গলাটা অসম্ভব শুকনো লাগছে। দীপ্তর মনে হচ্ছে কতোদিন জল খায়নি- অথচ অ্যাকোয়াগার্ড ভর্তি জল। সকালেই মানসীদিদি ভরে দিয়ে গ্যাছে। সকালে ব্রেকফাস্ট তৈরি করে, দুবেলার ভাত তরকারি রেঁধে-তারপর গ্যাছে। কিন্তু উঠে জল খেতে ইচ্ছে করছে না।
এক ঝাপটা ঠান্ডা হাওয়া এসে দীপ্তর মুখের ঘাম মুছে দ্যায়। দীপ্ত এখনও ঘুমিয়ে আছে। ওর ক্লাস ফোরের ভাই।ওকে না ডাকলে উঠবে না। কী হবে ডেকে? স্কুল নেই। পড়া নেই। বাইরে কোথাও যাওয়ার নেই। শুয়ে থাকুক। মোবাইলে আবার মেসেজ ঢুকলো। সকাল থেকেই আসছে। দীপ্ত দেখবে না। দরকার নেই। এখন পর্দা উড়িয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। গায়ে জলের ছিটে লাগছে। মেঝে ভিজছে। রাতেও খুব বৃষ্টি হয়েছিলো। মানসীদিদি সকালে বকবক করছিলো। “একবার উঠে জানালাটা বন্ধ করবেনি ভাই? ঘর যে ভেসে গ্যাছে….”
দীপ্ত কানে ন্যায় নি। ভালো লাগছে না। আবার মানসীদিদি আসবে, আবার বকবক করবে। মিনিংলেস। দীপ্তর কিস্যু এসে যায় না। শনিবার কাকাই আর কাকিমণি আসবে। দীপ্ত দরজা খুলবে না। সবাই দয়া দ্যাখাতে আসছে। দীপ্ত ভাইকে নিয়ে বাঁচতে পারবে। শিখে নেবে। কারোর সাহায্যের দরকার নেই।
সবাই চাকরি করছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কেবল বাবাইকেই কাজে যেতে হতো। বাবাইকেই পেশেন্ট ঘাঁটতে হতো। কী লাভ হলো? দীপ্ত কোনোদিনই হাসপাতালে কাজ করবে না। পেশেন্ট দেখবে না। হেট করে। ও এই প্রফেশনটাকে হেট করে। বাবাইয়ের থেকে মাম্মামের ডিজিজ হলো। সবাই মরে গ্যালো।
বাবাই নাকি ব্যাঙ্কে অনেক টাকা রেখে গ্যাছে। দীপ্ত চায় না। টাকা চায় না। কিচ্ছু চায় না। ও তো কোথাও চলেই যেতো। কেবল ভাইটা যে বড্ড ছোটো। ও পারবে না। দীপ্ত গ্যাস জ্বালাতে পারে। মাইক্রোওয়েভ চালাতে পারে।
বৃন্দা ফোন করেছিলো। বৃন্দার বাড়িতে মা রয়েছে। আঙ্কেলও রয়েছে। ওর খুব মজা। মা বাবার সঙ্গে আছে। ওকে গ্যাস জ্বালাতে দ্যায় না। ওকে ব্যাঙ্কের হিসেব রাখতে হয় না। ইন্টারনেটে কেবল গেম খ্যালা আর ক্লাস করা। দীপ্ত ক্লাস এইটেই সব শিখে গ্যাছে।
দূরে কোন বাড়িতে শাঁখ বাজছে। এ সময়ে মা ধূপ জ্বালতো। শাঁখের আওয়াজ শুনলে কপালে হাত ঠ্যাকাতো। দীপ্ত আর কোনোদিন কাউকেই প্রণাম করবে না। কক্ষণো না।
“ভাই উঠে পড়্। আজ মানসীদিদি দেরিতে আসবে। আমি এখন তোকে মাইক্রোওয়েভে দুধ গরম করে দেবো…”
দীপ্র কোমল মুখটা কুঞ্চিত করে। চোখ পিটপিট করে। তারপর ওপাশ ফিরে শোয়। আগে বাবাই ঘরে থাকলে চ্যাংদোলা করে ওদের ঘুম থেকে তুলে নিতো। দীপ্ত বড়ো হলে পারবে। এখন পারবে না।
ফোন বাজছে। কাকিমণির নাম দ্যাখাচ্ছে। ফোনটা বেজে বেজে থেমে গ্যালো। আবার বাজছে। দীপ্ত ধরলো। “কিরে ফোন ধরছিস না… মেসেজ খুলছিস না… তুই কোথায়? ভাই কোথায়?”
দীপ্ত উত্তর দেবে না। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। ব্যথা লাগে। ব্যথায় দুচোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। অবরুদ্ধ জন্তুর মতো দীপ্ত, ক্লাস এইটের দীপ্ত, গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে থাকে। দীপ্র ওর কোলে মাথা গুঁজে দ্যায়। দীপ্রর কান্নাটা কাকিমণি টের পায় না।