আজ শ্রমিক দিবস। ডাক্তারিতে শ্রমিক বলতে আমরা বুঝি ইন্টার্ন, ফার্স্ট ইয়ার রেসিডেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। এরা সব একেকজন জন হেনরি। স্টাইপেন্ড পাওয়া মানুষের মেহনত স্যালারি পাওয়া মানুষদের বোঝা টেনে বেড়ায়। পিজি হাসপাতালে রয়ে যাওয়ায় এই দ্যোতনাটা রয়েই গেল, তায় আবার সুপার স্পেশালিটি- পুকুরে বড় বড় মাছ। যাই হোক এসব বলে নিজের নিকট ভবিষ্যৎ আর বিপন্ন করতে চাই না। আজ এক সিনিয়র বললো, তোমায় ক্যাম্পাসের দশ মিনিটের মধ্যে থাকতে হবে, ২৪×৭, রোগী খারাপ হলে যাতে তুমি সঙ্গে সঙ্গে আসতে পারো। শুনলাম, মনে মনে হাসলাম, সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো আজ ১লা মে। শ্রমিকরাও আন্দোলন করে নিজের অধিকার আদায় করতে পারে, কিন্তু রেসিডেন্টরা? নৈব নৈব চ।
কিন্তু সব খারাপের মধ্যে ভালোও আছে। এই যে আমি একটু উচ্চমানের ঠিকাদারি অর্থাৎ সিনিয়র রেসিডেন্সি ছেড়ে আবার শ্রমিক হয়েছি, তাতে আবার দিনে দু’বেলা করে রোগীদের সংস্পর্শে আসতে হচ্ছে। আবার সেই পুরোনো দিনের মতো তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনছি, বেশ দিন কেটে যাচ্ছে। সাবজেক্টে ইন্টারেস্ট জিরো, পড়াশোনার চাপও নেই। যে কার্ডিওলজি ভালোবেসে পড়তে আসা, তার নামগন্ধও নাই চারিদিকে- শুধু স্টেন্ট, পেসমেকার চারিদিকে মাছির মতো ভনভন করছে। এর মাঝে একমাত্র কাছের লোক বলতে এই রোগীরাই।
ফিমেল ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে গেলেই সমস্যা। এদের ঘ্যান ঘ্যান, কান্নাকাটি লেগেই থাকে। একেকজন তাড়াতাড়ি ছুটি পেয়ে যায়, একেকজন আবার ওটির আশায় বসে আছে, কবে তার যন্ত্র আসবে! বলতে নেই চটি পিসি হাজার পাপ করলেও কম লোককে ফ্রী-তে স্টেন্ট, পেসমেকার বিলি করলেন না। কিন্তু একটু জটিল ইন্টারভেনশনগুলোর যন্ত্র আসতে সময় লেগেই যায়। কোন কোম্পানি টেন্ডার নিলো, তারা আবার ছেড়ে দিলো, অন্য কেউ সেই টেন্ডার পেলো- এসব জটিল সমীকরণ পেশেন্ট বোঝে না। তাদের এক প্রশ্ন, কবে হবে আমার ওটি? আর আমাদের কাজ হয় সান্ত্বনা দেওয়া, ঠিক সময়মতো আসবে, একটু ধৈর্য ধরো। একেক সময় নিজেরই ধৈর্যচ্যুতি হয়, এভাবেই চলে যায়।
এক মধ্যবয়স্ক মহিলা, ডিসিএম রোগী- তার সিআরটিডি বসানোর প্ল্যান। মাস দুয়েক হয়ে গেল তার যন্ত্র এখনো এলো না। রোজই সে হাসিমুখে থাকে, বাড়ির লোকজন কেউ থাকে না বিশেষ। মাঝে একদিন বললো তার স্বামী ঘরে ফিরে যেতে বলছে। তার স্বামীকে ডেকে পাঠালাম, বোঝালাম, সেও বুঝলো, বাড়ি চলে গেল। আজ দেখি সে কাঁদছে- তাকে গিয়ে পেপ টক দিতে গেলাম। সে আমায় বলে, “তুমি আমার ভাই হয়েই বলো আমার জায়গায় থাকলে তুমি কী করতে! স্বামী নিয়ে গেছিলো দেবি শেঠির কাছে, উনি বলেছিলেন ছয় লাখ টাকার যন্ত্র বসাতে হবে। তারপর দু বছর এখানে আমি একাই দেখিয়েছি। আমায় ভর্তির সময় বলেছিল দু’হপ্তায় মেশিন লাগিয়ে দেবে, দেখতে দেখতে দু’মাস হয়ে গেল। ঘরে বাচ্চারা আছে। স্বামী বলেছে এবার ঈদে আসবে, তারপর এক সপ্তাহের মধ্যে অপারেশন না হলে বাড়ি নিয়ে যাবে। এখানে ক’টা ওষুধ দেয়, সপ্তাহে তিন হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়, সেই টাকা আমাকে কে দেবে! এখন আমি জানি আমার অবস্থা খারাপ, আমি হয়তো আর বাঁচবো না- তোমাদের সামনে আমি সব সময় হাসিমুখে থাকি, কিন্তু আমার মনে কী চলছে সেটা আমি জানি আর আল্লাহ জানে।”
এক তথাকথিত অশিক্ষিত গ্রাম্য মহিলা এতগুলো কথা বলে গেল গড়গড় করে, শুনে গেলাম বাকরুদ্ধ হয়ে। নিজেদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকি, এই গ্রামের গরিব মানুষগুলোর জীবনসংগ্রাম আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, যখন দৃষ্টিগোচর হয়, সেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়।
নীচে নেমে এলাম। আইসিসিইউ তে আরেক ডিসিএম রোগী- ৪২ বছর বয়স। ভি টি নিয়ে এসেছিল, শক দিয়ে রিভার্ট করা হয়। এখন অনেকটা স্থিতিশীল। প্রথম দিনই জেনেছিলাম তার স্ত্রী সিস্টার- পেরিফেরির এক হাসপাতালে ডিউটি করেন। একটা রক্ত টেনে পাঠানোর ছিল, হাতে দিয়ে বললাম রিপোর্টটা ট্রেস করে পারলে রাতেই নিয়ে আসবেন। জিগেস করলাম, রাতে থাকবেন তো? বললেন হ্যাঁ আমি আইসিসিইউ-র বাইরেই থাকি।
রোজই থাকছেন? কোথায় থাকছেন?
এই বেঞ্চে এদিক সেদিক শুয়ে কাটিয়ে দিই।
একজন সিস্টার, তার ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের বেঞ্চে। উনি বেরিয়ে যাওয়ার পর আইসিসিইউ-র সিস্টার-কে বললাম, ওনার হস্টেল বা কোথাও একটু ব্যবস্থা করে দিন!
বলে, ওসব পেরিফেরি হাসপাতালে হয়। এখানে আমাদেরই ঠাঁই জোটে না হোস্টেলে, ওনাকে কোথায় রাখবো!
অথচ এই হাসপাতালেই সিবিআই থেকে পালিয়ে চোর ছ্যাঁচড়ের দল আস্ত কেবিন নিয়ে অন্ডকোষের পরিচর্যা করায়, আমরাও করি। আমরা করি পরীক্ষায় পাস করবো বলে, আমাদের স্যারেরা করেন পিজি-তে শক্ত জমি পাওয়ার জন্য।
এদের মাঝে শ্রমিক কে আর মালিক কে? ওই রোগিণীর আল্লাহই জানেন 
১লা মে, ২০২২