বেশ কিছুদিন আগে লেখা টা লিখেছিলাম ।আজ সাংবাদিকের ‘স্রেফ এম বি বি এস’ দেখে পুনঃপ্রকাশের ইচ্ছে হলো।
নাঃ, এবারেও হলো না। পরপর তিনবার। অর্কর ভেতরটা ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে। ডাক্তারির স্নাতকোত্তর প্রবেশিকা পরীক্ষার আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে, অর্ক এবারও ব্যর্থ। হোস্টেলের ঘরে ঢুকে ছিটকিনি তুলে দিয়ে হতাশায় ভেঙে পড়েছে। অথচ কয়েক বছর আগেই চিত্রটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
জয়েন্টের রেজাল্ট জেনে বাবা বাড়িতে ঢুকেছে, মা বাথরুম থেকে আদ্দেক চান করা অবস্থায় বেরিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরেছে। ও জয়েন্টে র্যাঙ্ক করেছে; মেডিক্যালে সিওর চান্স। হঠাৎই এক ভোজবাজিতে ও যেন অনেকটা উঁচুতে উঠে গেছে।
“শোন,একবার বড়মামার সাথে দেখা করে আসিস।”—মা’র নির্দেশে আজ বড়মামার বাড়ি এসেছে। বড়মামী যত্ন করে খাওয়াচ্ছে।
“তুমি আমাদের গর্ব অর্ক”–বড়মামা বলছেন, “আমাদের সাতকুলে কেউ ডাক্তার নেই, তুমি সেই দুঃখ ঘোচালে।”
বেশ চলছিল। অ্যানাটমির বোনস হাতে ঝুলিয়ে সবাইকে ঘাবড়ে দেওয়া, অ্যানাটমি পরীক্ষার আগের দিন মাঝরাতে মাথায় বালতি বালতি জল ঢালা, আবার ফার্স্ট এম.বি.র গাঁট ছাড়িয়ে গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো। অবস্থাটা ঘুরতে শুরু করল ফাইনাল এম.বি.বি.এস. পাশ করার পরেই।
“বুঝলে অর্ক, ওনলি এম.বি.বি.এস. ডাক্তারকে আজকাল কেউ ডাক্তার মনে করে না।”–পরীক্ষা পাশের খবর দিতে মামার বাড়ি এসেছে অর্ক।
“কেন! আমাদের অর্ক হার্টের ডাক্তার হবে। আমার হার্টের ডাক্তার খুব পছন্দ।”–মাইমার আবদার।
“আরে না না, ভালো সার্জেনের কত নাম যশ, কতো পয়সা জানো! অর্ক উইল বি এ সার্জেন।”
মাইমার মুখ ভার দেখে মামা সংশোধনী আনলেন,”ঠিক আছে বাবা অর্ক কার্ডিও-থোরাসিক সার্জেন হবে। তুমিও খুশ, আমিও খুশী।”
অর্ক এবার উঠে পড়েছে। এবার বেরোতে হবে। “তানিয়াকে দেখছি না?” তানিয়া বড়মামার একমাত্র মেয়ে।
“সামনে পরীক্ষা, বন্ধুর বাড়ি গেছে, কী সব নোটস আনতে। ওর ডাক্তারি ভালো লাগে না, ওকে আর ডাক্তারি পড়াবো না ভাবছি।”
অর্ক বেরিয়ে এসেছে। ডাক্তারি পড়াটা কি এতোই ইচ্ছে-নির্ভর। জয়েন্ট নামে একটা পরীক্ষা তো আছে।
ইন্টার্নশিপ শেষের পর সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলো এম.সি.কিউ নিয়ে। সবাই যেন সত্যি বিশ্বাস করে এম.বি.বি.এস. ডাক্তারি ডিগ্রী নয়। অর্কর কিন্তু হাসপাতালে কাজ করতে ভালোই লাগে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে হাউস-সার্জেন হয়ে দিন রাত এক করে কাজ করে মনের আনন্দে। বন্ধুরা বলে, “আরে, পি.জি. এন্ট্রান্সের জন্যে পড় অর্ক।”
“ও হয়ে যাবে।”
কিন্তু হলো না। প্রথমবার ব্যর্থ হবার পর চারপাশটা কেমন বদলাতে শুরু করল। ওর চেয়ে অনেক কম কাজ জানা ছেলে-মেয়ে এম.সি.কিউ. আর কোচিং এর জোরে লিস্টে নাম তুলে ফেলল। অর্ক পিছু হঠতে শুরু করল। ও বুঝতে পারছে আজকাল ও অল্পেই ইরিটেবল হয়ে উঠছে। আত্মীয়-স্বজনদের এড়িয়ে যেতে লাগল।
সেদিন পিসেমশায়ের বাড়িতে যেতে পিসেমশাই একতাড়া প্রেসক্রিপশন বার করে দেখালো, হার্টের সমস্যায় ভুগছে। “এই দ্যাখো, ডাঃ মিত্রকে দেখাচ্ছি, কলকাতার এক নম্বর কার্ডিওলজিস্ট।”
অর্ক প্রেসক্রিপশন দেখায় উৎসাহ না দেখানোয় পিসেমশাই স্বগতোক্তি করলেন,”আরে, এইসব ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখলেও তো কিছু শিখতে পারো!”
অর্কর মনে একটু দুষ্ট-বুদ্ধি জাগলো,”কিন্তু পিসে! ডাঃ মিত্র তো এখন আর কলকাতার এক নম্বর নয়।এবারের লিস্টে তো দশ নম্বরে আছে।”
“বল কি? তাহলে এক নম্বরে কে?”
“দেখতে হবে। লিস্ট পাঠিয়ে দেবো।”—বাড়ির বাইরে পা রাখল অর্ক, “শালা! সবাই ভাবে আমার ডাক্তারই সেরা।” অর্ক সিওর আজ পিসের বুকের ব্যথাটা একটু বাড়বে। অর্ক বুঝতে পারছে, অর্ক আর আগের অর্ক নেই।
সেদিন বড়মামা ডেকেছিল,”কি করছ এখন?”
“অর্থোপেডিক্সে হাউস-জব।”
“ডাঃ সমাদ্দারকে চেনো? মামীমাকে দেখছেন।” এই এক সমস্যা, যে, যে ডাক্তারকে দেখায় তাঁকে অবশ্যই চিনতে হবে না হলে তুমি কিসের হবু ডাক্তার।
“তোমার শাড়ীটা তুলে হাঁটুটা একটু দেখাও কতো ভালো হয়ে গেছে।”
মাইমা শাড়ী তোলার আগেই অর্ক বাড়ির বাইরে।মনে মনে হাসছে ও যদি গাইনী ডিপার্টমেন্টে কাজ করত, তাহলে মাইমা কতটা শাড়ী তুলতো।
এই বড়মামার বাড়িতেই সেদিন শুনে এসেছে তানিয়া জয়েন্ট এন্ট্রান্সকে পাশ কাটিয়ে মামার অর্থকৌলিন্যে এক প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের ছাত্রী।
“তোমাদের এখানে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা কিছু হয় না, তাই আর দিলাম না।”–বড়মামা বলছিলেন, “তোমরা সামান্য হোস্টেল নিয়ে অনশনে বসে গেলে? অর্ক তুমি একবার তানিয়ার হোস্টেলটা দেখে এসো। ওঃ, একদম থ্রি-স্টার।”
“ওখানে তো দেখতে গেলে তো পয়সা লাগবে।”
“কেন?”
“বাঃ,পড়তে গেলে যেখানে লাখ লাখ টাকা; থাকতে হলে হাজার হাজার টাকা, সেখানে দেখতে গেলে শ’য়ে শ’য়ে টাকা তো লাগবেই।” বড়মামার হতভম্ব মুখটা না দেখেই বেরিয়ে এসেছিল অর্ক।
কিন্তু এই থার্ড টাইমেও ওর নাম না ওঠায় অর্ক আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। আজ রুমে আর কেউ নেই। সিরিঞ্জ, মাসল্ রিল্যাক্সান্ট সব জোগাড় করে ফেলেছে। হঠাৎই দরজায় ধাক্কায় ধড়ফড় করে উঠে বসল অর্ক।
“দরজা খোল”–বাপ্পাদার গলা। কয়েক বছরের সিনিয়র, ও হোস্টেল ছেড়ে যাওয়ার সময়েই ওর সিটটা অর্ককে দিয়ে গিয়েছিল। দরজা খুলতেই বাপ্পাদার চওড়া বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠল, “এবারেও হয় নি বাপ্পাদা।”
“বেশ তো”—ঘরের চারদিকে তাকিয়ে, “তাহলে আর বেঁচে থেকে লাভ কি!”
অর্কর মাথা নীচু। “অনেক টায়ার্ড, চল্ আজ শুয়ে পড়ি,কাল কথা।” অনেক দিন পরে দুজনে এক খাটে।
সকালে ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখল বাপ্পাদা রেডি,”চটপট তৈরি হয়ে নে, জিনিসপত্র গুছিয়ে নে, বেরোব।”
“কোথায়?”
“তুই তো কালই শেষ হয়ে গেছিস। আর তো তোর কিছু জিজ্ঞাসার নেই। আমি বলছি চল।”
পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে সিরকাবাদ।অপরূপ প্রকৃতির কোলে ছোট্ট হাসপাতাল “সেন্ট জোসেফ হোম”।
“এ হলো অর্ক স্যান্যাল। ডাক্তার। এম.বি.বি.এস. পাশ করেছে”—ফাদারের সাথে পরিচয়।
হাত বাড়ালেন ফাদার, “ওয়েলকাম আওয়ার এম.বি.বি.এস ডাক্তার।”এই প্রথম এম.বি.বি.এস. কথাটা এতোটা চওড়া শোনালো। সারিবদ্ধ সিস্টাররা ওদের প্রার্থনা-সঙ্গীত আর ফুল দিয়ে ওকে বরণ করে নিলো। অর্ক ডাক্তারের ডাক্তারির অভিষেক ঘটল।
ধীরে ধীরে সেন্ট জোসেফ হোমের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠলো অর্ক।
বিকেল চারটে হবে। হঠাৎই দেখল সিস্টাররা ছুটোছুটি করছে,”কি হয়েছে সিস্টার?”
“স্যার, একটা তিন বছরের বাচ্ছা এসেছে শ্বাসকষ্ট নিয়ে। অর্কও পেছন পেছন গেল।
সামনে বড়মামা, অনেকটা বয়েস বেড়ে গেছে, “আরে বাবা অর্ক! এখানে কার্ডিও-থোরাসিক সার্জেন আছে?”
“কেন?”
যা বোঝা গেল, মেয়ে-জামাই আর তিন বছরের নাতনীকে নিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে এসে বিপত্তি। ছোট্ট মেয়ে রিয়ার গলায় কিছু ঢুকে গেছে, নিশ্বাস নিতে পারছে না। বাচ্ছাটার মাথার কাছে তানিয়া আর ওর বর সৌমেশ। বছর পাঁচেক আগে ওদের বিয়েতে নেমন্তন্ন পেয়েও অর্ক যায় নি।তানিয়ার বাবা কোটিতে আটকে যাওয়ায় তানিয়া গাইনোকোলজিস্ট আর সৌমেশ কোটি পার করতে পারায় রেডিওলজিস্ট।
বাচ্ছাটা নীল হয়ে যাচ্ছে আর ওরা দু-কোটি মিলে সেন্ট্রাল সায়ানোসিস না পেরিফেরাল সায়ানোসিস এই রিসার্চে ব্যস্ত।
“আচ্ছা, সি-এম ম্যাডাম তো প্রত্যেক জেলায় একটা করে সুপার-স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল করেছেন, সেটা কতদূর?”
বড়মামার দিকে একবার তাকাল অর্ক, বাচ্ছাটার সারা শরীর নীল হয়ে গেছে, একদম নেতিয়ে পড়েছে। হঠাৎই অর্ক বাচ্ছাটাকে কোলে নিয়ে ছুটল ছোট হাসপাতালের ছোট ওটির দিকে, কানে বাজছে প্রামানিক স্যারের কথা,”ইউ মে গেট ওনলি ওয়ান চান্স ইন ইওর লাইফ-টাইম, ডোন্ট ওয়েস্ট টাইম।দিস ক্যান বি ডান বাই এনি ডক্টর অ্যাট এনি প্লেস।দিস ইস লাইফ-সেভিং।”
অভিজ্ঞ নার্স প্রয়োজনীয় জিনিস তুলে দিয়েছে অর্কর হাতে। মুহূর্তের মধ্যে শ্বাসনালী ফুটো করে দিল অর্ক। পৃথিবীর বিশুদ্ধ নির্মল বাতাস রিয়ার শরীরে প্রবেশ করছে, পড়ন্ত বিকেলের এক মায়াবী আলোয় ও হাত-পা ছুঁড়ছে। তানিয়া অর্কর পিঠে হাত রেখে বলল, “অর্কদা, এটাই কি ট্র্যাকিওস্টোমি?বইতে পড়েছি, আজ দেখলাম।”
“এবার একটা ভালো হাসপাতালে নিয়ে যা,সুপারস্পেশ্যালিস্টের কাছে”–অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে তুলতে অর্ক বলল।
বড়মামা এগিয়ে এসেছে, “তোর জন্য আমার সবসময়ই গর্ব।”
হো হো করে হেসে উঠেছে ডাঃ অর্ক স্যান্যাল,
“আমি কিন্তু ‘ওনলি এম.বি.বি.এস.’ “