জর্জ মাইকেলের সেই বিখ্যাত ‘লাস্ট ক্রিসমাস’ গানটা মনে আছে নিশ্চয়ই। এই গানটা যখন প্রথম শুনি সেইবার সদ্য মাধ্যমিক পাস করেছি।
ডিসেম্বর মাস চলছে তখন, শীতকাল। এগারো ক্লাসে পড়ি,ভোরবেলার কুয়াশার মধ্যে দিয়ে সকালের ইস্কুলে যেতে হয়। একটু খানি গোঁফ গজানোর মতোই বেশ বড় বড় ভাব এসেছে। গানটি আমাদের সদ্য তরুণ মনকে খুব আলোড়িত করে ছিল। নতুন পাওয়া ওয়াক ম্যানের হেডফোন কানে গুঁজে খুব কায়দা করে শুনতাম সেই গান। বব ডিলান আর জন লেননকে টপকে,তখন মাইকেল জ্যাকসন, স্টিভ ওয়ান্ডার আর লায়নাল রিচি-দের যুগ চলছে।
গানটা শুনলেই এখনো আমার পুরনো দিনের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। আমাদের পাশের পাড়ায় একটি সুন্দরী মেয়ে ছিল। আর কে না জানে সুন্দরী মেয়েরা সব সময় অন্য পাড়ায় থাকে! ঐ বয়সে যে রকম হয় আর কি! যাতায়াতের পথে আমাদের মতো উঠতি বয়সীদের দেখা হতো তার সাথে। আর মনের মধ্যে বেশ একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হতো সকলের। কি হয় কি হয়! কিন্তু আচমকাই খবর পেলাম আমাদের এক সিনিয়ার দাদা সেই মেয়েটিকে সোজা প্রেমপত্র দিয়ে ফেলেছে আর তার সাথে জর্জ মাইকেলের সেই ‘লাস্ট ক্রিসমাস’গান টির ক্যাসেট……..গিফট হিসেবে।
আমাদের তো মাথায় হাত। ছোকরারা যারা লাইনে ছিল তাদের মনমরা ভাব কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিল বেশ কিছুদিন। কিন্তু সে যে কারণেই হোক দাদাটির মেয়েটির প্রতি সেই অনুরাগ পূর্ণতা পায়নি। কালের অমোঘ নিয়মেই কচি বয়সের সেই মাধুরীর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে অচিরেই।
যাক সে কথা। মূল কাহিনী থেকে কিভাবে সরে গেলাম দেখলেন তো? আসলে এই হয়! মাঝ বয়সে এসে পুরনো দিনের কথা একবার বলতে শুরু করলে সময় সারণীগুলো নিয়ম মেনে চলে না কিছুতেই। খামখেয়ালী আর ভুলে যাওয়া মনের মধ্যে ক্রমাগত তৈরি হতে থাকবে স্মৃতি কথা,কোলাজের মত। আসলে এই গানটি শুনলেই সেই সময়টা চলতে শুরু করে ছায়াছবির মতো! তাই এসে পড়ে এতসব প্রসঙ্গের অবতারণা।
আর ডিসেম্বর মানেই তো কলকাতার আদুরে শীতকাল। স্বল্প দিনের মেহমান,তবু…….। ডিসেম্বরেই যার শুরু আর জানুয়ারিতেই শেষ। তার মধ্যেই আলমারি আর ট্রাংকের সারা বছরের অন্ধকার থেকে বের করে আনতে হবে শীতকালের সমস্ত পোশাক আশাক। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবে ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখা সোয়েটারগুলো।লাল, নীল, সবুজ রঙের। আর বেরোবে মাফলার। শীতের শুরুতেই জড়িয়ে দেওয়া হবে গলায়, কানে বা মাথায়। ওতে ঠান্ডা কতটা আটকাতো জানিনা, কিন্তু চামড়া কুটকুট করতো খুব।
আর ডিসেম্বর মাসের মূল আকর্ষণ ছিল পার্কস্ট্রিট। শীতকালে এই রাস্তা টার চেহারাই অন্যরকম। চেনা কলকাতার বাইরে যেন এক টুকরো বিদেশ…..
দুপুরে হালকা রোদে বিদেশি টুরিস্টের ভিড়ে জমজমাট। ফুটপাতে হাজারো সওয়ারির মেলা। সওদা হচ্ছে আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট। হালকা পাশ্চাত্য সঙ্গীতের বাতাবরণ…. আর সন্ধ্যার আলোতে অথবা রাতের গভীরতায় মোহময়ী পার্কস্ট্রিট।
শরীর থেকে পিছলে যাচ্ছে নিওনের আলো! ক্রিসমাসের সেই মৃদু কুয়াশাচ্ছন্ন, রহস্যময়ী, অভিজাত পার্ক স্ট্রিটের সে আবেশ এখনো অক্ষুণ্ন। মনে পড়ে পিটার ক্যাট রেস্তোরাঁয় এক বোতল বিয়ার খেয়ে আমাদের প্রথম তারুণ্যের সেই সেলিব্রেশন। বন্ধুদের সাথেই কোন একটা হুল্লোড়ে মেতে, গলা জড়াজড়ি করে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরা….. হেঁড়ে গলায় হ্যারি বেলা ফন্তের ‘জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল ‘ গাইতে গাইতে…..।
কিছু কিছু রেস্তোরাঁতে লাইভ মিউজিক চলত তখন। ক্যাবারেও হতো বেশ কিছু জায়গায়। যদিও মধ্যবিত্ত পরিবারের লক্ষণ রেখা এড়িয়ে দেখা বা শোনার সৌভাগ্য হয়নি কখনো।
কাঁটা চামচের টুং টাং,বাড়িগুলি থেকে ভেসে আসা গান বাজনায় ডুবে থাকতো সেই সাহেব পাড়ার অলিন্দ গুলি। ফ্লুরিস,ম্যাগনোলিয়া, কোয়ালিটি, ট্রিংকাস কত নাম তাদের আর ঘড়ি ধরে বদলে যাওয়া কত রকম রূপ।
এইটাই ছিল আমাদের ছোটবেলার শীতের কলকাতা। সবার আনন্দে মিশে যেতে পারা। ঈদের বিরিয়ানি আর ক্রিসমাসের কেক সবার মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার কলকাতা। আমার শহর।
তবু একটা কাঁটার মতো খচখচ করে সেই ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২ সাল। ডাক্তারি ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে আমাদের। আচমকাই ঘটে গেল অযোধ্যকান্ড। বাবরি মসজিদ ধ্বংস হল।
দুদিন সব চুপচাপ। ১৪৪ ধারা উঠতেই শুরু হল তান্ডব।
এখনো মনে আছে সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম। এলাকায় গন্ডগোলের আভাসে বেরিয়ে আসতে হল। কারো নির্দেশে হঠাৎ যেন রাস্তাঘাট খালি হয়ে গেছে। এলাকার দোকানে দ্রুত একটার পর একটা শাটার পড়ে যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে হঠাই ফাঁকা হয়ে যাওয়া চেনা লোকালয় ভুতুড়ে চেহারা নিয়েছে।
শুনলাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়াচ্ছে শহরে। ‘রায়ট’……. কথা টা শুনেছি বাবা মায়ের কাছে অনেকবার কিন্তু প্রত্যক্ষ করছি সেইবার প্রথম। গন্ডগোল যতটা না ছড়াচ্ছে, গুজব ছড়াচ্ছে তার বহুগুণ। দাউ দাউ আগুনের মত।
সেই দু:স্বপ্নের হিমেল রাতে হৈ হৈ চীৎকার আর যুযুধান ধর্মীয় জিগীরে প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম উন্মুক্ত তলোয়ার,আগ্নেয়াস্ত্র। এত হিংসা যে লুকিয়ে ছিল আমার পাড়ার অলিগলিতে কে জানতো? সারা রাত ধরে ভয়ের যে রূপ দেখেছিলাম তা কোনদিন ভুলতে পারব না। মানুষে মানুষে অবিশ্বাস যে প্রতিবেশীকেও হার্মাদ বানিয়ে তুলতে পারে তা আমার স্বচক্ষে দেখা। দেখেছি তথাকথিত উদারমনা মানুষকে সুযোগসন্ধানী মন্তব্য করতে।
আমরা ওই সময় মহল্লাগুলিতে বাহিনী তৈরি করেছিলাম দুষ্কৃতকারিদের নজরদারির জন্যে। এলাকায় অন্ততপক্ষে কোন দাঙ্গা ছড়াতে পারেনি। বেশ কয়েক দিনের কারফিউ চলেছিল শহরে। তারপর সৈন্য নামার পর সব শান্ত হয়।
ওই কদিনের অভিজ্ঞতা ভোলা যাবে না। সেই শহরটাকে আমি চিনতে পারছিলাম না।
এখন সময়টা আবার অস্থির হয়ে উঠেছে। অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে দেশজুড়ে। আমি সেই ৬ই ডিসেম্বরের কলকাতাকে মনে রাখতে চাই না।
শীতকাল মানেই আমার কাছে ক্রীসমাসের পার্ক স্ট্রিট, প্রেমিক মানুষের ভিক্টোরিয়া, পিকনিকের আলিপুর জু আর ক্রিকেটের ইডেন গার্ডেন্স। কুয়াশার ময়দানে প্রাতঃভ্রমণ। আর রবিবারের সকালে পাড়ার ক্রিকেট ম্যাচ।
ব্যাট হাতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পথে প্রেসার কুকারের সিটিতে মাংস রান্নার গন্ধ আর রেডিওতে শ্রাবন্তী মজুমদারের কন্ঠে বোরোলিনের সংসার। এইগুলোই থাকুক আমার হৃদয় জুড়ে।
আর আশা রাখবো ,ওই কলঙ্কের দিনগুলো যেন শহরের বুকে আর কোনদিন ফিরে না আসে।
এমনিতেই অনেক দুঃখ কষ্টে জড়িয়ে থাকে আমাদের জীবন। থাক না সবাই যে যার মতন। সব ধর্ম আর মতের মানুষের কাছে এটাই আমার প্রার্থনা। একমাত্র।