সবেমাত্র দুটো পেসেন্ট দেখেছে অনিমেষ, তখনই নীচে একটা গোলমাল। বাড়ির ম্যাজেনাইন ফ্লোরেই চেম্বার আর নীচে গ্যারাজে মেকশিফ্ট রুগীর অপেক্ষা-ঘর।
খানিকটা জোর করেই মেয়ে-জামাই ‘মেড-অ্যাস’ ইন্সুরেন্স কোম্পানির খাতায় নাম তুলে দিয়েছে একটা প্রিমিয়াম দিয়ে।
“আমি আর ক’টা পেসেন্ট দেখি”– অনিমেষের এই কথার উত্তরে কোম্পানির লোকাল এজেন্ট নির্মল ছেলেটি অদ্ভুত কথা বলেছিল, “স্যার, একমাসের বিধবাও বিধবা আবার কুড়ি বছরের বিধবাও বিধবা।”
“মানে?”
“মানে স্যার, যার বিয়ের একমাসের মধ্যে বর মারা গেল আর যে কুড়ি বছর ঘর করার পর স্বামীহারা হলো দুজনকেই তো বিধবার আচার মানতে হবে।”
“তাই তো।”
“আপনি স্যার অল্প পেসেন্ট দেখেন বলে ফাঁসবেন না, এ গ্যারান্টি কি আছে?”
সেই নির্মল, চুক্তির আগে চেম্বার ইন্সপেকশনে এসেই চমকে উঠল, “করেছেন কী স্যার, আপনার রুগী বসার ঘর, চেম্বার কোথাও কোনো কাঁচের দরজা নেই, কাঁচের টেবিল, এমনকি একটা কাঁচের ফুলদানিও নেই।”
“কেন, এসবে কি হবে?”
“আরে রুগীর বাড়ির লোক বলে যারা আসবে বা যাদের নিয়ে আসা হবে, তারা ভাঙ্গবে টা কী?
ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙ্গার মধ্যে একটা গণ্ডগোলের আমেজ আসে, ফটোগ্রাফারের ছবিতে ‘তছনছ’ ভালো দেখায়। এ তো দেখছি সোজাসুজি আপনাকে মারার সব ব্যাবস্থা করে রেখেছেন।”
তাই তার নির্দেশে অপেক্ষা-ঘর এখন কাঁচের টেবিল, অ্যাকোয়ারিয়াম, এমনকি দুটো ফুলদানিতেও শোভিত।
শুধু কি তাই, কোম্পানির নির্দেশ, প্রেসক্রিপশনের ওপরে স্ক্যান করে রুগীর ছবিও দিতে হবে, না’হলে নাকি যে কেউ ফেঁসে যেতে পারে।
“আরে রুগী কি পরীক্ষা দিতে আসছে নাকি যে ফটো লাগানো অ্যাডমিট কার্ড লাগবে।”
“স্যার, আগেকার দিনে আপনারা রুগীকে পরীক্ষা করতেন, এখন প্রতিটি পেসেন্ট আপনারও পরীক্ষা নেয়।”—নির্মলবাণী চলেছে, “এই যে আপনি প্রেসক্রিপশন লিখলেন এটাই আপনার অ্যানসার স্ক্রিপ্ট। একবার আপনার হাত থেকে বেরিয়ে গেল আর বাইরে হাজার এগজামিনার আতসকাচ নিয়ে বসে আছে। পাস-ফেল তো আছেই, আপনি রাস্টিকেটেডও হয়ে যেতে পারেন।”
“মানে!”–অনিমেষ আজকাল একটুতেই ঘাবড়ে যায়।
“আরে ঐ সব মাঝি-মাল্লাদের পাল্লায় পড়ে আপনার এতো সাধের, এতো কষ্টের রুগী দেখার ছাড়পত্তরটি জলে ভেসে যাবে। বসে থাকুন আপনি ঠুঁটো-জগন্নাথ হয়ে।”
“তবু ছবি সাঁটানোর দরকার নেই বাবা নির্মল।”
“আরে ডাক্তারবাবু, অত ভাবছেন কেন? আমরা একটা ছোট স্ক্যানার-প্রিন্টার রেখে দেবো, ছবিসমেত প্রেসক্রিপশন বেরিয়ে আসবে। আপনি একশ’ টাকা ভিজিট বাড়িয়ে দিন, ব্যাস।”
অবশেষে একটা মাঝামাঝি সমাধান হলো।আধারের জেরক্স জমা দিয়ে তবেই রুগী অনিমেষের কাছে যাবে। ছবি বাদ, ভিজিটও এক।শ্রীকান্ত বলে যে ছেলেটি অনিমেষের চেম্বার দেখাশোনা করে সে হঠাৎ বলে বসল, “নির্মলস্যার, আধার ভেরিফিকেশনের সময় ভিজিটটাও নিয়ে নিলে হয়না, দাদাকে তো অনেক লোকই ভিজিট না দিয়ে চলে যায়।”
অনিমেষ হাঁ হাঁ করে উঠলো, “আরে না না, রুগী দেখলাম না, তার আগেই ভিজিট! এ আবার হয় নাকি!”
“কেন? আমরা কি মোবাইলে প্রি-পেড ভরি না?”
“তবু থাক বাবা শ্রীকান্ত, আমাকে দেখানোর পরই টাকাটা নিস। আমার পোস্ট-পেডই থাক।”
“যা ভালো বোঝেন”—স্পষ্টতই অসন্তুষ্ট শ্রীকান্ত।
তা আজ আবার নীচে গণ্ডগোলটা কিসের! শ্রীকান্ত ওপরে উঠে এসেছে।
“কি হলো শ্রীকান্ত?”
“এই দেখো না, এক মহিলা আধার কার্ড আনে নি, তবুও সে দেখাবেই।”
বলতে বলতেই এক মহিলা শ্রীকান্তের পেছনে উঠে এসেছে,”হ্যাঁগো অনিমেষ ডাক্তার, তুমি নাকি আমাকে চেনো না, আধার ছাড়া আমাকে দেখবে না?”
অনিমেষ আমতা আমতা করে হ্যাঁ আর না এর মাঝামাঝি।
“বলি দু-দুটো বাচ্চা আমার তোমার কাছে হলো, সেদিন রাতে বড় মেয়ের বাচ্চা নষ্ট হয়ে কি রক্ত, কি রক্ত!”—মহিলা বলে চলেছে, “তোমার গেট তালাবন্ধ, পেছনের জানলা দিয়ে ডেকে মাঝরাতে তোমায় বিছানা থেকে তুলে নিয়ে গেলাম, আর এ ছোকরা বলে কিনা তুমি নাকি আমাকে আঁধারে চিনবে!”
এবার শ্রীকান্তের দিকে তাকিয়ে, “শোন রে ছোকরা, আমি নিজেকে যা চিনি অনিমেষ ডাক্তার তার চেয়ে আমায় বেশি চেনে, আমার নাড়ি-নক্ষত্র সব জানে।”
“শ্রীকান্ত, ছেড়ে দাও, এঁকে আমি দেখে দিচ্ছি।”
“কাজটা দাদা ঠিক করলে না, নির্মলস্যার জানতে পারলে রেগে যাবেন।”
এই আর এক সমস্যা। অনিমেষ ডাক্তার দাদা হলেও টাই-পরা নির্মল শ্রীকান্তের ‘নির্মলস্যার’।কথায় কথায় ওর নামে হুমকি। পেসেন্ট দেখবে কি, অনিমেষ চারদিকের হুমকিতেই নার্ভাস, সবাই যেন ফাঁসাতেই আসছে।
মুখোমুখি সন্ধ্যা পারাল,”বলো মা তোমার কী হলো?”
সন্ধ্যার হাতে গোল করা একটা ইউ.এস.জি. ফিল্ম আর রিপোর্ট।অনিমেষের হাতে তুলে দিয়ে বলল, “দেখো তো ডাক্তার।”
ছবিতে অনিমেষ দেখল জরায়ুর মাথায় একটা বেশ বড় টিউমার বসে আছে, ‘ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড; অপারেশন ছাড়া গতি নেই। অপারেশনের কথা ভাবলেই অনিমেষের আজকাল শরীর কেমন করে।টেবিলের লাগোয়া ড্রয়ার টেনে দেখল নির্মলদের কোম্পানির দেয়া ইনভেস্টিগেশনের ফিরিস্তি, “শোনো মা, তোমার তো একটা বড় টিউমার আছে, অপারেশন করতে হবে।”
“তা করো।”– নির্লিপ্ত সন্ধ্যা পারাল।
“না, মানে তার আগে অনেক পরীক্ষা-নিরিক্ষার প্রয়োজন।”
“শোনো অনিমেষ ডাক্তার”—চেয়ার টেনে ব্যাগটা খুলল সন্ধ্যারানী,” এই টিউমার, এই আমি আর এই অনেক কষ্টে জোগাড় করা দশ হাজার টাকা; যা পারো করো।”
অনিমেষ দেখল টেবিলের ওপর মোচড়ানো কয়েকটা পাঁচশো টাকার নোট, গুনতিতে গোটা কুড়ি হবে। কিন্তু ইনভেস্টিগেশনের ফিরিস্তি মেটাতেই তো সব শেষ হয়ে যাবে। মহা ফাঁপরে পড়েছে অনিমেষ ডাক্তার; ওদিকে নিশ্চিন্তে সন্ধ্যা পারাল।
“শোনো, তুমি আবার কেস-টেস করবে না তো?—মরিয়া অনিমেষ।
“কেস!”—- এবার অবাক সন্ধ্যারানী, “কেস তো তুমি করবে অনিমেষ ডাক্তার।”
“মানে?”
“তবে শোনো ডাক্তার, আমি যেখানে ছবি তুললাম, সেখানে আমায় বসিয়ে রেখে এক ছোকরা, এক ডাক্তারকে ফোন করল, “স্যার, একটা কেস আছে, করবেন? ভর্তি করব?”
আমি যখন বললাম, “একবার অনিমেষ ডাক্তারকে দেখিয়ে আসি, তখন আবার বলল, “না স্যার, কেসটা অনিমেষ ডাক্তারের কাছে চলে গেল, অনিমেষ ডাক্তার মনে হয় করবে”—-অনর্গল সন্ধ্যা, “তাই তো বলছি ডাক্তার, কেস তো তুমি করবে।”
অনিমেষ অবাক। সত্যিই তো!মেড-অ্যাসের পাল্লায় পড়ে “কেস” কথাটার ডাক্তারি অর্থটাই বেবাক ভুলে গিয়েছিল।
“হ্যালো, গ্রীন-ভিউ নার্সিংহোম? সোমবার সকাল ন’টায় আমার একটা কেস হবে:হিস্টেরেক্টমি।”
ফুরফুরে মেজাজে ফোন রাখল অনিমেষ।