রক্তের বিভিন্ন উপাদান, রক্ত সংরক্ষণ প্রভৃতি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসের সম্পর্কে জেনে নিই। এই ব্যাপারে আমাদের পুরোপুরি সাহায্য করবেন ডঃ ঋতম চক্রবর্তী যিনি ইমিউনো-হেমাটোলজিস্ট ও ট্রান্সফিউসন মেডিসিনে এম ডি করেছেন।
? রক্তদানের সময় সেটি একটি থলে বা Bag-এ জমা হয়। এগুলিকে Blood Bag বলা হয়। এই থলেগুলো রক্ত সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই থলেগুলো এমনভাবে তৈরী করা হয় যাতে এগুলি রক্তদানের জন্য ব্যবহার করলে বা রক্ত জমা থাকায় বাইরে থেকে কোনো কিছু (Virus, Bacteria প্রভৃতি) ঢুকে সংক্রমণ ঘটাতে না পারে। অর্থাৎ রক্তদান করলে ব্লাড ব্যাগ থেকে আপনার সংক্রমণের ভয় নেই। এর মধ্যে রক্ত সংরক্ষণের জন্য দ্রবণ (যেমন CPDA,SAGM ইত্যাদি) আগে থেকে জমা থাকে।
এবার এই থলেটি বেশ কয়েকরকম হতে পারে –
১) Single Blood Bag – এটি রক্ত (Whole blood) নিতে, সংরক্ষিত রাখতে ও পরিবহন করতে ব্যবহৃত হয়। এর থেকে রক্তের বিভিন্ন উপাদান পৃথক করা সম্ভব হয় না, ফলে বর্তমানে চিকিৎসকেরা এর ব্যবহার করতে চান না। এতে তিনশত পঞ্চাশ বা চারশত পঞ্চাশ মিলিলিটার (দুই রকম আয়তনের আলাদা আলাদা ব্যাগ হয়) রক্ত দান সম্ভব।
২) Double Blood Bag – এটির মূল থলে (Primary Bag)-র ধারণক্ষমতা তিনশত পঞ্চাশ বা চারশত পঞ্চাশ মিলিলিটার হয়, সহায়ক থলে (Sattelite Bag)-টির ধারণক্ষমতা তিনশত মিলিলিটার হয়। এর মূল থলেটিতে ঘনীভূত লোহিত রক্ত কণিকা (Concentrated RBC) এবং সহায়ক থলেটিতে রক্তরস (Plasma বা Fresh Frozen Plasma) সংরক্ষিত থাকে।
৩) Triple Blood Bag – এটির মূল থলে (Primary Bag)-র ধারণক্ষমতা তিনশত পঞ্চাশ বা চারশত পঞ্চাশ মিলিলিটার হয়, সহায়ক থলে দুইটির (First and Second Sattelite Bag) ধারণক্ষমতা তিনশত মিলিলিটার হয়। এর মূল থলেটিতে ঘনীভূত লোহিত রক্ত কণিকা (Concentrated RBC), একটি সহায়ক থলেতে অণুচক্রিকা (Platelets) এবং অন্য সহায়ক থলেটিতে রক্তরস (Plasma বা Fresh Frozen Plasma) সংরক্ষিত থাকে।
৪) Quadruple Blood Bag – এটি Triple blood bag system এর মতোই তবে মূল থলেটির ধারণক্ষমতা চারশত পঞ্চাশ মিলিলিটার হয়। এছাড়া এটিতে আরো একটি ব্যাগ থাকে যার ধারণক্ষমতা তিনশত মিলিলিটার। এখানে প্রথম দুটি থলেতে CRBC এবং Platelets সংরক্ষণের সাথে তৃতীয় থলেতে Cyoprecipitate এবং চতুর্থ থলেতে Cryopoor Plasma সংরক্ষণ করা যায়। এটি Top and Top (TAT) এবং Top And Bottom (TAB) – এই দুই প্রকারের হতে পারে।
এছাড়া রক্তের ব্যাগের বিভিন্ন অংশ থাকে যেমন –
১) সূচ— দাতার শরীর থেকে রক্ত প্রবেশ করার ষোলো গেজের ধাতব সূচ। সূচটির অগ্রভাগ ধারালো হলে রক্তদান সহজতর হয়। এছাড়া ধারালো সূচের ক্ষেত্রে ব্যাথা তুলনায় আরো কম লাগে। আর ধারালো সূচের ক্ষেত্রে ত্বকের ক্ষতির পরিমাণ খুব কম হয় ফলে সেই অংশে Platelet activation কম হয়, তাই দান করা রক্তে Inactive Platelets বেশী থাকে যেটি তার গুণমান বৃদ্ধি করে।
২) সূচ রক্ষাকারী নল – যাতে সূচটি বাইরের পরিবেশের কোনো পদার্থের সংস্পর্শে এসে সংক্রমিত না হয় এবং খোলা অবস্থায় থেকে কারোর কোনো চোটের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।
৩) প্রি-ডোনেশন ব্যাগ – রক্তদানের সময় প্রাথমিক দশ থেকে তিরিশ মিলিমিটার রক্তের গতিপথ বদলে দিয়ে এই ছোট থলে জমা করা হয়। কারণ এই প্রাথমিক রক্তে ত্বকের অংশ ও ব্যাক্টেরিয়া থাকার সম্ভাবনা প্রবল। এতে মূল রক্তের থলেতে ব্যাক্টেরিয়াজনিত সংক্রমণের সম্ভবনা অনেক কমে যায়।
৪) লিউকোসাইট ফিল্টার (ঐচ্ছিক অংশ) – এটি ব্যবহার করে দান করা রক্তের শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ কমানো হয়। এটি একটি ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে যেটি রক্তের প্রায় শতকরা নিরানব্বই দশমিক নয় শতাংশ শ্বেত রক্তকণিকাকে আটকে রাখে এবং অন্য উপাদানগুলি এই ছাঁকনি দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ব্লাড ব্যাগে ঢোকে। এই পদ্ধতির নাম Leucoreduction, এবং এই ভাবে পাওয়া রক্তকে Leukoreduced রক্ত বলা হয়। এই ছাঁকনিটি ব্যবহার করলে পরবর্তীকালে সেই রক্ত সঞ্চালন করলে, সেই রক্তটির গ্রহীতার রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাকে আক্রমণ করার সম্ভবনা কমে (Human Leukocyte antigens এর alloimmunisation এর সম্ভাবনা কমে) ফলে non-haemolytic febrile transfusion reaction – এর সম্ভাবনা কমে যায়। যারা বারবার রক্ত বা তার উপাদান গ্রহণ করেন (যেমন থ্যালাসেমিয়া রোগী, ব্লাড ক্যান্সারের রোগী, ডায়ালিসিসের রোগী ইত্যাদি) তাদের ক্ষেত্রে এইরকম Leukoreduced রক্ত বা তার উপাদান দেওয়া উচিৎ।
কাজেই রক্ত থেকে কোন উপাদান তৈরী করা হবে সেটি ঠিক করতে সঠিক ব্যাগ নির্বাচন প্রয়োজন। যেমন সিঙ্গেল ব্লাড ব্যাগ ব্যবহার করলে সেখান থেকে Whole Blood ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না, এবং এটি যে তাপমাত্রায় এবং যে পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয় তাতে কার্যত এটার RBC-গুলোই রোগীর কাজে লাগে।
? রক্তের উপাদানের সংরক্ষণ পদ্ধতি –
১) ঘনীভূত লোহিত রক্ত কণিকা (Concentrated / Packed Red Blood Cell) – দুই থেকে ছয় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখতে হয়। CPDA (Citrate Phosphate Dextrose Adenine) দ্রবণ ব্যবহার করলে আয়ু পঁয়ত্রিশ দিন অবধি হয়। CPD-SAGM (Saline Adenine Glucose Mannitol) দ্রবণ ব্যবহার করলে আয়ু বেয়াল্লিশ দিন অবধি হয়।
২) ঘনীভূত অণুচক্রিকা (Platelet concentrate) – কুড়ি থেকে চব্বিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখতে হয়। আয়ু পাঁচ দিন। রক্তসংগ্রহের সময় থেকে ছয় – আট ঘন্টার মধ্যে রক্ত থেকে অণুচক্রিকা আলাদা করে নিতে হবে।একে Random Donor Platelets (RDP) ও বলা হয়।
৩) রক্তরস (Plasma) – সংগ্রহের আট ঘন্টার মধ্যে রক্ত থেকে রক্তরস আলাদা করে নেওয়া উচিত। শূণ্যের নিচে আশি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় চব্বিশ ঘণ্টা রাখার পর সেটি জমাট বেঁধে গেলে সেটি Fresh Frozen Plasma (FFP) তে পরিণত হয় যেটিকে শূণ্যের নিচে চল্লিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় একবছর ধরে রাখা যায়। কিন্তু একবার গলিয়ে দিয়ে এক থেকে ছয় সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় আনলে তার আয়ু মাত্র বারো ঘন্টা হয়ে যায়।
৪) Cyoprecipitate – শূণ্যের নিচে আশি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় চব্বিশ ঘণ্টা রাখার পর জমাট বাঁধা Cryo-Plasma কে ধীরে ধীরে চার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এনে গলানোর পরে সেখান থেকে Centrifugation এর মাধ্যমে আলাদা করে নেওয়া Croprecipitate কে আবার শূণ্যের নিচে আশি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এক বছর অবধি সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু আবার গলিয়ে দিলে ছয় ঘন্টার মধ্যে রোগীর শরীরে সংবাহিত করতে হয়।
৫) Centrifugation এর পরে উপরের বাকি থাকা Cryopoor Plasma কে আবার শূণ্যের নিচে আশি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এনে এক বছর অবধি সংরক্ষণ করা যায়।
এই উপাদানগুলি পৃথককীকরণ করে বানানোর সময় তার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে এবং এগুলি নির্দিষ্ট গুণমান বজায় রেখে বানাতে হয়।
১) CRBC/PRBC = ৩৫০ মিলিলিটার রক্তে ১৫০ মিলিলিটারএবং ৪৫০ মিলিলিটার রক্তে ২৫০ মিলিলিটার লোহিত রক্ত কণিকার উপস্থিতি প্রয়োজন (পরিমাণে ±১০% অবধি ছাড় দেওয়া হয়)।
২) RDP = ৩৫০ মিলিলিটার রক্ত থেকে বানানো RDP-তে ৩.৫ ×১০১০অর্থাৎ তিন হাজার পাঁচশত কোটি সংখ্যক এবং ৪৫০ মিলিলিটার রক্ত থেকে বানানো RDP-তে ৪.৫ ×১০১০অর্থাৎ চার হাজার পাঁচশত কোটি সংখ্যক অণুচক্রিকার উপস্থিতি অবশ্যই প্রয়োজন।
(চলবে)