এই তো সেদিনের কথা। তখন লক-ডাউন পর্ব ২.০। করোনা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা দেশবাসী মে মাসের প্রথম রবিবারের সকালে এক নতুন অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলেন; দেখলেন বায়ুসেনা দেশের ২৩টি কোভিড হাসপাতালের উপর পুষ্পবৃষ্টি করছে। আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে ফুলের পাপড়ি। যুদ্ধবিমান শুখোই-৩০এস, মিগ-২৯ এবং জাগুয়ার আকাশ থেকে কুর্নিশ জানাচ্ছে চিকিৎসকদের। চারিদিকে যেন হই হই রব। সেদিন এক সেনাবাহিনী সম্মান জানিয়েছিল দেশের আরেক সেনাবাহিনীকে। হ্যাঁ সেনাবাহিনীই বলা যায়। কেননা যুদ্ধসম অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রধান সৈনিক হলেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা, যারা কোভিড-১৯ আক্রান্তদের সারিয়ে তুলতে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন লড়াইয়ে। একের পর এক ডাক্তার করোনা আক্রান্ত হয়ে কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন; মারাও গেছেন অনেকে। তবে তাঁরা লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরে দাঁড়ান নি।
ভাবছেন, করোনাকালে মানুষ সংকটে পড়েছে বলে চিকিৎসকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে? সেটা ভাবার কোনও কারণ নেই। ইতিহাস বলে, প্রাচীন কাল থেকেই চিকিৎসকেরা সমাজে এক বিশেষ সম্মান পেয়ে আসছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসকদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেই বছরের কোনও এক দিনকে চিকিৎসক দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। যেমন আমাদের দেশ বেছে নিয়েছে ১ জুলাই তারিখটিকে। এই দিনটি কিংবদন্তি চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম ও মৃত্যু দিন। ‘সিনেমাটিক’ পুষ্পবৃষ্টি দিয়ে যে লেখার শুরু সেই লেখার বিষয় বাংলা সিনেমায় চিকিৎসক। আজ করোনা সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে চলুন দেখে নেওয়া যাক সেরকমই কয়েকটা সিনেমা।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের ভিত্তিতে ‘আরোগ্য নিকেতন’ সিনেমা তৈরি হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। এই সিনেমা আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে পুরোন চিকিৎসাপদ্ধতির সংঘাতের চিত্র যেমন তুলে ধরেছে তেমনই চিকিৎসক ও রোগীর আত্মীয়তার সম্পর্ককেও উপস্থাপন করেছে। জীবনমশাই আর প্রদ্যোত ডাক্তারের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলেও একটা বিষয়ে তাঁদের মিল ছিল। তা হ’ল দু’জনেই ছিলেন আদর্শ চিকিৎসক; প্রাণপাত করে তাঁরা তাঁদের কর্তব্য পালন করতেন এবং রোগীকে মরণের দরজা থেকে ফিরিয়ে আনতেন। তিন পুরুষের কবিরাজ জীবনমশাই অর্থাৎ জীবন সেনের বক্তব্য ছিল “আমাদের কর্তব্য রোগীর সেবা করা। আর রোগীর ধর্ম তাঁদের নিজের কাছে।” মশাইয়ের প্রতি নবগ্রামের মানুষের ছিল অগাধ বিশ্বাস। প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রে, চরক ও সুশ্রুত সংহিতায় চিকিৎসক ও রোগী উভয়কেই পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রাখার কথা বলা হয়েছে। নবগ্রামে মশাই বংশের ‘আরোগ্য নিকেতন’ (কবিরাজ খানা) ছিল প্রায় একশো বছরের একমাত্র হেলথ সেন্টার। মশাইরা বিনামূল্যে সাধারণ মানুষের ঘরে চিকিৎসা করতেন। জীবনমশাই বলতেন “আরোগ্য নিকেতনে বসে রোগী দেখে দর্শনী নেওয়া আমাদের নিষেধ আছে।” তাঁর মতে, চিকিৎসকের একটা সামাজিক দায়িত্ব আছে। সমাজের বহুজন চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করে। যদি সে তার দায়িত্ব পালন না করতে পারে তাহলে সে অপরাধী। যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলে মনে করা হয় সেই হিপোক্রেটিসও বলেছিলেন রোগ, রোগী ও চিকিৎসক হল চিকিৎসাবিদ্যার তিনটি অংশ। চিকিৎসক হলেন চিকিৎসাবিদ্যার সেবক। অন্যদিকে আধুনিক চিকিৎসার প্রতিনিধি প্রদ্যোত ডাক্তারের কাছেও রোগীর কল্যাণই ছিল মুখ্য। আর তাই মেধাবী ছাত্র হয়েও তিনি শহরে প্র্যাকটিস না করে কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নবগ্রাম চ্যারিটেবল হসপিটালকে।
আরেক চিকিৎসক অগ্নীশ্বর মুখুজ্জেও বিশ্বাস করতেন চিকিৎসকের প্রধান ধর্ম হওয়া উচিত সেবা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল রোগী ছিলেন তাঁর কাছে সমান। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘অগ্নীশ্বর’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালে, যে সিনেমা একজন সদ্য পাশ করা চিকিৎসককে তার দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন করেছিল। ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজ থেকে রেকর্ড নম্বর পেয়ে প্রথম স্থানের অধিকারী অগ্নীশ্বর বিহারের রেলওয়ে হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দৃঢ় চরিত্রের মানুষ। বেপরোয়া লোকেদের কীভাবে জব্দ করতে হয় তিনি তা ভালোভাবে জানতেন। কিন্তু রোগীদের প্রতি তিনি ছিলেন সহৃদয়। তিনি কারুর কোনও উপকার করলে সেই বিষয় কাউকে জানতে দিতেন না। বুকিং ক্লার্কের ছেলের চিকিৎসার জন্য কড়কড়ে ষোল টাকা ফিস নিলেও সেই টাকা তিনি সচেতনভাবেই রোগীর বিছানার পাশে ফেলে এসেছিলেন। এটা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বিশেষত্ব। অগ্নীশ্বর বুঝেছিলেন যক্ষ্মা রোগ মূলত হয় পুষ্টির অভাবে ভোগা গরীবদের। হাসপাতালের স্টোরবাবুর স্ত্রী সরলার যক্ষ্মা হলে তাঁর পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন ডাক্তারবাবু। স্টোরবাবুকে অগ্নীশ্বর বলেছিলেন “পয়সার জন্য আপনার কিছু ভাবতে হবে না, ও ভারটা আমার।” তিনি নিঃশব্দে নিম্নবিত্ত দেহাতি মানুষগুলোর সেবা করেছিলেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেবার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন নি।
আদর্শবান চিকিৎসক ছিলেন ‘সপ্তপদী’র (১৯৬১) কৃষ্ণেন্দু মুখার্জি অর্থাৎ রেভারেন্ড কৃষ্ণস্বামী, যিনি বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের একটি ছোট্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চালাতেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকার জনস্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বাবা সাহেব ডাক্তারবাবু; গরিব মানুষের কাছে সাক্ষাত দেবতা। উত্তমকুমার অভিনীত ‘আনন্দ আশ্রম’ও (১৯৭৭) ছিল এই ঘরানার সিনেমা।
১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হাটে বাজারে’-র নায়ক ডাঃ মুখার্জি বুঝেছিলেন আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের সম্পর্ক। তিনি ছিলেন হাসপাতালের সিভিল সার্জেন। তবে সে-ডাক্তার শুধু হাসপাতালে রোগী দেখতেন না; হাটে-মাঠে, বস্তিতে মানুষের সেবা করতেন। গরীব কিংবা ধনী বাছবিচার না করে কল এলেই ছুটে যেতেন রোগীর কাছে। তিনি ছিলেন খেটে খাওয়া নিম্নবর্গের মানুষের কাছের মানুষ, তাদের অভিভাবক। আর তাই স্বামীহারা ছিপলির ভাইকে মিথ্যা অভিযোগে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে তাঁকে ছাড়াতে ছুটে গিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর ডাক্তারবাবু সাধারণ মানুষের সঙ্গে আরও বেশি করে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেন গরিব মানুষগুলোর চিকিৎসার জন্য। হয়ে ওঠেন ভ্রাম্যমান চিকিৎসক। ইতিহাসে মেলে এরকম বাজার চিকিৎসকের সন্ধান। মানুচির ‘স্টোরিয়া দো মোগর’ বা বদায়ুনীর ‘মুন্তাখাব-উত তওয়ারিখ’ থেকে মুঘল যুগে এক ধরণের ‘বাজার’ চিকিৎসকের কথা জানা যায়, যাঁরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন। স্বাস্থ্য সমাচার পত্রিকার সম্পাদক কার্তিকচন্দ্র বসুও বাজার ডক্টর ছিলেন, যিনি আমৃত্যু অল্প ফী’তে গরিব মানুষের চিকিৎসা করতেন।
সত্যজিৎ রায়ও চিকিৎসকের লড়াইকে স্যালুট জানিয়েছিলেন। ইবসেনের ‘এনিমি অব দ্য পিপল’ নাটক থেকে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ‘গণশত্রু’(১৯৯০)-তে উঠে এসেছিল ডাক্তারের জনস্বাস্থ্যভাবনা। সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায়ের ‘উত্তরণ’ (১৯৯৪) সিনেমার ডাক্তার উপলব্ধি করেছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি হলেও গরিবরা তা থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবেন। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি নিয়ে লেখা তাঁর প্রবন্ধ তিনি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন।
সমাজ বদলেছে, ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক বদলেছে। তার সঙ্গে চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তুতেও বদল এসেছে। নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখার্জীর পরিচালনায় ২০১৩ সালে মুক্তি পায় ‘অলীক সুখ’। সে সিনেমায় ডাঃ কিংশুক গুহ একজন নামকরা গাইনোকলজিস্ট সার্জেন। কিন্তু তিনি চিকিৎসাব্যবসায়ী। বিশ্বায়নসৃষ্ট ভোগবাদ তাঁকে গ্রাস করেছে। তবে তার পাশেই হাজির কিংশুকের শিক্ষক অম্বরীশ রায়, সেবাপরায়ণ এক চিকিৎসক। এখন এক শ্রেণির চিকিৎসককে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির জন্য দোষারোপ করা হলেও বাংলা সিনেমার ডাক্তাররা যেন অন্যকরম, চোখ বন্ধ করে তাঁদের ভরসা করা যায়। তাঁদের ভাল না বেসে পারাই যায় না!