আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। টিভি খুললেই একটাই খবর। যুদ্ধ চলছে! দেশটার সঙ্গে তখনো তেমন পরিচয় হয়নি! তবে, ফি-দিনের খবর শুনতে শুনতে ‘অপরিচিত’ দেশের মানুষগুলো পরিচিত হয়ে গেল! ইরাক, আমেরিকা, জর্জ ডব্লিউ বুশ আর সাদ্দাম হোসেন- এই নামগুলো ক্লাস ফাইভের টিফিন ব্রেক ও আমাদের মুখে মুখে ঘুরতো। ছোটোবেলা ফিরে আসলে কার না ভালো লাগে! ক’দিন ধরে টিভি খুললেই যেন মনে হচ্ছে, আমাদের ছোটোবেলা যেন ফিরে এসেছে। তবে তা একেবারেই আনন্দ দিচ্ছে না। কারণ, আমরা তো বড্ড সাধারণ। তাই আমাদের জাতি বিদ্বেষ, আগ্রাসন এগুলো ভালো লাগে না। যদিও আমাদের নাম করেই বিশ্বে যুদ্ধ চালান রাষ্ট্র নায়কেরা। কখনো বলা হয়, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য, আবার কখনো বলা হয়, জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই! আর আমাদের নামে যুদ্ধ চালিয়ে, আমাদের বোকা বানিয়ে ক্ষমতার চূড়ায় বসার লোভ লকলক করে কখনও হিটলার, কখনো বুশ আবার কখনো পুতিনের। যাই হোক, বিশ্ব রাজনীতির অঙ্ক বদলের এই গুরুতর পর্যায়ে, এক ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ পরিসংখ্যান বের করলো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৯ থেকে পৃথিবী যে অতিমারির শিকার, তাতে কতজন শিশু অনাথ হয়েছে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ খবর পরিবেশন করার ফাঁকে কোনও কোনও সংবাদ মাধ্যম এক আধবার সেই রিপোর্ট উল্লেখ করলো।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১.৫ মিলিয়ন শিশু বিশ্বে করোনার জন্য বাবা-মা হারিয়ে অনাথ হয়েছে। ভারতে সেই সংখ্যাটা ১৯ লাখ। অর্থাৎ, গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে, যে অতিমারি আমাদের সকলের জীবনে কালো মেঘ এনেছিলো, অনেকের জীবনেই তা পাকাপাকি ভাবে থেকে গেল।
প্রত্যেক দিন পৃথিবী জুড়ে বহু শিশু বাবা-মা হারায়। দূর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও কত কি! এই যে এখন ইউক্রেন বনাম রাশিয়া হচ্ছে, তাতেও হারাবে! হাজার হাজার শিশু তাদের বাবা-মা, প্রিয়জনদের হারাবে! বুঝতে শেখার আগেই হারিয়ে যাবে তাদের শৈশব! আর আমরা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো!
যেমন আমরা দেখছি! আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল! আর কপাল চাপড়াচ্ছি! ছাপোষা মানুষ আর কী ই বা করতে পারেন! আসলে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও জানে ভোট জেতা যায় জাতপাত ধর্ম দিয়ে। তাই তো কোটি কোটি টাকার মন্দির মসজিদ হয়, স্ট্যাচু হয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তার নিরিখে ভোট জেতা যায় না। তাই এত বড়ো স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের পরেও নির্মলা সীতারমান বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি না করার সাহস দেখাতে পারেন। সে নিয়ে বিরোধী দল মুখে কুলুপ আটে। সে নিয়ে পাড়ায় মিছিল হয় না। ধর্না হয় না। বিক্ষোভে কেউ ফেটে পড়ে না।
করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমাদের ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল। কেউ অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছেন, কোথাও সংক্রমিত হওয়ার রিপোর্ট এতটাই পরে আসছে, যে রোগীর চিকিৎসা শুরু করতেই অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর সবথেকে বড় ফাঁকি যে আমাদের প্রাথমিক স্তরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় রয়েছে তা আমরা প্রতিদিন অনুভব করেছি। তা না হলে, অতিমারির সময়ে মাস্ক না পরার জন্য পথচারিকে পুলিশ কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে! জনস্বাস্থ্যে মানুষকে সচেতন করা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা অতি চতুরতার সঙ্গে এদেশের সরকার এড়িয়ে চলতো-চলছে আর আশা করি চলবে! কারণ, প্রাথমিক স্তরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে মজবুত করতে হলে তো কয়েকটা বড় বিল্ডিং তৈরি আর কয়েকটা বিজ্ঞাপন দিলেই কাজ শেষ হবে না। স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগ করতে হবে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ঠিকমতো কাজে লাগাতে হবে। প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে। অতো কাজে লাভ কী! তারথেকে কয়েকটা বহুতল বানিয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেই হয়ে গেল। লোকে ভাববে সরকার তো হাসপাতাল তৈরি করেছে। তারপরে সেখানে চিকিৎসক আর নার্সের অভাবে তালা ঝুলিয়ে দিলেই হলো। মঞ্চে গিয়ে বলবো, ডাক্তার গ্রামে যেতে চায় না। আমি কী করবো? এবার ডাক্তার পেটাও!
১৯ লাখ শিশু অনাথ! কোনও সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে তাদের জন্য? তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের দায়িত্ব কে নেবে? ভারতে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের গড়ে তোলার দায়িত্ব সরকারের নেই? অনেক শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ হয়তো, চাঁদা তুলে প্রাথমিকভাবে ওদের পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু চাঁদার টাকায় কি একজন শিশুর ভরণপোষণ সম্ভব?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এই করোনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। প্রত্যেক সরকারের ভেবে দেখা দরকার, স্বাস্থ্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। এত প্রকট ভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ফাঁকফোকর দেখার সুযোগ হয়তো আমরা আর কখনো পাবো না। কিন্তু সরকার কি সত্যিই দেখতে চায়! চাইলে কি ২০২২ সালের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়তো না? জনস্বাস্থ্য নিয়ে জোরালো পরিকল্পনা হতো না? দেশের প্রত্যেক বড় হাসপাতালে অক্সিজেন প্ল্যান্ট আর ব্লাড ব্যাঙ্ক তৈরি আবশ্যিক হয়ে উঠতো না? যাতে আর কখনো কোনও মহামারির জন্য, সংক্রমক রোগের জন্য কোনও শিশুকে অনাথ না হতে হয়, সেই জন্য পরিকল্পনা সরকার করছে?
এই ১৯ লাখ শিশুর মধ্যে একজনের সঙ্গে হয়তো জীবনের কোনও না কোনও পর্বে আমাদের দেখা হবে! আমরা কী উত্তর দেবো? তাদের অনিশ্চিত জীবনের দায়িত্ব কে নেবে?