চলে গেলেন দাদা।
আশা আর আশঙ্কার মধ্যে দুলতে থাকা হাসপাতাল বা তার বাইরের, বন্ধু অথবা নিকট আত্মীয়দের, সবাইকে ফেলে রেখে।
আমরা যারা ডাক্তার, যারা জীবন আর মরণের মাঝে যে এক চিলতে সুতোর মাত্র তফাত, তা বুঝতে পারি জলের মতো করে; তারা অনেক দিন ধরেই জানতাম যে আমাদের ক্রিটিক্যাল কেয়ারের চিকিৎসকরা একটা হেরে যাওয়া লড়াই লড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই অসম লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাননি কেউই। আসতে চাননি তার একটাই কারণ, দাদার ডাক্তারি পেশাটির উপর নিষ্ঠা। ভদ্রলোক তো শুরু থেকেই জানতেন কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট, ডায়াবেটিক, ইমিউনোকম্প্রোমাইজড একজন রোগীর এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে দৈনন্দিন লড়াইতে নামা, নিজের মৃত্যুর পরোয়ানায় নিজেই সই করে দেওয়ার সামিল! তবুও পরোয়া করেন নি অকুতোভয় মানুষটি। নিজের শারীরিক অসুবিধাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে অনায়াসে অব্যহতি চাইতে পারতেন কাজ থেকে! চেষ্টা করেন নি তারও।
পরিবারের কথা ভেবে হয়তো কখনো মাথায় এসেছে সে কথা, কিন্তু খুব সম্ভবত নিজের চিকিৎসক সত্ত্বা উড়িয়ে দিয়েছে সেই যুক্তি।
বিগত ক’মাসে অপারেশন থিয়েটারে অথবা হাসপাতাল চত্বরে যেখানেই দেখা হয়েছে বলেছি সাবধানতা অবলম্বনের কথা। হালকা হেসে বলেছেন, চেষ্টা করছি, দেখা যাক। সেই ঝলমলে হাসিতে আমি কখনো কোন দুশ্চিন্তা খুঁজে পাইনি।
আমরা, চিকিৎসকরা, বিগত আট মাস ধরে লড়ে চলেছি একটা মহামারীর বিরুদ্ধে। এই রোগের ওষুধ এখনো আমাদের জানা নেই। রোগ পরবর্তী কমপ্লিকেশনের লিস্ট বেড়ে চলেছে রোজ রোজ আর অনবরত বদলাচ্ছে সামলাবার প্রোটোকল।
যেখানে সীমানায় দাঁড়ানো সৈন্যদল অন্তত চেনে তার শত্রুকে, পুরোদস্তুর মহড়া নেওয়ার জন্য যেখানে তাদের হাতে আছে যথেষ্ট সংখ্যক কামান আর গোলাবারুদ, সেখানে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতে যুদ্ধের রসদ প্রায় নেই বললেই চলে।
আমরা কেউই বুঝতে পারছি না সেই অদৃশ্য ভাইরাসের চলন। কার মাথায় সে তাক করে রেখেছে তার অদৃশ্য রাইফেল। আমাদের মতো ঢাল আর তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দাররা তাই এইভাবেই ক্রমাগত এক্সপোজড হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।শারীরিক জটিলতা থাকলে নিশ্চিত মৃত্যু ঘটছে অনেকের, ভাইরাসের লোড অপেক্ষাকৃত বেশী থাকার দরুণ। মাঝে মাঝেই কানে ভেসে আসছে সেই দুঃসংবাদ।
তাই কাল রাতে যখন খবরটা পেলাম অনেক কিছুর মধ্যে দাদার হাসিমুখটাই মনে পড়ছিল বারংবার।
একজন ডাক্তারের সারা জীবনের কত ভালো কাজ কিভাবে এক নিমেষে অতীত হয়ে যায়। কত মানুষের রোগমুক্তির সংস্পর্শে আসা এই জীবন! বন্ধু বা সিনিয়রদের একটার পর একটা মেসেজে ভেসে উঠছিল সেই সব স্মৃতিচারণ।
আজ সকালে রোগী দেখতে যেতে হয়েছিল আই সি ইউ তে। বার বার চোখ চলে যাচ্ছিল ফাঁকা বেডটির দিকে। শেষ কদিন ঐ বেডের পাশে এসে দাঁড়িয়ে দেখেছি অচৈতন্য দাদা কে। ভেন্টিলেটর চলছে আর তার চারিধারে সারি সারি ইনফিউশন পাম্পের সিরিঞ্জ আর টিউবের বেড়াজাল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রী বা পরিবারের কারো সাথে কথা বলার সাহস হয়নি।
অথচ আমাদের প্রত্যেকের পরিবারেই নেমে আসতে পারে একই ঘটনা। যে কোন দিন।
তবে আমরা এত সহজে হার মানছি না। লড়াই জারি থাকছে। এইসব মানুষগুলির কথা ভেবেই।
যুদ্ধ কঠিন জেনেও যেখানে দাদার মতো অসমসাহসী মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন, সেখানে আমাদের হাল ছাড়ার কোন প্রশ্ন আসে না।
যদিও জানি আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো এই যুদ্ধের শেষ দেখে যেতে পারবো না, কিন্তু চিকিৎসক হিসাবে এই লড়াইটা আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে।সময়ের দাবী সেটাই।
তবে ভবিষ্যতে একজন ডাক্তারকে আঘাত করা বা তার গায়ে বিষ্ঠা মাখিয়ে দেওয়ার আগে জনগণকে অনেকবার ভাবতে হবে।
ভাবতে বাধ্য করে গেলেন দাদা এবং চিরতরে চলে যাওয়া অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা।
ডাক্তার হয়েও যুদ্ধে শহীদ হওয়া যায়। প্রমাণ হয়ে গেল আবার।
ভালো থাকবেন দাদা। যেখানেই থাকুন।