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত হাতে কলমে বিপ্লবটা করেছিলেন। জননেতা বলতে বারংবার দেশ বিদেশের মধ্যপন্থী বা দক্ষিণপন্থী নেতাদেরই উদাহরণ টানা হয়, লেনিনকে টানা হয় না। লেনিন যে কত বড় মাপের জননেতা ছিলেন, জনপ্রিয় নেতা ছিলেন সেটা জানা বোঝার জন্যই এই ছোট্ট লেখাটা। পৃথিবীর প্রতিটা দেশের মার্ক্সবাদী লেনিনবাদীদের, তাদের দলের কর্মীদের, এমন কি নেতাদেরও, লেনিনের কাছ থেকে কত কি শেখার বাকি আছে। অসুবিধে তো কিছু নেই।
ধর্মতলার মোড়ে লেনিন তো এখনো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন আপনাদের সবার জন্য। খালি একটু পা চালিয়ে ভাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে যে।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা নেবেন লেনিন।
এপ্রিল ২২, ২০২৪
ইশ্😍😘কী সুন্দর যে লেখাটা।
আহা আপ্লুতার “একটু পা চালিয়ে ভাই ” কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এই তো বিদেশী মতবাদ তথা ভিণদেশী বিদেশী তাত্ত্বিক নেতা বিপ্লব কোনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয়।না কোনো অহংকার। সব দেশ মিলেমিশে যেখানে এক নিন্ নিন্ নিন্ লেনিন।
একরাশ বিপ্লবী অভিনন্দন গ্রহণ করুন কমরেড।
রোজ রোজ লেনিন জন্মদিন। জীবনের প্রাঞ্জল দর্শন হোক যাবতীয় ন্যাক্কারজনক মন সমাজের মধ্যের বাসস্থানেও।এইটাই বিশেষত এইটাই বোঝানোর জন্য। আমরা আলাদা নই কোথাও। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একজন লেনিন বাস করেন।