সাপের কামড়ের সমস্যা: আমাদের দেশ মুলত উষ্ণ বা গ্রীষ্ম মন্ডলীয় অথবা ক্রান্তীয় (Tropical) জলবায়ুর দেশ। অনুকূল পরিবেশ, উর্বর সমতল, মিষ্টি জলের সংস্থান, প্রচুর খাদ্যশস্য উৎপাদন, কর্মসংস্থানের সুযোগ ও উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য জনসংখ্যা যেমন প্রচুর, পাশাপাশি পশুপাখি সহ অনান্য প্রাণীর সংখ্যাও প্রচুর। অরণ্য ক্রমশঃ হ্রাস পাওয়ায় এবং মানুষ ক্রমশ অরণ্য দখল করে নেওয়ায় বন্য জন্তুরা একদিকে বিপন্ন অপরদিকে মানুষের মুখোমুখি। তাই প্রায়ই হাতির আক্রমণ, বাঘ – চিতাবাঘ – ভালুক – কুমীরের কামড় আঁচড়ের খবর পাওয়া যায়। সর্প দংশনের সংখ্যা বাড়ে।
এছাড়া ভারত ধর্মেরও দেশ। অনেকেই গরু, হনুমান প্রভৃতিকে মাতা বা দেবতা, সাপকে মা মনসার বাহন মনে করেন। এখানকার অধিবাসীরা জন্তু জানোয়ারের সাথে মিলেমিশে বাস করতে অভ্যস্ত। গৃহে, গৃহ সংলগ্ন এলাকায় এবং রাস্তাঘাটে প্রচুর কুকুর, বেড়াল, ষাড়, গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, শুয়োর, হনুমান, বেজি ইত্যাদিকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
এই কারণে কুকুরের কামড় এবং সাপের কামড় আমাদের দেশের দুটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। তাই সংক্রমিত কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক রোগে এবং বিষধর সাপের কামড়ে বেশ কিছু মৃত্যু ঘটে। অথচ এই দুটি বিষয়ে নাগরিকরা যেমন অসচেতন, রাষ্ট্রও তেমন নির্বিকার। সাপের কামড় কে WHO অবহেলিত ক্রান্তীয় রোগের (Neglected Tropical Disease) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। আর যথারীতি অন্যান্য অবহেলিত ক্রান্তীয় রোগের মত বিষধর সাপের কামড় ও তার চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা, আর্থিক বরাদ্দ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় উভয় ক্ষেত্রেই নগণ্য ও অবহেলিত রয়ে গেছে।
ভারতে সাপ ও সাপের কামড়: পরিসংখ্যান বলছে আমাদের দেশে মাত্র সাত শতাংশ সাপের কামড় নথিভুক্ত হয় এবং ২২ শতাংশ সাপের কামড় চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে আসে। এর কারণ একদিকে যেমন অরণ্য সংলগ্ন পাহাড়ি, নদীময় ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, যাতায়াত ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং দারিদ্র্য, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যে সাপ নিয়ে কুসংস্কার, ওঝা বদ্যি, ধর্মীয় চিকিৎসা রীতির প্রতি বিশ্বাস। এখনও অনেক জায়গায় বিষধর সাপের কামড়ে মৃত্যু হলে মৃতদেহকে কলাগাছের মান্দাসে করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
ভারতে প্রায় ২৫০ প্রজাতির মত সাপের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬০ টির মত প্রজাতির সাপ বিষধর (Poisonous)। এর মধ্যে ৫০ টির মত সামুদ্রিক সাপ (Sea Snakes) হৃদপিণ্ডের এবং অন্যান্য মাংসপেশিকে অবশকারী (Myotoxic ও Rhabdomyolitic) ভয়ানক বিষধর (Highly Poisonous) হলেও সাধারণ মানুষ সাধারণত তাদের সংস্পর্শে আসেন না। আমাদের দেশে প্রচলিত Polyvalent Anti Venom Serum (AVS) দিয়ে সামুদ্রিক সাপের চিকিৎসা করা যায় না। সুন্দরবনের জেলেদের জালে কখনও সখনও চেপ্টা লেজের সামুদ্রিক বিষধর সাপ ‘ জল কেরাল ‘ ধরা পড়েছে শোনা যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভারতের প্রায় ২০০ প্রজাতির স্থল সাপের (Land Snakes) মধ্যে প্রধানত ১০ টি সাপ বিষধর (৫%) এবং ১৯০ টির মত প্রজাতির সাপ (৯৫%) নির্বিষ (Non – poisonous)। এটাই কারণ বেশিরভাগ সাপের কামড়ে মৃত্যু না ঘটার। এছাড়াও প্রায় ৫০% ক্ষেত্রে বিষধর সাপ বিভিন্ন কারণে বিষ ঢালতে পারে না।
ভারতের দশটি প্রধান বিষধর সাপ হল: (১) Spectacle Cobra (গোখরো, খরিশ, গোমো), (২) Monocled Cobra (কেউটে, শামুকভাঙ্গা), (৩) King Cobra (শঙ্খচূড়, রাজ গোখরো), (৪) Common Krait (কালাচ, কালাজ, কালাচিতি, ডোমনাচিতি, শিয়রচাঁদ, ঘামচাটা), (৫) Branded Krait (শাখামুটি), (৬) Russell’s Viper (চন্দ্রবোড়া), (৭) Black Krait (কাল কেউটে), (৮) Wall’s Sind Krait, (৯) Saw Scaled Viper (ফুরশা), (১০) Humbnose Pit Viper। এর মধ্যে প্রথম ছয়টি সাপ পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যায়। অনেকের মতে দার্জিলিং পাহাড় ও তরাইয়ের চা বাগানে প্রাপ্ত Mountain Pit Viper (গুরবে) সাপ টিও যথেষ্ট বিষধর।
উপরোক্ত ১০ টি সাপের মধ্যে আবার ৯৯% কামড় ঘটে চারটি সাপের কামড় থেকে – (১) Spectacle Cobra (গোখরো), (২) Russell’s Viper (চন্দ্রবোড়া), (৩) Common Krait (কালাচ) এবং (৪) Saw Scaled Viper (ফুরশা)। সাপের কামড়ের সামান্য নথিভুক্তির পরও বছরে ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু নথিভুক্ত হয়। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে সাপের কামড়ে মৃত্যুর আসল সংখ্যা অনেক বেশি। আবার নথিভুক্ত সাপের কামড়ে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৬৬% মৃত্যু ভয়ঙ্কর বিষাক্ত কালাচ সাপের কামড় এর কারণে।
পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি বিষধর সাপের মধ্যে শঙ্খচূড় বিশাল বড় সাপ ও প্রচুর পরিমাণ বিষ ধারণ করলেও গভীর জঙ্গলে থাকে এবং সাধারণের সংস্পর্শে আসে না। অপর বিষধর সাপ শাখামুটি খুব শান্ত প্রকৃতির সাপ, কাউকে কামড়েছে শোনা যায় না এবং কালাচ সাপ কে খেয়ে উপকার করে। কিন্তু সুদর্শন এই সাপটিকে মেরে প্রায় শেষ করে ফেলা হয়েছে।
সাপ সাধারণত নিরালা প্রিয় (Elusive) ও অন্যকে এড়িয়ে চলা (Reclusive) সরীসৃপ (Reptile)। সাপ শুনতে পায় না। কম দেখতে পায়। কিছু সাপ দিনের বেলা দেখতে পায় ও দিবাচর। কিছু সাপ রাতের বেলা দেখতে পায় তাই নিশাচর। সাপ কম্পনের মাধ্যমে অনুভব করে। ব্যাঙ, পোকা, ইঁদুর, টিকটিকি, মাছ, ছোটো সাপ ইত্যাদি সাপের খাদ্য। সাপের শরীর আঁশে ঢাকা ও ঘর্মগ্রন্থি না থাকায় পরিবেশের তাপমাত্রা ওঠানামার ওপর দেহের তাপমাত্রা নির্ভর করে (Ectothermic)। তাই প্রখর রোদে ও গরমে এবং প্রবল ঠাণ্ডায় ও শীতকালে সাপ নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে (Estivation ও Hybernation)। Common Wolf Snake (ঘরচিতি), কালাচ সাধারণত ঘরের মধ্যে বা গোয়ালে গর্ত বা ফাটলে র মধ্যে থাকে। Rat Snake (দাঁড়াশ), গোখরো প্রমুখ থাকে ঘরের কাছাকাছি গর্ত, ফাটল, ভাঙ্গা ইটের পাঁজা, পরিত্যক্ত ঘরে। Chequered Keelback (জল ঢোড়া) থাকে জলাশয়ের কাছাকাছি।
সাধারণত মানুষ কোন কারণে সাপের কাছাকাছি পৌঁছলে সাপ আত্মরক্ষার্থে কামড়ায়। গ্রামের কৃষক, মৎসজীবী, পশুপালক এবং অরণ্যচারী কাঠুরে, মৌলে, কাঠ ও পাতা কুড়ানি, পশুপালক প্রমুখেরা পেশার কারণে বেশি করে সর্প দংশনের শিকার হন। বর্ষা, বন্যা, প্লাবনে সাপের কামড় বাড়ে।
পশ্চিমবঙ্গের সাপ ও সাপের কামড়: পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি বিষধর সাপের মধ্যে (১) গোখরো, (২) কেউটে, (৩)শঙ্খচূড়, (৪) শাখামুটি ও (৫) কালাচ এর বিষ স্নায়ুতন্ত্র অবশকারী (Neurotoxic)। এর মধ্যে গোখরো, কেউটে ও শঙ্খচূড় ফনা যুক্ত (Hooded) এবং শাখামুটি ও কালাচ ফনাহীন। (৬) চন্দ্রবোড়া মূলত রক্ততঞ্চন ব্যবস্থা বিনষ্টকারী (Haematotoxic) এবং আংশিক স্নায়ুতন্ত্র অবশকারী। Green Pit Viper (গেছো বোড়া) কিছুমাত্রায় স্নায়ুতন্ত্র অবশকারী।
পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য যে সাপ গুলির দেখা মেলে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জলঢোড়া, দাঁড়াশ, ঘরচিতি, বেতআঁচড়া (Bronze Black Tree Snake), লাউডগা (Vine Snake), কালনাগিনী (Ornate Flying Snake), মেটেলি (Common Water Snake), ক্ষেতমেটে (Banded Racer), হেলে (Striped Keelback) প্রভৃতি। এগুলি বিষহীন সাপ। এর মধ্যে দাঁড়াশ বাড়ির আশপাশে ও ক্ষেতে থাকে এবং ইঁদুর খেয়ে কৃষক ও কৃষির প্রভূত উপকার করে।
ময়াল বা অজগর (Indian Rock Python) বিষহীন কিন্তু শক্তিশালী মাংসপেশী দিয়ে শিকারকে জাপটে ধরে গিলে খায়। গোসাপ (Monitor Lizard) ও তক্ষক (Chameleon) সরীসৃপ কিন্তু সাপ নয় এবং তাদের বিষ নেই। কেবল মাত্র কালাচ বাদ দিয়ে মানুষ একদম কাছে চলে এলে অথবা মানুষের দ্বারা সরাসরি বা দুর্ঘটনাবশত আক্রান্ত হলে বা আক্রমণের পরিস্হিতি তৈরি হলে সাপ কামড়ায়। আমাদের দেশে ও রাজ্যে বিছের (Centipedes) কামড় আকছার ঘটে। প্রচুর যন্ত্রণা হয়, অনেক সময় সাপের কামড় ভেবে ভুল হয়। কাঁকড়া বিছে (Scorpion) সহ ২৫ টি প্রজাতির বিষ (Venom) হয়েছে, এগুলি কামড়ালে গুরুতর উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে শঙ্খচূড় গভীর জঙ্গলে থাকে মানুষের সাথে সংস্পর্শ হওয়ার সম্ভবনা কম এবং উজ্জ্বল হলুদ কালো ব্যান্ডের সুদর্শন শাখামুটি খুবই শান্ত স্বভাবের সাপ পারতপক্ষে কাউকে কামড়ায় না। তাই সর্প দংশনে মৃত্যু রোধে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাকি চারটি বিষধর সাপের উপর মনোযোগ দিতে হবে।
গোখরো নধরকান্তি হলদে কালো রংয়ের সাপ ক্ষেতে বাগানে থাকে। বিপদ বুঝলে ফনা তুলে ছোবল মারে। ফনায় চশমা আকৃতির দাগ থাকে। সাধারণত দিনে কামড়ায়। কেউটে কালচে লম্বাটে স্বাস্থ্যবান সাপ। মাছ ও ইঁদুরের লোভে জলা জায়গা পছন্দ করে। লোকালয়ের কাছাকাছি গর্তের মধ্যে থাকে। ফনা তুললে চশমার একটি অংশের আকৃতি দেখা যায়। সাধারণত ভোরে অথবা সন্ধ্যায় কামড়ায়। গোখরো ও কেউটের কামড়ে প্রবল যন্ত্রণা হয়। রক্তপাত হতে পারে, ক্ষতস্থান দ্রুত ফুলে ওঠে, রক্ত বা রক্তরস চুয়ে পড়তে পারে। এই Cobra দের কামড়ে চোখের পাতা ঢুলে আসে (Ptosis), কথা জড়িয়ে আসে, চোখে ঝাপসা দেখে, রোগী দ্রুত ঝিমিয়ে পড়ে।
Krait প্রজাতির মাঝারি আকৃতির কালোর মধ্যে সাদা ব্যান্ডের কালাচ মারাত্মক ও সবচাইতে বিষধর সাপ। গৃহে, গোয়ালে বা আশপাশে মাটির দেওয়ালের ফাটলে থাকে। নিশাচর। ঘরচিতি সাপ খেতে ছোট ফুটো বা ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢোকে। মানুষের ঘামের প্রতি সম্ভবত আকর্ষণ আছে। ঘুমন্ত মানুষের ঘাড়ের কাছে ঘুরে বেড়ায়। অস্বস্তি হওয়ায় ঘুমন্ত মানুষ ঘুমের ঘোরে সরাতে যায়। দ্রুত কামড়ে সরে পড়ে। যন্ত্রণাহীন কামড়। দাঁতের দাগ (Fang Marks) বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থাকে না। থাকলেও ইঁদুরের কামড় মনে হয়। বিষে এক রকম অধিবিষ (Toxin) থাকে ফলে ঘুমন্ত ব্যক্তি গভীর ঘুমে চলে যান। ভোরে যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন পেট ব্যাথা ও বারবার পায়খানা প্রধান উপসর্গ হয়। নিজেও ভাবেন আন্ত্রিক রোগ, হাসপাতালের চিকিৎসক রাও অনেক সময় ভাবেন আন্ত্রিক রোগ। এছাড়াও গলা ব্যাথা, দুর্বলতা, খিঁচুনি ইত্যাদি থাকতে পারে। দুই থেকে ২০ ঘণ্টার মধ্যে স্নায়ুতন্ত্র অবশ হয়ে মারা যান।
Viper প্রজাতির চন্দ্রবোড়া স্থূল, বাদামি বা কাঠ রঙের, গায়ে চন্দন হলুদ চাকা চাকা দাগ। বাগানে চলার পথের আশপাশে ঝোপের মধ্যে বিশ্রাম করে। কামড়ে তীব্র যন্ত্রণা হয়, রক্ত চুইয়ে পড়ে, ক্ষতস্থান ফুলে ওঠে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শরীরের বিভিন্ন ছিদ্রপথে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পাশপাশি চোখের পাতাও পড়ে আসে।
সাপের মারণ বিষের (Venom) এর মারণ মাত্রার (Lethal Dose) তারতম্য আছে। ভাইপার এর ক্ষেত্রে ৪২ মিগ্রা, কোবরা র ক্ষেত্রে ১৫ মিগ্রা আর ক্রেইট এর ক্ষেত্রে মাত্র এক মিগ্রা।
সাপের কামড় এবং উপসর্গ: সাপ কামড়ালে চামড়ার মধ্যে দাঁত ঢুকে যায় তাই প্রবল যন্ত্রণা হয়। সাধারণত দুটি দাগ থাকে। কখনও একটি, কখনও বা চার পাঁচ টি দাঁতের দাগও পাওয়া যায়। কখনও কখনও নতুন দাঁত ওঠার সময় কামড়ালে বা ঠিকমত কামড়াতে না পারলে বিষ ঢালতে পারেনা (Dry Bite)। আবার অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি খুব দ্রুত সরে গেলে মারণ বিষের মাত্রা (Lethal Dose) ঠিকমত ঢালতে পারেনা।
বিষধর সাপের কামড়ের উপসর্গগুলি হলো (১) চোখ: দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, চোখের পাতা পড়ে যায়। (২) ফুসফুস: শ্বাস কষ্ট। (৩) ক্ষতস্থান: রক্তপাত, কামড়ের দাগ, কালচে রং, যন্ত্রণা, ফোলা। এগুলি কালাচের কামড়ে থাকবেনা। (৪) চামড়া: রক্তক্ষরণের ছাপ (চন্দ্রবোড়ার ক্ষেত্রে), ব্যথা, অবশ ভাব, ঘেমে যাওয়া। (৫) অন্ত্রের উপরিভাগ: বমি ভাব, বমি। (৬) অন্ত্রের নিম্নভাগ: ডায়রিয়া। (৭) কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র: মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা ধরা, অধিক জল তৃষ্ণা, গলার মাংসপেশী সহ দেহের মাংসপেশীগুলির অবশতা, মুখ থেকে লালা ঝরা, জ্ঞান হারানো। (৮) রক্ত সংবহন তন্ত্র: হৃদপিণ্ডের গতি বৃদ্ধি, নিম্ন রক্তচাপ, শকের (Shock) লক্ষণ। (৯) মাংসপেশী: সংকোচন, সমন্বয়ের অভাব, দুর্বলতা। (১০) সাধারণভাবে: জ্বর ও যন্ত্রণা।
সাপের কামড়ের চিকিৎসা:
বিষধর সাপের কামড়ে রোগীর দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে রোগীকে বাঁচানো যায়। ওঝা বদ্যি ঝাড়ফুঁক করে দেরিতে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বা হাসপাতালে আনলে রোগীর বিপদ বাড়ে। যে কোন সাপে কামড়ালেই রোগীকে আশ্বস্ত করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সাপের কামড়ে অনেকে খুব ভীত হয়ে পড়েন। সেই কারণেও গুরুতর সমস্যা হতে পারে। তাই তাদের আশ্বস্ত করার, তাদের সাথে কথা বলে সজাগ রাখার প্রয়োজন আছে। ক্ষতস্থান যতটা সম্ভব না নাড়িয়ে হাল্কা স্প্লিন্ট (Splint) সাপোর্ট দিয়ে নিয়ে গেলে ভালো, বাঁধনের কোন ভূমিকা নেই। বেশি নাড়াচড়া করলে লসিকার মাধ্যমে বিষ দ্রুত ছড়ায়। বাঁধন দেওয়া থাকলে চিকিৎসা শুরু করার পর আস্তে আস্তে খুলতে হবে। সমস্ত কামড় খাওয়া রোগীকে ভালো থাকলেও একদিন অন্তত হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। বিষের লক্ষণ দেখা গেলে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ইনজেকশন অ্যান্টি ভেনম সেরাম (AVS) দিয়ে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে এবং এভিএস এর মাত্রা রোগীর দেহের বিষ ক্রিয়ার মাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাড়াতে কমাতে হবে। এর সাথে সাকশন, অক্সিজেন, ড্রিপ প্রভৃতি জরুরি পরিষেবা দিতে হবে। নিউরোটক্সিন বিষে এট্রোপিন ও নিয়োস্টিগমিন ইনজেকশন দিতে হবে। আপৎকালীন ব্যবস্থার জন্য আড্রেনালিন, আম্বু ব্যাগ এবং লাইফ সপোর্ট যুক্ত অ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা রাখতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখনও সাধারণ মানুষের সাপের কামড় এর চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের তুলনায় ওঝা বদ্যি দের উপর আস্থা বেশি। অন্যদিকে অনেক চিকিৎসক দায়িত্ব নিয়ে সাপের কামড়ের চিকিৎসা না করে দায়সারা রেফার করে দেন। টাকা পয়সা জোগাড় করে, গাড়ি ভাড়া করে দূরবর্তী বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে রোগীর মৃত্যু বা কিডনি নষ্ট হয়ে যায়।
সাপ বা অন্য কোন কামড়ের রোগীকে হাসপাতালে আনলে তাকে ভালো করে পরীক্ষা করে ভর্তি করে নিতে হবে। Airway, Breathing ও Circulation ঠিকঠাক রাখতে হবে। প্রথমে এক বোতল নর্মাল স্যালাইন (৪০০ মিলি লিটার ) চালিয়ে দিতে হবে ও টিটেনাস টক্সয়েড দিতে হবে। বিষের লক্ষণ (Signs of Envenomation) পেলে দ্রুত ০.২৫ মিলি লিটার আড্রেনালিন ইনজেকশন চামড়ার তলায় দিতে হবে। তারপর ১০ টি অ্যাম্পিউল এ.ভি.এস. ১০০ মিলি লিটার Distilled Water এ গুলে ঐ স্যালাইনের বোতলের মধ্যে দিয়ে দ্রুত বেগে এক ঘন্টা চালাতে হবে। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ফ্লুইড সাময়িক বন্ধ রেখে আবার আড্রেনালিন ইনজেকশন দিতে হবে। গর্ভবতী মহিলা ও শিশুদের এ.ভি.এস. এর একই ডোজ। ফ্লুইড ওভারলোড এড়াতে বাচ্চা ও কিডনির সমস্যার ক্ষেত্রে নরমাল স্যালাইন এর পরিমাণ ২০০ মিলি লিটার করে দিতে হবে। পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা ধীর মাত্রায় ফ্লুইড চলবে।
চোখের পাতা পড়ে আসা সহ নিউরোটক্সিক উপসর্গ দেখা দিলে ০.৬ মিগ্রা এট্রোপিন ইনজেকশন শিরায় এবং ১.৫ মিগ্রা নিওস্টিগমিন ইনজেকশন শিরায় বা মাংসপেশিতে দিতে হবে। Myopyrolate নামক combined ইনজেকশন পাওয়া যায়, একবারে দিলে হয়। প্রয়োজনে নিওস্টিগমিন ছয় ঘন্টা বাদে বাদে পাঁচ বার অবধি এবং এট্রোপিন আট ঘন্টা বাদে বাদে দেওয়া যায়। এতেও কাজ না হলে ক্রেইট এর ক্ষেত্রে ইঞ্জেকশন ক্যালসিয়াম গ্লুকোনেট ১০ মিগ্রা শিরায় ছয় ঘন্টা বাদে বাদে দিতে হবে।
এ.ভি.এস. ঘোড়ার সেরাম থেকে তৈরি ফলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। হলে o.৫ মিগ্রা আড্রেনালিন ইনজেকশন মাংস পেশিতে দিতে হবে। দ্বিতীয় তৃতীয় ডোজের প্রয়োজন হলে ছয় ঘন্টা অন্তর দিতে হবে। চন্দ্রবোড়া র ক্ষেত্রে রক্ত তঞ্চনের সমস্যা বোঝা যায় একটি কাঁচের টেষ্ট টিউবের মধ্যে দুই কিউবিক সেন্টিমিটার রক্ত নিয়ে ২০ মিনিট রেখে দিল রক্ত জমাট না বাঁধলে বুঝতে তবে রক্ত তঞ্চনের সমস্যা (20 WBCT)। কোন কোন ক্ষেত্রে বিষধর সাপের কামড়ের চিকিৎসায় ১০ এর অনেক বেশি আম্পিউল AVSও লেগেছে দেখা যায়। তবে Haematotoxic এর ক্ষেত্রে ৩০ আম্পিউল দেওয়ার পর কাজ না হলে ডায়ালিসিস করতে হয়। যন্ত্রণার উপশমে প্যারাসিটামল এবং বিশেষ ক্ষেত্রে Tramadol ব্যবহার করা হয়। ফোলা কমাতে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট কম্প্রেশন।
সাপের কামড় এবং তার থেকে মৃত্যু প্রতিরোধ: সাপের কামড় প্রতিরোধে গৃহ এবং গৃহের আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ফাটল ও গর্তগুলি বুজিয়ে দিতে হবে। আবাস যোজনায় পাকা বাড়ি ও সংলগ্ন পাকা পায়খানার ব্যবস্থা করতে হবে। চলার পথে বিশেষত ভোরে, সন্ধ্যায় ও রাতে সাবধানতা বজায় রাখতে হবে। টর্চ ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। লাঠি ব্যবহার করলে মাটির সাথে লাঠির সংস্পর্শে উৎপন্ন কম্পনে সাপ সরে যেতে পারে। ফুল প্যান্ট ও জুতো মোজা পরে থাকলে অনেক নিরাপদ। ভিয়েতনাম, চীন, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ এবং আমাদের কেরল রাজ্যের মত কৃষকদের গাম বুট এবং মৎস্যজীবীদের জাল ফেলা ও গোটানোর সময় গ্লাভস ব্যাবহার করলে সর্প দংশনের প্রকোপ কমবে। ঘরের মধ্যে খাট বা মাচায় শুলে এবং ভালো করে মশারি খাটিয়ে গুজে নিলে কালাচের কামড়ের থেকে রেহাই মিলবে।
দাঁড়াশ ও শাখামুটি সাপ, বেজি প্রভৃতি সংরক্ষণ করলে কালাচ, কেউটে, গোখরো, চন্দ্রবোড়ার বৃদ্ধি কমবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পর্যাপ্ত উষ্ণতা সহনশীল AVS সহ প্রযোজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জামের নিয়মিত ও পর্যাপ্ত সরবরাহ রাখতে হবে। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীদের হাতে কলমে সাপের কামড়ের চিকিৎসার তালিম দিতে হবে। অন্যদিকে পঞ্চায়েতী রাজ প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য দফতর প্রভৃতির সাহায্যে মানুষকে সচেতন করতে হবে যে সাপের কামড়ে ঘাবড়ে না গিয়ে ওঝা – বদ্যি র কাছে সময় নষ্ট না করে রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসতে। ওঝা – বদ্যি দেরও বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রামীণ স্বাস্থ্য সহায়ক হিসেবে নিয়োগ ও কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করা যাতে তারা সাপের কামড়ে রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসেন এবং গ্রামাঞ্চলে এ.এন.এম., ‘ আশা ‘ প্রভৃতি স্বাস্থ্য কর্মীদের কাজে সহায়তা করেন।
সাপের কামড় নিয়ে আধুনিক গবেষণা: সাপের কামড়ের চিকিৎসা নিয়ে আরও গবেষণা এবং পশ্চিমবঙ্গে সরকার নিয়ন্ত্রিত সাপের বিষ সংগ্রহ কেন্দ্র ও AVS উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। ঘোড়ার রক্তে প্রস্তুত অনেক ক্ষেত্রে তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী এ.ভি.এস. এর উন্নত সংস্করণ এবং / অথবা উন্নত বিষ নিষ্ক্রিয়কারী ওষুধ তৈরি সময়ের দাবী। অন্যদিকে তামিলনাড়ুর ম্যাম্মাল্লাপুরমের ইরুলা কো-অপারেটিভ সোসাইটি যে চারটি সাপের গোত্র থেকে বিষ সংগ্রহ করছেন তারা যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের সাপের থেকে ভিন্ন গোত্রের তাই সেই বিষ থেকে প্রস্তুত এ.ভি.এস. পশ্চিমবঙ্গের চন্দ্রবোড়া, কালাচের কামড়ের চিকিৎসায় কার্যকরী হচ্ছে না এবং অনেক বেশি পরিমাণ এ.ভি.এস. দিতে হচ্ছে এমনটাই মত অনেক চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞের। পাশাপাশি স্কুলের পাঠক্রমে কুকুর ও সাপের কামড়ের প্রতিরোধ ও প্রতিবিধান বিষয়ে এবং স্নাতকস্তরে মেডিকেল শিক্ষাক্রমে কুকুর ও সাপের কামড়ের চিকিৎসা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এক নজরে সাপ কামড়ালে কি করণীয়:
১) রোগীকে আশ্বস্ত করা কারণ বেশিরভাগ সাপ বিষহীন।
২) কামড় দেওয়া অঙ্গ নাড়াচাড়া না করা।
৩) উপুড় করে বাঁ দিকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে নাকের ফুটো দুটো ও মুখ খুলে রাখা।
৪) মুখে খাবারের সাথে জল না দেওয়া অথবা কম দেওয়া।
৫) পোশাক, অলঙ্কার, জুতো ইত্যাদি ঢিলা করে দেওয়া বা খুলে রাখা।
৬) বাঁধন না দেওয়া।
৭) ক্ষতস্থানে কিছু না করা।
৮) ওঝা বদ্যি র কাছে না নিয়ে যাওয়া, তাদের কোন ভূমিকা নেই
৯) দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া।
১০) বিষের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত এ ভি এস দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা।