ডাক্তার দিবস উপলক্ষে আমার কিছু লেখার আছে কি?
না, নেই।
কারণ, ডাক্তার দিবসে আমার লেখার সময়ই যখন নেই, তখন হাজার হাজার রোগীর মধ্যে কোন একজনের গল্প আমি লিখবো না। অন্ততঃ আজ তো নয়ই!
তারপর ভাবলাম, এই ডাক্তার দিবস ব্যাপারটা কি? খায় না মাথায় দেয়?
কিছু কি লেখা যায়?
মানে আজকের দিনে বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম এবং মৃত্যুদিনে, ডাক্তার দিবস বলে যে একটি নির্ভেজাল ছুটি ডাক্তারদের বাদ দিয়ে বাকি সবাইকে দিয়ে দেয়া হলো, সেইসব ছুটিখোর বাঙালির মধ্যে একজন ও, (হ্যাঁ একজন!) জানেন যে, আজ ডাক্তারি দিবস? কার জন্ম এবং মৃত্যুদিন? কেন ই বা এই দিবস পালন করা হবে?? কিসের জন্য?
জানেন না! গ্যারান্টি সহকারে বলা যায়, জানেন না!
অতএব তাঁদের জন্য একটি মহার্ঘ্য ছুটি, তাও লকডাউনের বাজারে, নিশ্চিত এক মহাপার্বণের ঘোষণার মতই।
অথচ এই মহাজ্ঞানীরা কেঁদে কেঁদে প্রায় পাগলপারা হয়ে যেতে পারে নানা বিষয় নিয়ে!
যেমন ধরা যাক, কোন ডাক্তার রক্ত বা বুকের পরীক্ষা করাতে বললো।
হয়তো ডায়াগনসিস হলো, হয়তো হলো না। হয়তো রোগ সারলো, হয়তো সারলো না!
তখন কিন্ত এনারা জানেন- বিধানচন্দ্র রায় কাশি শুনেই অসুখ বুঝতে পারতেন! তমুকে পায়খানা প্রস্রাব চোখ জিভ দেখেই, পেট টিপেই সব বুঝতে পারতেন।
আহা রে! সেই ভগবান ডাক্তার এখন কই আর? সব ক’টা তো ব্যবসায়ী! খালি পরীক্ষা আর পরীক্ষা!
মনে পড়ে, মেডিকেল এ পড়ার প্রাথমিক দিনগুলোর কথা।
মনে পড়ে- সকাল সন্ধ্যা ওয়ার্ডে অজানা অচেনা রোগীর বিছানার পাশে বসে রোগের symptom /sign শেখার দিনগুলোর কথা।
হ্যাঁ এর সব ক’টাই আমরা শিখতাম। খুকখুক কাশি, জোরে জোরে কাশি, কাশির শব্দে র সাথে কফ আসলে তার ধরণ, গন্ধ আছে কিনা, একটানা কাশি, রাতে কাশি- এরকম হরেক রকম বিষয় শিখতে হতো।
তার সাথে রক্ত আসে কিনা, আসলে সে রক্ত তাজা না পুরানো- এমন হাজারো বিষয় শিখতাম আমরা। হ্যাঁ আমরাও শিখেছি!
তার সাথে রিলেটেড অসুখের কথা পড়তাম। মানে ক্লিনিক্যালি অসুখের ডায়াগনসিস করতাম।
শুধু কাশি কেন, সব ধরনের উপসর্গ নিয়েই আমাদের এমন পড়তো হতো।
দাঁড়ান, এখনো পড়তে হয়!!
হ্যাঁ সবকিছুই পড়তে হয়, শিখতে হয়। কোন রকম কারচুপির জায়গা সেখানে নেই!
অমুক ডাক্তার হাতের শিরা (হাতের শিরা ধরার এই ম্যাজিক আমিও বহুবার চেষ্টা করেছি। সত্যি বলতে , শিরা ধরা যায় না। শিরা এতোটাই নড়বড়ে এবং চরিত্রহীন বা চরিত্রহীনা যে কোনভাবেই ধরা যায় না! বড়জোড় চোখে দেখা যায়। আর যেটা পাওয়া যায়, বোঝা যায়, কয়েকটি অসুখ বা অসুখের সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা মাত্র!) ধরেই মারণ রোগের হদিস পেয়ে যেতেন, এই গল্পের একটা আলাদা, বিরাট অশিক্ষিত ফ্যানবেস আছে আমাদের সমাজে।
অথচ মনে পড়ে, এই হাতের শিরা ধরার নাম করে রেডিয়াল আর্টারি তে পালস দেখতে শেখার জন্য দিনের পর দিন আমরা কি না কি করেছি!!
বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পালস দেখতে শিখেছি, তার নানা রকমফের বুঝতে শিখেছি, নানান অসুখের প্রায় সঠিক ডায়াগনসিসও করেছি। ভুলও করেছি!
এবং মেডিকেল সায়েন্সের ইতিহাস বলে- আগেকার সেই শিরা ধরে পেটের টিউমার বোঝা যায়- এই গল্প সমাজে যেমন মিথের মত, আসলে ঠিক তা নয়! চিকিৎসার একটি প্রাথমিক কাজ মাত্র। হ্যাঁ, কোনভাবেই সেইসব দিনের বেসিক ডাক্তারির বিষয় আজকের দিনে ডাক্তারির সব কিছু নয়! বিজ্ঞান কোথায় গেছে, তার খবর যাঁরা রাখেন না, তাঁরা ওসব গল্পেই থাকেন।
যাঁরা জানেন না বোঝেন না, তাঁদের গল্প শুনে যত সহজে চা এর দোকানে বুদ্ধিজীবী হওয়া যায়, ঠিক ততটা সহজ নয় আধুনিক চিকিৎসা!
অথচ আজ আর কেউ বলে না- এই ডাক্তার হাতের শিরা ধরেই …. !
হ্যাঁ কেউ কেউ এখনো অবশ্য বিকল্পে বিশ্বাস করেন। নানারকম অবৈজ্ঞানিক মহৌষধিতে বিশ্বাস করেন।
এবং সেই হাতের শিরা ধরে সব করা যায়- এই বিশ্বাস থেকেই জলপড়া তেলপড়া কবজ মাদুলি চিনির দানার গ্যারান্টি সহকারে চিকিৎসায় ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’ বলে ঝুঁকে পড়েন।
তারপর কি পান আর কি পান না, সেই হিসেব ঘোলাটে বলে ফের শিরা ধরার ভগবান খোঁজেন!
আর শেষ অব্দি এসে পড়েন আধুনিক চিকিৎসার কাছে। যদিও তখন অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায় রোগীর, তাতে কার কি এসে যায়?
অন্য কারো তো কোথাও জবাব দেয়ার নেই! যত জবাব দেয়ার কাজ আধুনিক চিকিৎসকের, শাস্তির খাঁড়াও অতএব তাঁর গলায় পড়বে স্বাভাবিকভাবেই!
সে যাকগে। তাও আসেন! এটাই বা কম কিসের?
হ্যাঁ, তার কারণ অবশ্যই চিকিৎসা যেনতেন প্রকারে বিনামূল্যে বা কমমূল্যে পাওয়া!
এবার এই বাজারমূল্য, যেটা নির্ধারণ করা কখনোই ডাক্তারের হাতে নেই, তাঁর জন্য ডাক্তারকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়!
নানারকম অনাচার অত্যাচার সহ্য করে সে বেচারা ডাক্তারও নিজেকে ঢুকিয়ে নেয় ব্যবসায়ীর খোলসে।
কোন ডাক্তার ফিজ নিলেই মিছিল নামাতে পারে, রেগে গিয়ে ভাঙচুর এবং ডাক্তারকে উত্তম-মধ্যম দিতে পারেন, মহানন্দবাজারের খবর দেখে যেখানে যা খুশি ঢুকিয়ে দিতে পারেন, সেই সমাজ এই ডাক্তার দিবসে করবেনটা কি?
ছুটির দিনে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলবেন, সিনেমা দেখবেন, মস্তি করবেন, ভুঁড়ি বানাবেন, ঘরে বসে যার তার শ্রাদ্ধ করবেন, তারপর তলপেট হালকা করে ঘুমিয়ে পড়বেন!
এনাদের কাছে তাই শ্রদ্ধাঞ্জলি পাওয়ার আশা করা বৃথা। এবং বলে রাখা ভালো, ডাক্তাররা সে আশা করেনও না!
অতএব, ডাক্তার দিবসেও ডাক্তার অবশ্যই দিনরাত গাধার মত কাজ করবে। বাকি দিবসে গাধার ডাবল ডিউটি যেন তাতে না কমে কোনমতেই!
আর ডাক্তাররা? তাঁরা জানেন?
মনে হয় না!
কেননা, এখনকার ডাক্তারদের কাছে ডাক্তার দিবস মানে বিধানচন্দ্র রায়ের ছবিতে একটু নেতা গোছের কারো ফুল মাল্যদান অনুষ্ঠানের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে দলের প্রতি (মতান্তরে বলীয়ানদের) আনুগত্য প্রকাশ করা। এবং নেতার মুখে বিধানচন্দ্র রায়ের সেইসব ‘কাশি শুনে’ চিকিৎসার মিথিকাল গল্প শোনা!
হ্যাঁ, এটাই বাস্তব।
এই পেছনানুগত্যের নাম দেব না!
এটি সারা বছর ধরে চালাতে হয়। সব দলেই এটি এতো সুনিপুণ ভাবে বা নির্লজ্জ ভাবে করা হয় যে, ডাক্তার দিবস আর আলাদা কোন অর্থ বহন করে না।
অতএব ছুটিটা ডাক্তার বাদ দিয়ে বাকিদের হলেও, তাঁদের কিছুই বলার বা করার থাকে না!
তারপর কি হয়? পরের দিন থেকে?
ফের গল্প শোনেন, বিধ্বস্ত হন, মার খান, ঝাড় খান, পেছনানুগত্য প্রকাশ করেন!
ফের গাধার মত তুলোর বস্তাকে নুনের বস্তা ভেবে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
এবং ফল যা হবার তাই হয়।
যাকগে এইসব। ডাক্তার দিবসে এসব বাদ দিয়ে একটা অন্য ঘটনা বলি। অন্যদের গল্প বলি।
এখন তাঁরা চারজন। চার প্রকৃতির। দেখতেও তাঁরা বেশ আলাদা। একজনের প্রায় সাদার উপরে হলদেটে ছোপ, একজনের ঠিক উল্টো- হলদের উপরে সাদা ছোপ ছোপ। দু’জনেই তারুণ্যে ভরপুর। লাফালাফি করে গায়ে ওঠা, ঝাঁপাঝাঁপি মারামারি, অচেনা অজানা কাউকে দেখলে তেড়ে যাওয়া- এসব তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। একজন একটু কালচে হলুদ এবং সে মারাত্মক ভীতু। প্রথম দু’জনের থেকে খানিকটা দুরত্ব বজায় রাখে সবসময়, ভয়ও পায় তাঁদের, এবং মোটেই কোন রকম অনুযোগ অভিযোগ করা ধাতে নেই। আর কোথাও চলেও যায় না! কাছাকাছি থাকি, ভালোবাসা রাখি – এমনই ভাব।
বাকি একজন, বয়স্কা- প্রথম দু’জনের জন্মদাত্রী মা। এবং এতোটাই নিরীহ যে দেখলেই মায়া হয়। বছরের পর বছর কত সন্তানের জন্ম দিয়েছে, তাঁরা কোন রাস্তায় হারিয়ে গেছে, মরে গেছে, সে খবর আর রাখে না এখন।
যেন এই দেশের হাজারো মায়ের মতোই। জন্ম দেয়ার মেশিন। বাকি জীবনটা স্বামী সন্তানের মঙ্গল কামনা আর হেঁসেলের ঘানি টানা।
তাঁকে দেখেছি, কি মমতাময়ী একটা হৃদয়ের অধিকারী! সে বার যখন বাচ্চা জন্ম দিল একটা ঝোপের মধ্যে গর্তে, তখন সারাদিন গর্তের মুখে বসে থাকতো। খাবার দিলে কতকটা নিয়ে বাচ্চাদের খাওয়াতো। দূর থেকে কোন মানুষ এলেই চিৎকার করে উঠতো। যেন বলতো- এই দেখো, এই মানুষটি আমার সন্তানের জন্য সম্ভাব্য বিপদ!
আমি, আমার গিন্নী, সামনের ঘরের এক দাদা- এই হলো তাঁর বড় ভরসার জায়গা।
হঠাৎ সেই ঝোপের জায়গায় একদিন মাটি সরানোর মেশিন নামলো। সে সারাদিন ধরে চিৎকার চেঁচামেচি করেও দৈত্যাকৃতি মেশিনকে যখন থামাতে পারলো না, তখন অসহায় হয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়লো আমার ঘরের সামনে। চোখে জল। যেই নিচে নামলাম, প্যান্টের কোনা কামড়ে ধরে টানতে থাকলো সেই নষ্ট হয়ে যাওয়া ঝোপের ভেতরের আঁতুরঘরের দিকে, গর্তের দিকে। যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল- এই দেখো, তোমাদের সভ্যতায় আমাদের জন্য বরাদ্দ একটা ঝোপ আর গর্তও নিরাপদ নয়!
সেইটুকু অবশ্য একদিনের জন্য মেশিন চালক বাঁচিয়ে ছিল আমার গিন্নীর কথা শুনে।
সে দৃশ্য যাঁরা দেখেনি, বোঝানো যাবে না।
তারপর এক কঠিন অভিযান চালিয়ে সদ্যোজাত বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করে যখন নিয়ে এলাম দুই হাত নিচু গর্ত থেকে, তখন তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম- মানুষকে সে এখনো বিশ্বাস করে। অন্ততঃ করার মত কিছু আছে।
এখনো যদি বলি, ভুলু এদিকে আয়, চুপটি করে এসে বসে পড়বে পায়ের কাছে। আমি মুখ নামালে সে খানিকটা মুখ তুলবে। চুমু খাওয়া হয় না, কিন্ত সে বোঝে আমি তার মাথায় হাত বোলাবো । সে চুপ করে বসে থাকবে। কিচ্ছুটি না বলে বুঝিয়ে দেবে- সে শেষ দুই বছরের মত ভবিষ্যতেও এই বাড়িতেই থাকবে।
প্রথম যে দু’জনের কথা বললাম- প্রায় ধমকির মত ডাক দিয়ে, বা গলার কাছে কামড়ে ধরে তাদের লাফালাফি থামিয়ে দেবে।
সম্পর্কের এই অপরূপ সৌন্দর্য হৃদয় ভরে উপভোগ করা যায় শুধু- বলা যায় না। লেখা যায় না। আমার সে ক্ষমতা নেই।
তারা থাকে আমার ভাড়া বাড়ির নিচে। বাড়ির সবটুকু জায়গা এবং সামনের গলি রাস্তা, এই তাদের রাজ্যপাট। সেখানে কোন হানাদার দেখলেই চারজন বীভৎস মূর্তি ধারণ করে যতক্ষণ না হানাদার পালিয়ে যায়। এবং কি অদ্ভুত কাণ্ড, তারা দিনের কোন সময়েই বা রাতেও, অন্যের রাজ্যে হানা দেয় না বা অবৈধ অনুপ্রবেশ করে না!
আমার বাইরে বেরোনোর সময়, তারা যাবে পেছন পেছন। ঠিক বড় রাস্তার মুখ অব্দি। রাজ্যের শেষ সীমানায়। তাদের জন্য বরাদ্দ বিস্কুট দেব ভাগ করে। তারা শব্দ করে খাবে সে সব। তারপর যেই বলবো- বাড়ি যা, অমনি হাঁটা শুরু করবে না! এদিক ওদিক বেঁকে প্রতিবাদও করবে না যাওয়ার জন্য।
বোঝে, আমি এবার যাবো অন্য কোথাও। সেখানে তাদের নেয়া হবে না! কিন্ত যতক্ষণ চোখের আড়াল না হবো, ততক্ষণ বসে থাকবে গলির মুখে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি, খানিকটা সময় অপেক্ষা করে তারা বাড়ির পথ ধরে।
মাঝে মাঝে ভাবি- আরে, একবার তো বলতে পারতো – জীবনের ইঁদুর দৌড়ে তাল না মিলিয়ে, চল ঘরে ফিরে!
কি হবে এতো দৌড়ে?
কিন্ত- তারা আমার ভাষায় বলতে পারে না।
আমাকে বুঝে নিতে হয়- এই যে সঙ্গ দেয়া, তারপর আমাকে না নিয়েই ফিরে যাওয়া- এই তো তাঁদের ডাক!
আমি কি বুঝি সেসব? সাড়া দিই কখনো ? দিতে পারবো কোনদিন?
কোন রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি লাভ লোকসান এর হিসেব না করে, শুধু মাত্র একটু পেটপুরে খাবার আর ছাদহীন আশ্রয় পেলেও, সব কিছু ত্যাগ করে কারো কাছে পড়ে থাকা যায়, সে আর মানুষ কবে বুঝবে??
সে বার দেখলাম, সন্তানদের মধ্যে চারজনেরই শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে। ঝিমিয়ে পড়েছে। কিছু খায় না, লাফায় না, চুপ করে শুয়ে আছে।
ক’দিন ছিলাম না তার মধ্যে ডাস্টবিন থেকে কিছু খেয়েছে মনে হয়। সাধারণতঃ কৃমির আক্রমণেই এরা কাহিল হয়ে পড়ে।
একজন পরদিন মরে গেল। মায়ের সে কি মনমরা ভাব! সারাদিন চোখে জল নিয়ে বসে রইলো ঘরের সামনে! মা বলে কথা! বিনা চিকিৎসায় সন্তান মরে যাবার এই দুঃখ পেলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে! আর এই মা- চুপ করে চোখের জলে জানিয়ে দিল- কতবড় অন্যায় হয়ে গেছে আমাদের তরফে!
না, মিছিল মিটিং মামলা মারামারি কাটাকাটি কিছুই করলো না সে বা তারা!
খাবার দিলাম, খেলো না!
বিকেলে একঘন্টা ধরে চেয়ারের পাশে বসিয়ে হাত বোলালাম। একটি শব্দ ও করলো না। তারপর বোধহয় শোক খানিকটা কমলো। পরদিন ঠিক হলো।
জানলাম, সামনের ফ্ল্যাটের দাদা অলরেডি সবাইকে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন। আমি এসে আরেকবার দিলাম। এবং কি অলৌকিক ব্যাপার, আর কেউ মরলো না! ফের তাদের ভালোবাসার অত্যাচার চলতে থাকলো, বাড়তে থাকলো। যেন আসন্ন মৃত্যু থেকে উঠে আসার পর কৃতজ্ঞতায় সব বিগলিত।
মনে মনে বললাম – এই ডাক্তারির কোন নাম নেব না। দাম নেব না।
লকডাউনের সময় খাবার না দিলে তাদের প্রায় অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হয়। বাইরে কিছুই নেই এখন। যতটা পারি ঘরের থেকে খাবার দিই। কখনো বাজার থেকে মাংস এনে ঝাল মশলা বাদ দিয়ে রান্না করে দিই।
এবার বেশ কয়েকদিন বাইরে ছিলাম। ঘরে ফিরিনি। পরশু রাতে সবে গলির মুখে নেমেছি গাড়ি থেকে।
চারজন কোত্থেকে হাওয়ায় হাওয়ায় সে গন্ধ পেয়েছে।
বোধহয় এক মিনিটও টাইম নেয়নি। দৌড়ে এসে চারপাশে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করতে লাগলো। নোংরা কাঁদা নিয়ে একবার ও না ভেবে বাচ্চা দু’টো লাফিয়ে উঠলো আমার ভদ্র সভ্য জামা কাপড়ে।
প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে সামলাতেই সব নোংরা হয়ে গেল।
খুব রাগ হলো প্রথমে।
তারপরে ধমক দিয়ে বললাম – চল ঘরে।
ঘরে ফিরে জানলাম, সামনের ঘরের দাদা নেই বেশ ক’দিন।
বুঝলাম, এরা ক’দিন খাবার পায়নি।
ঘরের বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে বসলাম খাওয়াতে। কিন্ত না , খাবারে তো তেমন আগ্রহ দেখছি না।
কারণ কি ?
ফ্ল্যাটের নিচে নেমে ডাকলাম। ভীতুটা বাদ দিয়ে বাকিরা এসে পায়ের কাছে বসে পড়েছে। মুখ নিয়ে আসছে আমার মুখের দিকে।
হাত বোলাতে শুরু করলাম।
বললাম- কি হলো রে?
বাচ্চা দু’টো হঠাৎ খুব কাহিল হয়ে গেছে।
আবার কি কৃমি? হতে পারে।
কাল ওষুধ দেব।
ওরা শুনলো? বুঝলো? কি জানি।
একটু পরে, তখন রাত দেড়টা, বললাম- এবার যা।
কাল ওষুধ দিলাম। বাজার থেকে মাংস নিয়ে দিলাম দুই বেলা।
আজ যেন সবকটা ফের স্বমহিমায়। সকালে ও জামা কাপড় নষ্ট করেছে লাফালাফি করে।
একদিনেই কি খানিকটা মোটা হয়ে গেল?
এরা কি এই সামান্য খাবার আর মাথায় হাত বোলানোর ডাক্তারিতে এমনিই ভালো হয়ে ওঠে?
এমন অলৌকিক শক্তি আমার বা আমাদের আছে কি?
আমি তো কখনো এদের শিরা ধরে ডাক্তারি করিনি! কখনো শিরা ধরে বুঝতে পারিনি যে পেটে খিদে লেগেছে!
আমি বা সামনের ঘরের ডাক্তার দাদা যেটা করেছি , সেটা তো একদমই আধুনিক চিকিৎসা!
তাহলে কি করে এমন অসম্ভব সম্ভব হয়ে ওঠে? বারবার?
আচ্ছা, ওরাও কি আমাদের ভগবান ভাবে নাকি??
যদি কেউ বলেন- হ্যাঁ , তাইতো ভাবে, তাহলে এখুনি গিয়ে ব্যাটা বেটিদের আচ্ছা করে দেব!!
মজা নাকি! ওরা কুকুর, মানুষ নয়। এসব ন্যাকামি করছে জানলেই পেটাবো।
জানি তারপর আমার ঘরের সামনেই এসে বসে পড়বে- ধর্মাবতার এটা ঠিক হয়নি বলার জন্য।
চুপচাপ বসে বলে যাবে- এটা ভালোবাসা। শ্রদ্ধা। খিদের আর অসুখের ডাক্তারের প্রতি নিখাদ শ্রদ্ধা।
তো আমি কি করবো? কি করার আছে আমার?
আমি ফের ধমক দিয়ে মাথায় হাত বোলাবো। বাজার থেকে মাংস এনে দেব রান্না করে।
ডাক্তার হবার দায় আমার নেই। ভালোবাসার দায় আছে। প্রেমের দায় আছে।
কোন দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক জাঁকজমকে তাকে অস্বীকার করবো না।
তাদের জন্য সবদিন প্রেম দিবস।
আমি তাদের এই প্রেমের কোন নাম দেব না।