Facebook Twitter Google-plus Youtube Microphone
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Menu
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Swasthyer Britte Archive
Search
Generic filters
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Search
Generic filters

সুবোধবাবুর বাড়ি

Screenshot_2022-02-27-00-44-56-36_680d03679600f7af0b4c700c6b270fe7
Dr. Aniruddha Deb

Dr. Aniruddha Deb

Psychiatrist, Writer
My Other Posts
  • February 27, 2022
  • 8:32 am
  • No Comments

শ্রীময়ী – বইমেলা সংখ্যা ১৪২৩-এ প্রকাশিত

সুবোধবাবু র‍্যাপারটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিলেন। আজকাল শীত করে। আগে ভরা শীতেও একটা হাতাকাটা সোয়েটার পরে বাগানে মাটি কুপিয়েছেন, ভোরের কুয়াশামাখা রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন রোজ।
এই কুয়াশাটাই যত নষ্টের গোড়া। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আগেকার মতো ‘একটু মর্নিং ওয়াক করে আসি’ ভেবে বেরিয়েছিলেন। পাশে রাখী শুয়ে ছিল, ডাকেননি। এখন ফেরার পথে বাড়ির রাস্তাটাই খুঁজে পাচ্ছেন না। নতুন বাড়ি, নতুন রাস্তা… মায় নতুন শহর… রাস্তার নামটাও ছাতা মনে নেই। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে সবই এক রকম দেখাচ্ছে।
মোড়টা ঘুরেই একটা নিমগাছ দেখে থমকে দাঁড়ালেন। বাড়ির সামনে একটা নিমগাছ ছিল না? আবছা স্মৃতি হাতড়ে মনে হল, না। এ বাড়ির সামনে না। আগের বাড়ির সামনে ছিল। নিজের বাগানেই ছিল। নিমপাতা ভাজা খেতে ভালবাসতেন। বেগুন দিয়ে। অনেক দিন খান না। বাজার থেকে নিমপাতা কিনে এনে নিম-বেগুন রান্না করাই যায়…
কিন্তু এটা বাড়ির রাস্তা নয়। তাও এগোলেন। সামনে একটা দোকান। কাছে গিয়ে বুঝলেন চায়ের দোকান। এমন কোনও দোকান বাড়ির আশেপাশে নেই… অন্ততঃ সুবোধবাবুর স্মরণে নেই। তবে স্মরণে নেই বলেই যে আসলে নেই তা নাও হতে পারে।
দোকানদার কয়লার উনুনে আঁচ দিয়েছে। হাতপাখা নেড়ে হাওয়া করছে। উনুন থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরিয়ে দোকানটা ভরিয়ে দিয়েছে। দোকান থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে কুয়াশার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
পায়ে পায়ে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন সুবোধবাবু। জিজ্ঞেস করবেন? কিন্তু কী জিজ্ঞেস করবেন? রাস্তার নামটাই কী যেন ছিল ছাতা… দোকানদার ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “বসেন বাবু, চা হয়ে গেল প্রায়…”
চমকে উঠলেন সুবোধবাবু। জোরে মাথা নেড়ে বললেন, “না না, তোমার চায়ে চিনি…” প্রায় দৌড়ে চলে গেলেন দোকানের সামনে থেকে। কিন্তু সমস্যাটা তো রয়েই গেল। বাড়ি ফেরার পথটা তো পেলেন না খুঁজে। পরের মোড়টায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন। কিছুই চেনা লাগল না। র‍্যাপারটার নিচে হাত চালিয়ে দেখলেন ফতুয়ার পকেটে মোবাইল ফোনটা আছে কি না। এর আগেও প্রায় বার চার-পাঁচেক খুঁজেছেন, মনে ছিল না। এবারও হাতে পেলেন না। নিশ্চয়ই নিয়ে বেরোননি। সুকোমল বার বার বলে দিয়েছিল, “বাবা, সর্বসময় এটা হাতে হাতে রাখবে। কোনও সমস্যা হলেই ফোন করবে।”
ফতুয়ার ডান পকেটে একটা কী যেন রয়েছে। এর আগে হাতে পাননি কেন? বেরিয়ে এল পুরনো গেঁজেটা। এটা এল কোত্থেকে? বহুদিনের মধ্যে ব্যবহার করেছেন বলে তো মনে পড়ে না।
আজকাল রাখীই এটা কোমরে গুঁজে রাখে সারাক্ষণ। তবে কি বেরোন’র আগে মোবাইল ফোনের বদলে এটাই পকেটে নিয়ে বেরিয়েছেন?
পকেটের মধ্যেই গেঁজেটা হাত দিয়ে টিপে টিপে বোঝার চেষ্টা করলেন কত টাকা আছে। বেশ কিছু আছে মনে হল। বের করে গোনার চেষ্টা করলেন না সুবোধবাবু। রাস্তার মাঝখানে টাকা গোনার অভ্যেস কোনদিনই ছিল না। তাছাড়া গেঁজে খুলে টাকা গুনলে সুকোমল আর সমীরণ ভীষণ রাগারাগি করত। ওদের আঁতে লাগত। মার কাছে নালিশ করত। কিন্তু চিরকাল দেখেছেন নিজের বাবাও গেঁজেতেই টাকা রাখতেন, দাদুও। একটা গেঁজে ধুতির ভাঁজে গুঁজে রাখতেও সুবিধে।
আজকাল আর রাখেন না। রাখী আপত্তি করে। বলে সুবোধবাবু নাকি টাকা হারিয়ে ফেলেন। সেই জন্যই টাকার গেঁজে এখন রাখীর জিম্মায়। সুবোধবাবু আপত্তি করেন না। নতুন শহরে এসে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে গিয়ে এমনই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল…
আরও খানিকটা হাঁটলেন সুবোধবাবু। পায়ে ব্যথা করছে একটু একটু। চারিপাশটা একটু আলো হয়েছে আরও, কিন্তু তাতে যেন কুয়াশাটা আরও ঘনিয়ে এসেছে। দশফুটের বেশি দেখা যাচ্ছে না। এদিকে কুয়াশা বেশি হয়। কিন্তু প্রতাপগঞ্জের মত নয়।
প্রতাপগঞ্জের বাড়িতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে দেখতেন ঘরের ভেতরে কুয়াশা গোল-গোল করে পাক খাচ্ছে। রাখী চাইত শীতের রাতে জানলা বন্ধ করে শুতে, কিন্তু সুবোধবাবু রাজি হতেন না। ছোটোবেলা থেকে শুনেছেন, রাতে কখনও বদ্ধ ঘরে শুতে নেই। তাই শীতেও একটা জানলা খোলা থাকত।
প্রতাপগঞ্জের বাড়িটা বিশাল ছিল। বাইশ-ঘরের প্রাসাদ। চারিপাশে বিরাট বাগান। তাও তো সুবোধবাবুর বাবা দীঘিটা মিউনিসিপ্যালিটিকে দিয়ে দিয়েছিলেন। ওরা নাম দিয়েছিল কৃষ্ণসায়র। এখন বোটিং হয় ওখানে।
রাস্তার পাশে এখন সারি সারি দোকান। সবকটাই বন্ধ অবশ্য। এগুলো বড় দোকান। অর্থাৎ কোনও বাজার এলাকায় এসে পড়েছেন সুবোধবাবু। একটা দোকানের সামনে কল্যাপসিব্ল দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বসলেন। মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে হবে। এক বছরের ওপর এই পোড়া শহরটায় বাস করছেন, কিন্তু কিছুই চিনে উঠতে পারেননি। প্রতাপগঞ্জের অলিগলি মুখস্ত ছিল। এই বুড়ো বয়সে মর্নিং ওয়াক করার খেয়ালে কী আতান্তরেই না পড়লেন সুবোধবাবু!
প্রতাপগঞ্জ হলে কোনও ভাবনাই ছিল না। বাড়ির রাস্তা ভুলে যাবার প্রশ্ন তো ওঠেই না, উপরন্তু শহরশুদ্ধু লোক সুবোধবাবুকে চিনত। সুবোধবাবু উঠে পড়লেন। চেনা লোক দূর অস্ত, একটা লোকও গেল না এতক্ষণে সামনে দিয়ে। অবশ্য গেলেও কী-ই বা বলতেন?
সামনের বাড়িটায় লেখা ব্যাঙ্ক। হঠাৎ মনে পড়ল এই ব্যাঙ্কটা উনি চেনেন। প্রতাপগঞ্জ থেকে এসে এখানেই প্রথম ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে এসেছিলেন রাখীর সঙ্গে। ব্যাঙ্কের কাস্টমার রিলেশন অফিসার নাকটা কুঁচকে একটু হেসে বলেছিলেন, “এ ভাবে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়? আপনার বয়েস তো আমার ডবলেরও বেশি! একটা অ্যাড্রেস প্রুফ নেই, যা এনেছেন সে কোন প্রতাপগঞ্জ না কোথাকার… এভাবে হয়? যান, যান, একটা প্রপার অ্যাড্রেস প্রুফ নিয়ে আসুন দেখি – শুধু সময় নষ্ট করতে আসবেন না।”
মুখ কালো করে রাখী আর সুবোধবাবু বেরিয়ে এসেছিলেন। সুবোধবাবু কোনও দিন ব্যাঙ্কে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলেননি। ফোন করলে খাতা কলম নিয়ে ম্যানেজার বাড়ি চলে আসতেন… আর আজ কী না…
খানিকক্ষণ হেঁটে এসে পড়লেন একটা বড়ো রাস্তার মোড়ে। এখানে দোকানপাট খোলা। শাল-চাদর মুড়ি দিয়ে, মাথা-মুখ মোটা মোটা মাফলারে ঢেকে লোকে ইতিউতি ঘোরাফেরা করছে, চায়ের দোকানে চা খাচ্ছে। সুবোধবাবু এগিয়ে গেলেন। কেউ ফিরেও তাকাল না। প্রতাপগঞ্জের বাজারটা ওঁর দাদুর নামে। সে বাজারে এভাবে অপরিচিতের মত হাঁটতে হত না। হঠাৎ ভীষণ চা তেষ্টা পেল। মনে হল, চাওয়ালাকে বললে কি এক কাপ চিনি ছাড়া চা দিতে পারবে না? ডায়াবিটিস তো আজকাল অনেকেরই আছে! রাস্তা পেরোতে গিয়ে চোখ পড়ল বাসটার দিকে। থমকে গেলেন। ড্রাইভারের সিটের ওপর জ্বলজ্বল করছে – প্রতাপগঞ্জ। গতিপথ বদলে গেল নিজে নিজেই। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কন্ডাকটর। জিজ্ঞেস করলেন, “প্রতাপগঞ্জ যাবে? এখনই?” ছোকরাটা কিছু না বলে ডান হাতটা শালের আড়াল থেকে বের করে বাসের দরজাটা দেখিয়ে দিয়ে হাতটা আবার শালের তলায় ঢুকিয়ে দিল।
কেন বাসে চড়ে বসলেন নিজেই ভাল করে জানেন না। ভোরের বাস হু-হু করে ছুটেছে। জানালার পাশে বসে সুবোধবাবু। কাচের জানালা বন্ধ। বাইরে কুয়াশার ঘনত্ব কমছে। শীতের রুক্ষ মাঠঘাট দেখা যাচ্ছে, নরম রোদের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে রাস্তার ধারের ধুলোমাখা গাছগাছালিতে।
প্রতাপগঞ্জে সুবোধবাবু শীতের ভোরে পায়চারি করতে বেরোতেন রোজ। বাগানে এতক্ষণে মালি এসে যেত। শীতের সময়ে ফুলে ফুলে ছেয়ে যেত বাগানটা। বাবার শখ ছিল – সুবোধবাবু যদিও কখনও তেমন উৎসাহী ছিলেন না, তবু বাবার নিয়মগুলো বদলাননি। শীতের শুরু থেকেই মালির পেছনে লেগে যেতেন। ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ক্যালেন্ডুলা, প্যানসি, ফ্লক্স, গাঁদা, পপি, গাজানিয়া, স্টক, ডগফ্লাওয়ার – কোনটা কী শেষ অবধি চিনে উঠতে পারেননি, কিন্তু পৌষ পড়লেই বাগানটাকে রঙিন করে তুলতেন। বাগানটা বোধহয় এত দিনে আর নেই…
“দাদু, টিকিট!” চমকে তাকালেন। টিকিট? তাই তো! বাসে উঠেছেন, টিকিট কাটারই তো নিয়ম। কিন্তু, পয়সা…?
অভ্যেসমত হাতটা কোমরে চলে গিয়েছিল। ওখানেই তো গেঁজেতে পয়সা ভরে গুঁজে রাখার অভ্যেস ছিল সারা জীবন। আর তখনই মনে পড়ল – পকেট থেকে গেঁজেটা বের করে টাকা বের করলেন।
কত দিতে হবে? নোটগুলো কেমন যেন অচেনা লাগে সুবোধবাবুর। কন্ডাকটরটা হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “প্রতাপগঞ্জ যাবেন বললেন তো? পঁয়ত্রিশ দিন।”
সুবোধবাবুর ঘাম বেরিয়ে এল। পঁয়ত্রিশ! মানে তিন আর পাঁচ। সেটা মনে আছে। কিন্তু তিন আর পাঁচ লেখা কিছু তো হাতে নেই। কয়েকটা নোটে লেখা আছে এক আর শূন্য, কয়েকটাতে পাঁচ আর শূন্য, আর দু’একটা আছে তাতে একের পরে দুটো শূন্য। খানিক ভেবে একটা নোট বাড়িয়ে দিলেন কন্ডাকটরের দিকে। কন্ডাকটর হাত সরিয়ে হেসে বলল, “আরে দাদু, সক্কাল সক্কাল ইয়ার্কি ভাল লাগে? পঞ্চাশের নোটটা দিন না!”
পঞ্চাশ! কোনটা পঞ্চাশ? প্রায় দম বন্ধ করে পরের নোটটা বাড়িয়ে দিলেন। কপাল ভাল। এবারে টাকাটা নিয়ে কন্ডাকটর একটা নোট আর কয়েন বাড়িয়ে দিল। সঙ্গে একটা টিকিট।
বাসের ভেতরে এখন অনেক যাত্রী। তবে দাঁড়িয়ে কেউ নেই। সকালবেলা বলেই বোধহয়। সারাদিন এরকম খালি থাকলে ব্যবসা চলবে না।
নিতাইয়ের বাসের ব্যবসা উঠে গিয়েছিল। সুবোধবাবু চাকরি দিয়েছিলেন নিজের চালকলে। প্রথম দিকে নিতাই ভাল কাজ করত। পরে ওই প্রোমোটার ছেলেটার পাল্লায় পড়ে…
কী নাম ছিল প্রোমোটার ছেলেটার? ওর নামও ভুলে গেলে চলবে কী করে! হঠাৎ কেমন ভেতরটা আনচান করে উঠল। কী যেন একটা হয়েছিল – কী যেন বলেছিল ছেলেটা। ছেলেটার নামটাই মনে পরছে না… নিতাই? না, না। নিতাই তো ছেলেটার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। না নিতাই না। সুকোমল। হ্যাঁ। সুকোমল। সুকোমলই বটে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন সুবোধবাবু। সুকোমল বলেছিল মোবাইল না নিয়ে কোত্থাও না যেতে। কিন্তু আজ সুবোধবাবু মোবাইল না নিয়েই বেরিয়ে এসেছেন। সুকোমল রাগারাগি করবে। বাবার স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা করে ছেলেটা। সেবারে যখন প্রোমোটার ছেলেটা…
তাই তো! সুকোমল তো সুবোধবাবুর নিজের ছেলে! পুঁটের সঙ্গে তো ও-ই লড়াই করে বাড়িঘর বেচে সুবোধবাবুকে নিয়ে গিয়েছিল… পুঁটে… প্রোমোটারের নাম পুঁটে।
বিন্দু বিন্দু ঘাম আবার সুবোধবাবুর শরীরটাকে ঠাণ্ডা করে দিল। ওঁকে দেখলে প্রতাপগঞ্জে মানুষ রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াত। সেই সুবোধবাবুকে যেদিন পুঁটে বাজারের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলেছিল, “সুবোধবাবু, আপনার বাড়ির পেছনের জমিটা ক’কাঠা?” সুবোধবাবু বিশ্বাস করতে পারেননি কথাটা ওঁকে বলা হচ্ছে। পাশ কাটিয়ে চলে যাবার পথে পুঁটে আর ওর দলবলের হাসির হররা তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে দিনের পর দিন পথে ঘাটে শুনতে হয়েছে, “এত জমি নিয়ে কী করবেন?” “দিয়ে দিন আমাকে, ভাল দাম দেব…” এমনকি, “সালা, একদিন লাস্‌ পড়ে থাকবে রাস্তায়, তখন এমনিই নিয়ে নেব, বলছি দিয়ে দে…”
পাত্তা দেননি সুবোধবাবু। ব্যবসায়ী হিসেবে তখন ওঁর রমরমা। জেলার সমস্ত নলেন গুড়ের উৎপাদন থেকে শুরু করে পাঁচশো কিলোমিটারের মধ্যে একমাত্র পাঁচতারা রিসর্ট সবই সুবোধবাবুর সাতাশটা ব্যবসার মধ্যে পড়ে। পুঁটের মত দু’পয়সার গুণ্ডাকে গঞ্জছাড়া করতে একটাই ফোন করতে হবে বড়জোর।
সমস্যা হবে ভাবেননি, কিন্তু ভাবা উচিত ছিল। ফলটা দাঁড়াল এই, যে এক দিন সকালে সুবোধবাবুর বাড়িতে পুঁটে তার দলবল নিয়ে, কাজের লোককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে ঢুকে পড়ে বসার ঘরের কফি টেবিলটার চারটে পায়া হকি স্টিক দিয়ে পিটিয়ে ভেঙে ফেলে রেখে বলল, “দেখে রাখুন – আর এও মনে রাখুন, নিজেরও পা আছে আপনার। ছ’মাস সময় দিলাম – পেছনের বাগানটা আমি নিয়ে নেব। ভাল দাম দেব – আপনাকে ভাবতে হবে না সে নিয়ে।”
তিনপুরুষেরও বেশি সে কফি টেবিল সুবোধবাবুর বাড়ির বৈঠকখানায় ছিল। ইংল্যান্ড থেকে এনেছিলেন দাদুর বাবা।
তখন সুবোধবাবু ফোন করেছিলেন। স্থানীয় এম.এল.এ, এম.পি দুজনেই নতুন। গত ইলেকশনে নতুন পার্টি দাপিয়ে সমস্ত সিট দখল করেছে। পুঁটে তাদেরই দলের ছেলে। এম.এল.এ, এম.পি দু’জনেই সুবোধবাবুকে জ্যাঠামশাই বলে। একটা ফোন করলেই…
বাসটা একটা বড়ো মত স্ট্যান্ডে থেমেছে। কন্ডাকটর হেঁকে বলেছে, “দশ মিনিট – চা খেতে হলে, বাথরুম যেতে হলে… দশ মিনিট…”
সুবোধবাবুর আবার চা তেষ্টা পেল। বাস থেকে নেমে এলেন। চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে বসে বললেন, “চিনি ছাড়া চা হবে?”
সেই জীবনে প্রথম সুবোধবাবুর এক ফোনে কাজ হয়নি। এক ফোন কেন, শেষ পর্যন্ত অজস্র ফোন করেও কোনও সুরাহা হয়নি সমস্যার। পার্টির সকলেই তাই-তো, তাই-তো, কিন্তু-আপনার-কি-সত্যিই-অতটা-জমি-দরকার?-সুরে গান গাইতে লাগল, আর বিরোধীপক্ষেরা এমন একটা ভাব করতে লাগলেন যেন তাঁরা যে ভোটে হেরেছেন তার জন্য সুবোধবাবুই ব্যক্তিগতভাবে দায়ী, এই সমস্যা তিনি নিজের ওপর ডেকে এনেছেন – সুতরাং…
ভীষণ রেগে সুবোধবাবু গিয়েছিলেন থানায়। যত্ন করে বসিয়ে ওসি বলেছিলেন, “আরে চা খান, স্যার, এফ.আই.আর করাটা আবার একটা প্রব্লেম! আমি দরকার হলে বাড়িতে গিয়ে কমপ্লেন লিখিয়ে আনব। আপনার মত একজন থানায় পায়ের ধুলো দিলেন স্যার…”
সেদিন সন্ধেবেলাই বাড়ি এসে বলেছিলেন, “স্যার, একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না, এদের সঙ্গে লাগতে যাবেন না। এরা এখন পলিটিক্যাল পেট্রোনেজ পেয়েছে। ছেঁদো গুণ্ডামি আর করে না। এদের সামলান আমাদেরও কর্ম নয়। কাল দেখবেন এই পুঁটেই আপনার এম.এল.এ হয়েছে। আমার ছোট মুখে বড় কথা মানায় না… তবে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং করে নিন…”
উত্তরে সুবোধবাবু ফোন করেছিলেন ভায়রাকে। হাইকোর্টে বড়ো উকিল ভায়রা। ক্রিমিনাল লইয়ার। সব শুনে বলেছিল, “অবশ্যই কোর্টে অ্যাপিল করতে পারেন। পুলিশ কেস না নিলে কোর্টে অ্যাপিল করা যায়। তবে সে লড়াই করে কোনও লাভ হবে না, দাদা। মিটিয়ে নেওয়াই ভালো। কারণ পুলিশ নাহয় পুঁটেকে অ্যারেস্ট করল। পুঁটের সাঙ্গোপাঙ্গ? তারা তো তাণ্ডব শুরু করবে।”
“সিকিউরিটি বসাব,” হুঙ্কার দিয়েছিলেন সুবোধবাবু।
ওধার থেকে ভায়রা বলেছিলেন, “এখনই বসান বরং। সিকিউরিটি থাকলে এইসব ছেঁদো গুণ্ডারা বিশেষ ট্যাঁ-ফো করতে পারে না।”
“উঠুন, উঠুন… বাসে উঠুন,” কন্ডাকটরের ডাকে প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চা-টা খেয়ে নিয়ে ভাঁড়টা নোংরা ফেলার টিনে ফেলে দরজার কাছে বসা কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালেন। এবার চালাকি করে হাতে একটা এক-শূন্য, একটা পাঁচ-শূন্য আর একটা এক-শূন্য-শূন্য লেখা নোট ধরা। বাঁ-হাতে চাদরটা যেন জড়াতে জড়াতে হাতে ধরা নোটগুলো এগিয়ে দিলেন, ভাবখানা যেন, সবকটাই পকেট থেকে বেরিয়ে এসেছে, এক-হাত বলে আলাদা করতে পারছেন না।
একটা নোট নিয়ে কয়েকটা কয়েন দিল, সবটাই ফতুয়ার পকেটে ফেলে দিলেন। তারপরে বাসে উঠে বসলেন নিজের আসনে।
ধপাস করে যে লোকটা পাশে এসে বসল, তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে সুবোধবাবুর মনে হলো, এর উচিত হয়নি ওঁর পাশে বসা। কেন, বাসে আর জায়গা ছিল না? তেলচিটে গেঞ্জি আর লুঙ্গি – নোংরা শুধু নয়, রোগের ডিপোও।
কিছু বলার উপায় নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে বাসের ভেতরটা দেখে নিলেন। একেবারে খালি সিট নেই আর। যেখানেই যান, কারওর পাশে বসতেই হবে। ফলে ডানদিকের সহযাত্রীর দিক থেকে নজর সরিয়ে নিয়ে তাকালেন বাইরের দিকে। রোদ তেজি হয়েছে। কুয়াশা সরে গিয়ে শীতের মাঠে ছেয়ে রুক্ষতা। বাস চলেছে ফাঁকা মাঠের পাশ দিয়ে।
সিকিউরিটি রেখে কোনও লাভই হয়নি। ছ’মাসের মধ্যে কতগুলো সিকিউরিটি গার্ড পালিয়েছিল? মনে নেই। তারপরে ওই বিদেশি নামওয়ালা সিকিউরিটি কম্পানিও বলেছিল, ওদের দ্বারা হবে না। উনি এজেন্সি না খুঁজে নিজের লোকই যেন বহাল করেন।
সুকোমলই দরদাম ঠিক করে বাড়ি বিক্রি করেছিল। পুঁটেই কিনেছিল। সুবোধবাবুর মনে হয়েছিল গালে ঠাস করে চড় খেয়ে লেজ গুটিয়ে পালালেন… তাই প্রতাপগঞ্জ ছেড়েছিলেন রাত্তিরের অন্ধকারে। কাউকে কিছু না জানিয়েই।
ঝিমুনি আসছিল। তবে শহরের কাছাকাছি আসলে রাস্তা হাইওয়ের মতো মসৃণ থাকে না। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে চটকা ভেঙে গেল। একটা দুটো করে বাড়ি দেখা যাচ্ছে। গ্রাম্য বাড়ি নয়। ইঁটের তৈরি পাকা বাড়ি। কন্ডাকটরের দিকে তাকিয়ে জিগেস করলেন, “প্রতাপগঞ্জ?”
কন্ডাকটর টাকা গুনছিল। মুখ না তুলেই মাথা নাড়ল। বলল, “আর একটু দেরি আছে। বাস-স্ট্যান্ড যাবেন তো?”
কোথায় যাবেন? মনে পড়ল না। কোথায় যাবার জন্য বাসে উঠেছেন? কোথাও যাবার ছিল কি? কাজ ছিল কোনও? এই রে! ভুলে গেছেন। হঠাৎ কেমন অসহায় লাগল। ডাইনে বাঁয়ে তাকালেন। বিন্দু-বিন্দু ঘাম বেরিয়ে গেল কপালে – এই শীতের মধ্যেও।
কন্ডাকটর টাকা গোনা স্থগিত রেখে মুখ তুলে বলল, “কী হলো দাদু? কোথায় যাবেন, প্রতাপগঞ্জে?”
“বাস কোথায় যাবে?”
“বাস আবার কোথায় যাবে? স্ট্যান্ডে যাবে।”
সুবোধবাবু, “তাহলে আমিও স্ট্যান্ডেই যাব,” বলে তখনকার মতো অব্যাহতি পেলেন।
সকালের গঞ্জে ঢুকছে বাস। রাস্তাঘাটে লোকচলাচল অনেক। বাজার বসেছে পথের ধারে। প্রতাপগঞ্জ। বেশ বড়োই শহর।
বাসস্ট্যান্ডে নেমে সুবোধবাবুর আবার একটু ধাঁধা লাগল। কোনদিকে যাবেন? কী করবেন? কী করতে এসেছেন ছাতা সেটাই মনে পড়ছে না যে? কারওর সঙ্গে দেখা করার ছিল? কাজ ছিল কোনও?
কন্ডাকটর ছেলেটা সুবোধবাবুর হতভম্ব ভাবটা লক্ষ করেছে। এগিয়ে এসে জিগেস করল, “কোথায় যাবেন? রিকশ ডেকে দেব?”
রিকশ? না। সুবোধবাবুর বাড়ি এখান থেকে হেঁটে যাওয়া যায়। রিকশ লাগবে না। দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে সুবোধবাবু বাসস্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সকালের রাস্তায় লোকজনের ভীড় এড়িয়ে রাস্তায় পড়েই দেখলেন সামনে জয়ন্তর মিষ্টির দোকান। মনে পড়ল, সকাল থেকে খাওয়া হয়নি। পেটে চুঁই-চুঁই করছে। ডায়াবিটিস। যেখানে সেখানে যা খুশি খাওয়া যায় না। আবার এ-ও বলা আছে – বেশিক্ষণ খালিপেটে থাকা যাবে না। কোনটা বেশি ক্ষতিকারক? একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তা পেরিয়ে দোকানে গেলেন। জয়ন্ত ক্যাশে নেই। যে আছে সে কি জয়ন্তর ছেলে? না ভাই? কে জানে? বুঝতে পারলেন না। শেষে চুপচাপ ঢুকে বয়কে বললেন, কচুরি আর চা দিতে।
প্লেটে করে চারটে কচুরি আর খানিকটা ছোলার ডাল ফেলে দিয়ে গেল ছেলেটা তড়িঘড়ি করে। ঠক করে টেবিলে প্লেটটা পড়ে খানিকটা ছোলার ডাল চলকে পড়ল। যাই হোক, গরম। তেলতেলে কচুরি আর মিষ্টি দেওয়া ডাল, জিভে স্বাদ লাগে। কিন্তু বহুবছরের চিনি না-খাওয়ার অভ্যেস… ডালটা বেশি খেতে পারলেন না সুবোধবাবু।
এর মধ্যে ছোটো একটা কাচের গ্লাসে চা দিয়ে গেছে ছেলেটা। কচুরি শেষ করে, আধখাওয়া ডালটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চায়ে ফুঁ দিয়ে চুমুক দিলেন ফ-র্‌-র্‌-র্‌-র্‌ করে। এঃ-হে। বলা হয়নি। চায়ে চিনি ভর্তি। একবার ভাবলেন, ডেকে বলবেন, চিনি ছাড়া দিতে। তারপর কী মনে করে উঠে পড়লেন।
পকেটের নোট দুটো বের করে এনে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমার কত হয়েছে রে?”
সামনের রাখা একটা ঘণ্টা সজোরে ঠুং-ঠুং করতে করতে কাউন্টারের লোকটা চেঁচিয়ে বলল, “এই, এনাকে কে দিয়েছিস? কে দিয়েছিস?”
দোকানের পেছন থেকে বয়রা মাথা তুলে তাকাল। একজন মুখ তুলে বলল, “একপ্লেট কচুরি, একটা চা। বাইশ টাকা!”
কাউন্টারের লোকটা মুখ তুলে বলল, “বাইশ…” তারপরে মিনমিনে গলায় বলল, “টাকা…” তারপরে বলল, “আপনি?”
চিনেছে।
হেসে বললেন, “জয়ন্ত। না? চিনতে পেরেছ?”
জয়ন্তর মুখে একটু অবাক ভাব দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। বলল, “ইয়ে, না আমি তো জয়ন্ত…, ইয়ে, মানে…” তারপরে হাত থেকে একটা নোট টেনে নিয়ে খুচরো ফেরত দিল। তারপরে, সুবোধবাবু দোকান থেকে বেরোন’র আগেই, ড্রয়ার থেকে মোবাইল বের করে ফোন করতে শুরু করল।
সুবোধবাবু রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। জয়ন্তর দোকানটা একসময় ওঁরই ছিল। গোটা বাড়িটাই ছিল। এই বাজারে প্রায় সব বাড়িই একসময় ওঁর ঠাকুর্দার, বা বাবার বা ওঁর ছিল। অনেকগুলো এখনও আছে। ছেলে এখন দেখাশোনা করে। শুনেছেন মায়ের সঙ্গে মিলে বিক্কিরিও করছে। মাঝে মাঝে একটা কাগজ ধরে দিয়ে রাখী বলে, “এখানে সই করো তো… সাবধানে করবে, মেলে যেন…” সুবোধবাবু বোঝেন, এগুলো সবই জমি বা বাড়ি বিক্রির জন্য। আগে জিজ্ঞেস করতেন। এখন আর করেন না। সই করে ছেড়ে দেন।
জয়ন্তর দোকান কি এখনও আছে ওঁর, না কি ছেলে বিক্কিরি করে দিয়েছে? কে জানে। মনে পড়ে না। কিন্তু দোকানের কী যেন একটা বিষয় ছিল? কী ছিল? মনে নেই।
রাস্তায় নেমে একটু যেতে না যেতেই বিদ্যুৎচমকের মতো মনে পড়ে গেল। জয়ন্ত নেই। জয়ন্ত মারা গিয়েছে। জয়ন্ত সুইসাইড করেছিল। কেন? মনে পড়ে না। কী যেন একটা। কী যেন…
কোথা দিয়ে কোথায় চলেছেন ঠিক জানেন না। সামনে একটা বন্ধ দোকানের গায়ে কাগজে লেখা – ‘দোকান ভাড়া দেওয়া হইবে’।
মনে পড়েছে। দোকানের ভাড়া নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। প্রায় বারো বছর একই ভাড়ায় চলার পরে সুবোধবাবু ভাড়া বাড়িয়েছিলেন। অনেকেই বলেছিল, এত দেরি করে করে ভাড়া বাড়ালে ভাড়েটেরা পেয়ে বসে। এত লাই দেবেন না। কই, আপনি ভাড়া বাড়াচ্ছেন না বলে ওর দোকানে খাবার কি এক পয়সাও সস্তা? সুবোধবাবু শোনেননি। বলেছিলেন, বাপ-মরা ছেলেটা কোনও রকমে ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছে। এখন একটু সুখের মুখ দেখুক। কিন্তু লোকের কথাই ঠিক হয়ে দাঁড়াল। ভাড়া আর কতটুকু বেড়েছিল? সুবোধবাবুর খবর ছিল জয়ন্তর ব্যবসা কেমন চলে। তাও সামান্যই বাড়িয়েছিলেন। তাতেই জয়ন্তর রূপ দেখা গেছিল। পারব না, মাপ করে দিন, সংসার চলবে না, না খেতে পেয়ে মরে যাব… আরও কত কী! তারপরে সুবোধবাবু যত বাড়াতে বলেছিলেন, লোককে ডেকে ডেকে বলেছিল সুবোধমেসো তার ডবল, তিনগুণ, চারগুণ চেয়েছে। প্রথম দিকে লোকে অবাক হয়েছিল। কেউ কেউ ওনাকে কসাই, চামার এসবও বলেছিল। পরে অবশ্য বুঝেছিল জয়ন্ত মিথ্যে বলেছে। কারওর কাছেই সুবোধবাবু অন্যায় ভাড়া কখনও চাননি।
তবে জয়ন্তর আত্মহত্যার নোটে সুবোধবাবুর নামটা থাকায় লোকে আবার থমকেছিল। পুলিশি ঝামেলা হয়নি, তবে জয়ন্তর ভাই সুবল দোকানের মালিক হয়ে সুবোধবাবুর নামে আরও অনেক কুৎসা রটিয়েছিল।
পরের দিকে সুবলও গিয়ে জুটেছিল পুঁটের দলে। সুবোধবাবু থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মনে পড়ল যে দলবল নিয়ে পুঁটে ঘরে ঢুকে চারটে টেবিল ভেঙেছিল, তার মধ্যে সুবলও ছিল।
তারই দোকানে ঢুকে কচুরি-চা খেয়ে এসেছেন! ঠাণ্ডা একটা ঘামে সর্বাঙ্গ ভিজে গেল সুবোধবাবুর।
সামনে একটা চৌমাথা। এই চৌমাথাটা কোনও দিন দেখেছেন? বাড়ি ফিরতে হবে। একটু আগে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন। ফেরার রাস্তাটা আর পাচ্ছেন না। রাখী এতক্ষণে উঠে চায়ের জল বসিয়েছে নিশ্চয়ই। এবার ডাকতে আসবে। এসে দেখবে সুবোধবাবু বিছানায় নেই। খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে? ছেলেকে ফোন করেছে? রাখীকে একবার ফোন করতে হবে। ফতুয়ার পকেটে ফোন আছে…
ফতুয়ার পকেটে হাত দিলেন। ফোন নেই। একটা গেঁজে আছে। টাকা ভর্তি। কত টাকা? গুনতে পারবেন না। আজকাল আর টাকা চিনতে পারেন না। নম্বর দেখতে পারেন, কত নম্বরের পরে কত বসলে কী সংখ্যা হয়, অনেক সময়ে মাথা আসে না।
রাস্তার বাঁ দিকে একটা মস্ত পুকুর। দীঘি। ডানদিকে একটা এস্টেটের নিচু পাঁচিল। পাঁচিল না। রেলিং। ঠাকুর্দা আনিয়েছিলেন প্যারিস থেকে। বছর বছর তার মেন্টেনেনসে খরচ প্রচুর।
এই তো গেট। বাড়ি এসে গেছেন। ছোটোবেলার বাড়ি চিনতে পারবেন না কেন ভেবেছিলেন? কিন্তু, গেট বন্ধ কেন? গেট তো বন্ধ থাকে না। তবে তালা নেই। ঠেলে ঢুকলেন সুবোধবাবু। কী মনে হল, গেটটা খুলে দিলেন হাট করে। এমনই থাকার কথা। গেট বন্ধ হবে কেবল রাতে। বাগানটা যত্ন পেয়েছে, কিন্তু ফুল নেই। কেন? এতদিনে তো শীতের ফুলের বাগান শুরু হবার কথা? মালি কি আসছে না? সুবোধবাবুর মনে পড়ল না। কাল এসেছিল? পরশু? গাড়ি বারান্দার দু-দিকের গাছগুলোতে রং লাগান’ কেন? সুবোধবাবুর মনে পড়ছে না উনি কাউকে বলেছিলেন। ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আজকাল কিছুই মনে থাকছ না… সেটা ভালো কথা নয়। নিমগাছটার নিচে দাঁড়ালেন। অনেক কচি পাতা এসেছে তো… মালির সাকরেদ ছেলেটাকে বলতে হবে পাড়তে। কী যেন নাম ছেলেটার?
গাড়ি বারান্দার নিচে ইউনিফর্ম পরা দারোয়ান। সুবোধবাবুকে দেখে এগিয়ে আসছে। সুবোধবাবু বললেন, “গেট কেন বন্ধ করে রেখেছ? সকাল হলে গেট খুলে দেবে, বুঝেছ?”
লোকটা বলল, “আপনি কাকে চান?”
নতুন নাকি? বললেন, “আমি ভেতরে যাব। কাউকে চাই না। আমারই বাড়ি। তুমি কতদিন হল এসেছ?”
লোকটা দু হাত তুলে সুবোধবাবুকে আটকানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু সুবোধবাবু থামছেন না, তাই পেছু হটছে। পেছু হটতে হটতে বলছে, “বাবু, ভেতরে যাওয়া মানা আছে। রিসর্ট এখন বন্ধ। রেনোভেশন হচ্ছে। মালিক আছেন ভেতরে।”
মালিক! এটা কি পাগল, না মাতাল?
গম্ভীর গলায় বললেন, “এটা আমার বাড়ি। আমি মালিক। কে মালিক ভেতরে আছে! কত বড়ো সাহস! ডাকো তাকে…”
“শচীন?” ভেতর থেকে কে বেরিয়ে এসেছে। “কার সঙ্গে কথা বলছ? কে উনি?”
চোয়াড়ে চেহারার লোক একটা। রাগে ফেটে পড়লেন সুবোধবাবু। বাজপড়া গলায় বললেন, “এই, কে তুমি? এখানে কী করছ? বেরিয়ে যাও, এক্ষুনি বেরিয়ে যাও…”
এবারে বেরিয়ে এল আর একটা লোক। একে একটু চেনা লাগল সুবোধবাবুর। কাজের লোক হবে বোধহয়। বললেন, “তোমার যেন কী নাম? এরা কারা?”
চোয়াড়ে চেহারার লোকটা বলল, “পুঁটেদা, কে এ? তুমি চেন?”
পুঁটে। নামটা চেনা চেনা। মুখটাও। বললেন, “পুঁটে, তুমি এই সব আজেবাজে লোককে বিদায় করো। আমি খাবার ঘরে যাচ্ছি। তুমি মাসিমাকে বলো আমি মর্নিং ওয়াক করে ফিরে এসেছি। রান্নাঘরে খবর দাও আমার ব্রেকফাস্ট দেবে। আজ দুটো ডিমসেদ্ধ খাব।”
পুঁটে এগিয়ে এসেছে কেন? এ কী! হাত তুলে সুবোধবাবুর থুৎনি ধরে বাচ্চাদের আদর করার ভঙ্গিতে বলছে, “ফিরে এলে চাঁদু? ভুলে গেলে, বলেছিলাম আবার প্রতাপগঞ্জে পা দিলে তুমি ফিরবে না… ফিরবে তোমার লাশ? তাও এসেছ? সুবলের দোকানে কচুরি খেয়ে ওকেই জয়ন্ত বলে ডেকেছ? ডিম খাবে? এসো, বাবা, ডিম খাওয়াই তোমাকে…”
এতবড়ো আস্পর্ধা! জীবনে যা করেননি সুবোধবাবু, হাত তুলে লোকটার গালে মারলেন সাঁটিয়ে এক চড়।
লোকটা গালে হাত দিয়ে এক লহমার জন্য থমকে দাঁড়িয়ে রইল। তার মধ্যে সুবোধবাবু ঘুরেছেন খাবার ঘরের দিকে। গলা তুলে বলেছেন, “এই, কে আছিস, এই দু-জনকে এখনই বের করে দে। বের করে দে বাড়ি থেকে। আর ম্যানেজার কোথায়? খবর দে ম্যানেজারকে। বল…”
কথা শেষ হল না। পেছন থেকে পুঁটে নামে লোকটা চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে প্রায় মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু পড়ার আগেই আবার এক ধাক্কা দিল। টাল সামলাতে না পেরে সুবোধবাবু ছিটকে গিয়ে পড়লেন দেওয়ালে। সজোরে মাথা ঠুকে চারিদিক অন্ধকার হবার ঠিক আগে মনে পড়ল – পুঁটে কে। কেনই বা সে ওঁর বাড়িতে রয়েছে…
সুবোধবাবুর বাড়িতে রাখী সুকোমলের সঙ্গে কথা বলে ফোন নামিয়ে রাখলেন। কাজের লোক, পাড়ার যে ক-জন চেনা আছে, সবাই আশেপাশের রাস্তা, মায় বাজার অবধি খোঁজ করে ফিরেছে। কোত্থাও নেই। সুকোমল রওয়ানা হয়েছে। দুপুরের মধ্যে এসে পড়বে। সুকোমলের সঙ্গে এখানকার পুলিশের কথা হয়েছে। থানার ওসি বলেছেন লোক পাঠাবেন। সেই সঙ্গে হুলিয়া জানাবেন। বয়স্ক মানুষ। সাদা পাজামা আর ঘিয়ে রঙের ফতুয়া, আর নস্যি রঙের গরম র‍্যাপার… পাকা চুল, দাড়ি গোঁফ কামানো, পায়ে চামড়ার স্ট্র্যাপ দেওয়া চটি।
স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, ফলে নাম-ধাম, আত্মীয়স্বজনের নাম না-ও বলতে পারেন।
ঘড়ি দেখলেন। সমীরণের ওখানে এখন প্রায় রাত্তির তিনটে। এখনই ফোন করে কাজ নেই। পরেই করবেন।
খাবার টেবিলে কাজের মেয়ে দু-কাপ চা রেখেছে। ওদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বাইরের ঘরে সোফার দিকে গেলেন।
“মাসিমা, আপনি একটু চা আর দুটো পাউরুটি খেয়ে নেন,” কাজের মেয়ে হাতে চায়ের কাপ-ডিস নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। “বাবু ঠিক ফিরে আসবেন। অত চিন্তা করবেন না। নিন।”
সোফায় বসে হাত পেতে চায়ের কাপটা নিয়ে রাখী পাশের টিপাইতে নামিয়ে রাখলেন। বললেন, “আগে একটু জল দে…”
সুবোধবাবুর বাড়িতে পেছনের ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল পুঁটে আর চোয়াড়ে চেহারার লোকটা। লোকটা ধরা গলায় বলল, “পুঁটেদা, এবার?”
পুঁটে গলাটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। বলল, “কিছুই না। ঘরের দরজায় তালা মেরেছি। মিস্তিরিরা এদিকে আজ আসবে না। তুই সারাদিনে বাগানের ওই পেছনে – যেখানে নারকেলগাছগুলো, সেখানে গর্ত করে রাখ। অন্ধকার হলে তুই-আমি বুড়োর বডিটা ধরাধরি করে ফেলে দেব। তারপরে বুজিয়ে দিলেই হবে। গভীর গর্ত করবি কিন্তু। কুকুরে খুঁড়ে বের করলে কিন্তু কেউ আমাদের বাঁচাতে পারবে না।”
বাইরের গাড়ি-বারান্দায় প্রহরারত দারোয়ানের দিকে দেখিয়ে বলল, “ওকে আমি ওপরে আমার অফিসে ডিউটি দিচ্ছি আজ। ওখানেই রাখব সন্ধে অবধি। রামুকে খবর দিস – বলবি, কাজ আছে। আজ ব্যাটা যখন বাড়ি ফিরবে, কথায় কথায় টেনে নিয়ে নদীর ধারে গিয়ে গলা কেটে, পায়ে পাথর বেঁধে জলে ফেলে দিলেই চলবে।”
পুঁটে সিঁড়ির দিকে ফিরল। তারপরে বলল, “ও, হ্যাঁ। কাল থেকে ওই নারকেল বাগানে ভোরে আর সন্ধেয় ভালো করে জল দিবি। ঘাস গজায় যেন।”
২৮/৫/২০১৭
PrevPreviousঅতিমারিতে অনাথ ১৯ লাখ শিশু! এই অন্ধকারের দায় কার?
Nextদেশের সমস্ত রাজ্যে সরকারি বা বেসরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের নেতৃত্বে থাকা উচিত চিকিৎসকদের।Next
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত পোস্ট

আত্মহত্যা কি কথা বলে আটকানো যায়?

August 5, 2022 No Comments

হয়তো যায়, কিন্তু আপনি শুনবেন কি ? জানেন হিসেব বলছে প্রত্যেকটা না হলেও বেশিরভাগ মানুষ আত্মহত্যার চরম সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কাউকে একবার কথাটা বলে ,হয়তো

২০২২ হল আমার আবির্ভাব শতবর্ষ।

August 5, 2022 No Comments

২০২২ হল আমার আবির্ভাব শতবর্ষ। ১৯২২এ আমার অস্তিত্ব প্রথম টের পেয়েছিলেন Wiernal & Bell. তবে মানুষের শরীরে আমার প্রথম ঢুকবার সুযোগ পেতে ১৯৪৯ অবধি অপেক্ষা

বুদবুদ-৩

August 5, 2022 No Comments

চারিদিকে আকাশ থেকে নেমে আসছে টাকা… কালো মেঘ, সাদা আকাশ, পাখির মত টাকা। সাদা পায়রার মত টাকা। একটা কুহকী ডাক ঘনিয়ে আসছে, অরিন্দম! অরিন্দম! যার

সে স্মৃতির রেশ সারাজীবন রয়ে যাবে।

August 4, 2022 No Comments

আমার এমবিবিএস পড়া বাঁকুড়ায়। বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিকেল কলেজে। রামকৃষ্ণ মিশনের হস্টেল জীবনের পর সে এক অন্য ধরনের আবাসিক জীবন। কড়া শাসনের ফাঁক গলে ফাঁকি দেওয়ার

বুদবুদ (২)

August 4, 2022 No Comments

একজন লেখক হিসেবে আমাকে সবসময় সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। আমার লেখা পড়ে অনেকেই বলেছেন, সংলাপগুলো হয় অকারণ দীর্ঘ, নয়ত সেগুলো নিষ্প্রাণ বা ছদ্মবেশী-

সাম্প্রতিক পোস্ট

আত্মহত্যা কি কথা বলে আটকানো যায়?

Dr. Arunima Ghosh August 5, 2022

২০২২ হল আমার আবির্ভাব শতবর্ষ।

Dr. Belal Hossain August 5, 2022

বুদবুদ-৩

Dr. Hrishikesh Bagchi August 5, 2022

সে স্মৃতির রেশ সারাজীবন রয়ে যাবে।

Dr. Bishan Basu August 4, 2022

বুদবুদ (২)

Dr. Hrishikesh Bagchi August 4, 2022

An Initiative of Swasthyer Britto society

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।

Contact Us

Editorial Committee:
Dr. Punyabrata Gun
Dr. Jayanta Das
Dr. Chinmay Nath
Dr. Indranil Saha
Dr. Aindril Bhowmik
Executive Editor: Piyali Dey Biswas

Address: 

Shramajibi Swasthya Udyog
HA 44, Salt Lake, Sector-3, Kolkata-700097

Leave an audio message

নীচে Justori র মাধ্যমে আমাদের সদস্য হন  – নিজে বলুন আপনার প্রশ্ন, মতামত – সরাসরি উত্তর পান ডাক্তারের কাছ থেকে

Total Visitor

403052
Share on facebook
Share on google
Share on twitter
Share on linkedin

Copyright © 2019 by Doctors’ Dialogue

wpDiscuz

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।