জয়েনিং অ্যাপ্লিকেশনে ‘অ্যালাউড’ লিখে হেড স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “কোভিড থেকে সেরে উঠে কী মনে হচ্ছে?”
কী বলব? এ যে এক চরম অভিজ্ঞতা! আমার সুস্থতার জন্য কাকে ধন্যবাদ জানাবো? চিকিৎসাবিজ্ঞান,আমার পরিবার, না মায়ের ইষ্ট দেবতা কে? আমি ভাগ্যবান যে আমাকে ভর্তি হতে হয় নি। কিন্তু যাদের সত্যিই ভর্তির প্রয়োজন পড়ছে…
প্রায় এক বছরের ওপর সময় ধরে কোভিড প্রোটোকল মেনে চলেছি। করোনার ‘প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে’র সাথে সর্বদা সমান্তরালে চলার চেষ্টা করেছি। যখনই মনে হয়েছে ওই ‘ওয়ার্ল্ড’ আমার পথের সাথে মিশে যেতে পারে, তখনই রাস্তা বন্ধের জন্য ঢাল, শিরস্ত্রাণ স্বরূপ মাস্ক, ফেসশিল্ড, পি পি ই, সাবান, স্যানিটাইজার নিয়ে লড়ে গেছি। কিন্তু সব কিছু করেও হল না, ওই ‘প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে’র অধিবাসী হতেই হল।
জুনিয়র রেসিডেন্ট ভাইটি বললো, “দাদা সেদিন যার স্টিলেট গ্যাংলিয়ন ব্লক করেছিলে, তার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।”
রেগে গিয়ে বললাম, “নেগেটিভ রিপোর্ট না আসলে ইন্টারভেনশন হবে না বলেছিলাম যে!”
–“আসলে ওর আর-টি পি-সি-আর প্রথমে নেগেটিভ এসেছিল, কিন্তু কাল আবার রিপিট টেস্টে পজিটিভ এসেছে…”
সেদিন রাত থেকেই জ্বর আসা শুরু করল। পরদিন স্যাম্পেল দিয়ে এলাম। আধ ঘন্টা পরই রাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট পজিটিভ জানতে পারলাম। শুরু হল আমার নিভৃতবাস। এখন তো আমি ‘প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে’র অধিবাসী, যার ভয়ে এতকিছু নিয়ম কানুন, এত মুখোশ পরার হিড়িক… এখন তো আর এসব না করলেও চলে! কিন্তু না… আমার বাড়িতে এখন পঞ্চান্ন উত্তীর্ণ চারজন আছেন, তাদের কোমর্বিডিটিও আছে … এখন তাদেরকে আমার থেকে বাঁচানোটাই প্রধান লক্ষ্য।
আমি আর আমার আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে এক প্রাচীর তুলে দিলাম সতেরো দিনের জন্য। এই দুই ‘সমান্তরাল বিশ্বে’র যোগাযোগ শুধু মাত্র মোবাইল ফোনে। খাবার, ওষুধ যা আমার ঘরে সাপ্লাই আসছিল, সবই মোবাইলে অর্ডার করা।
মোবাইল অন থাকার সুবাদে স্বাভাবিক দিনের মতই ফোন, মেসেজ আসতে লাগলো। পজিটিভ হবার খবর শুনে অনেকেই আরও বেশি ফোন করতে লাগলেন। কিন্তু কথা বলতে আমার সমস্যা হচ্ছিল, বেশি কথা বললে কাশিও হচ্ছিল। তাই চেনা পরিচিত লোকেদের ফোন আমার স্ত্রীই (পজিটিভ হলেও উপসর্গ খুব কম ছিল) ধরছিল। এরজন্য তুলনামূলক কল কম এলেও হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ অনর্গল ঢুকতেই থাকলো, যদিও এদের বেশিরভাগজনই আমার অসুস্থতার খবর জানেন না। কেউ আমার অবস্থা জেনে কেমন আছি জানতে চেয়েছে, কেউবা নিজের বা আত্মীয় স্বজনের শারীরিক সমস্যার জন্য পরামর্শ চেয়েছে। মেসেজে একটাই সুবিধা, নিজের ইচ্ছেমতো সময়ে রিপ্লাই দেওয়া যায়। এরমধ্যে আমার ভাই জানালো ওর চার-পাঁচজন বন্ধুর করোনা পজিটিভ, ওরা খুব চিন্তায় আছে। সত্যিই সোশ্যাল মিডিয়া, খবরের কাগজ বা চ্যানেল গুলোতে যেভাবে দেখাচ্ছে, তাতে পজিটিভ হলেই যে কারো চোখে শ্মশান বা কবরের ছবিই ভেসে উঠবে। ওদের আমার কথা বলেই সান্ত্বনা দিলাম আর প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলাম।
হঠাৎ দেখলাম একটা অজানা নাম্বার থেকে ব্লাড রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই নাম্বার থেকে ফোন এলো। রুরাল সার্ভিস করার সময় থেকেই বহুলোকের সাথে পরিচয়, বিশেষ করে ওষুধের দোকানের লোকজন, স্বাস্থ্যকর্মী বা আমার কিছু পুরনো রোগী…ফোন নাম্বার একই থাকায় যোগাযোগ টা এতো বছর পরও রয়ে গেছে। ওনারাও আপদে বিপদে পরামর্শ চেয়ে থাকেন, আমিও দূর থেকে যতটা সম্ভব সৎ পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করি। সেরকমই এক ওষুধের দোকানের মালিকের ফোন।
“স্যার মায়ের রিপোর্ট গুলো একটু দেখুন… দশ দিন ধরে জ্বর কমছে না। রিপোর্টে টাইফয়েড ছাড়া সবই তো নর্মাল…অ্যান্টি বায়োটিকও সবরকম দিয়েছি……”
ওষুধের লিস্ট শুনে খুব বেশি অবাক হইনি। জানি এনারা প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ বিক্রির পাশাপাশি কোয়াক প্রাকটিসও করে থাকেন।
—“কোভিড টেস্ট করিয়েছেন?”
—“না স্যার, কী করব বলুন? পজিটিভ হলেই তো তুলে নিয়ে চলে যাবে, মায়ের মুখটাও শেষ বারের মত দেখতে পাব না!”
—“পজিটিভ হলেই তুলে নিয়ে যাবে কে বললো? অল্প উপসর্গের ক্ষেত্রে তো বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা হবে। আর যদি বেশি কিছু হয়ও, সেটাও তো প্রটোকল মেনে চিকিৎসার দরকার। আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করান, প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন করবেন।”
পরদিন আবার ওনার ফোন পেলাম, “স্যার, মায়ের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। শ্বাসকষ্ট ছিল, তাই ডাক্তার বাবু নেবুলাইজেশন করে দিয়েছেন। এখন অনেকটা ভালো আছে। বাড়িতে এনে পালস অক্সিমিটার দিয়ে বারবার স্যাচুরেশন চেক করছি, ঠিকই থাকছে। আপনার পাঠানো ছবিটা দেখে প্রোনিংও করাচ্ছি। ”
সেদিন সকালের দিকে ফোন এলো স্কুলের এক বন্ধুর কাছ থেকে। গতকালই ফোন করে কোন কোম্পানির পালস অক্সিমিটার কিনবে জিজ্ঞেস করেছিল। ফোনটা ধরতেই উদ্বিগ্ন গলা ভেসে এলো, “বুঝলি মায়ের রিপোর্ট টা আজ পজিটিভ এসেছে। আর তারপর থেকেই স্যাচুরেশন কমতে লেগেছে। এখন ৯৫ এ ঘোরাফেরা করছে, মাঝে মধ্যে নিচেও নেমে যাচ্ছে। এদিকে তো কোথাও বেড নেই, কী করি বলতো…”
–“শোন, আগে ওনার আঙ্গুলটা ভালো করে ঘষে নে তারপর আবার দেখ, অনেক সময় হাত ঠাণ্ডা থাকলে ঠিকঠাক দেখায় না।”
কিছুক্ষণ পর আবার ওর ফোন,”না রে কিছুতেই স্যাচুরেশন উঠছে না। মা যেন আরও বেশি হাঁফাচ্ছে!”
ওর কথা বলার সাথেই ব্যাকগ্রাউন্ডে নিউজ চ্যানেলের এক জনপ্রিয় সঞ্চালকের কণ্ঠস্বর কানে এলো। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোদের বাড়িতে কি সারাদিনই টিভি চলে?”
–“মানে এখন চলছে…ঘর থেকে তো কেউ বেরোচ্ছে না, তাই সময় কাটানোর জন্য টিভি ই ভরসা। আর বাবা তো সবসময় নিউজ চ্যানেলই দেখে।”
–“তুই এখন থেকে নিউজ চ্যানেল দেখতে বারণ কর। সেরকম হলে কাকিমার ফেভারিট সিরিয়াল চলুক, আর ওনাকে টেনশন করতে বারণ কর। করোনা হলেই সাক্ষাৎ মৃত্যু, এমন যেন না ভাবেন।”
–“তুই একটু বোঝা…আমি ফোনটা মা কে দিচ্ছি।”
রাতের দিকে বন্ধু ফোন করে জানাল যে এখন স্যাচুরেশন অনেকটা উঠেছে, শ্বাসকষ্ট আর নেই।
পাঁচদিন প্রায় হয়ে গেল, এখনও আমার জ্বর টা কমতে চাইছে না। দরকার কিছু ব্লাড টেস্ট করার, আর বুকের এক্স রে। কিন্তু এই মফঃস্বল শহরে যারা বাড়ি থেকে রক্ত নিয়ে যায়, তারাও আসতে রাজি হচ্ছে না। কী করা যায়, সেই নিয়ে বড় চিন্তায় আছি। এমন সময় অজানা নাম্বার থেকে ফোন এলো, নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করলো। ভাবলাম সত্যিই কোনো দেবদূত আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভুল ভাঙলো। বললো, “যদি ভোট দিতে যান, আমরা হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুল্যান্স পাঠাবো।”
ওহ! এই আইসোলেশনে থেকে ভুলেই গিয়েছিলাম আজ এখানে ভোট উৎসব। বাড়ির কেউ এবার ভোট দিতে বেরোবে না ঠিক করেছিল আগেই, তাই ব্যাপারটা আমার মাথায় ছিল না। এই সময় হঠাৎ করেই মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। আমি বলে উঠলাম, “আমার তো কিছু রক্ত পরীক্ষারও দরকার, যদি একটা ল্যাবে একটু নিয়ে যান…”
উল্টোদিক থেকে উত্তর এলো, “না, আপনাকে শুধু আমরা ভোট কেন্দ্রেই পৌঁছে দিতে পারি, অন্য কোথাও না।”
পরে শুনেছিলাম আমাদের পরিচিত এক নেতা খুব দুঃখ করেছিলেন এতগুলো ভোট নষ্ট হল বলে।
সেদিন বিকেলের দিকে আরও একটা অজানা নাম্বার থেকে ফোন। আমার এক কলেজ পড়ুয়া ভাইয়ের বন্ধু। পরিচয় দিয়ে বললো, “দাদা আমাদের শহরের হাসপাতালের অবস্থা তো জানোই। কোভিড হাসপাতালও আশেপাশে নেই, বাবা মা কে নিয়েই চিন্তা, বিভিন্ন রোগে ভুগছে। আমাদের দেখাশুনার তো আর কেউ নেই, তাই যদি একটা সার্টিফিকেট করে দিতে… বাড়িতে অক্সিজেন রাখার জন্য…”
প্রথমে তো এরকম আবদার শুনে কাঁদবো না হাঁসবো, সেটাই ভেবে পেলাম না। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “প্রথমতঃ এখন আমি হোম আইসোলেশনে আছি, দেখা করতে পারবো না। দ্বিতীয়তঃ কোনো ডাক্তার কোনো রোগীকে প্রয়োজন হলে অক্সিজেন দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু বাড়িতে অক্সিজেন মজুত রাখার সার্টিফিকেট দিতে পারে না। আর সবশেষে বলতে পারি, আমি বাড়িতে অক্সিজেন রাখার একদম পক্ষপাতি না। এতে একদিকে যেমন অক্সিজেনের কালোবাজারি কে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, অন্যদিকে শুধুমাত্র অক্সিজেন দিয়েই পুরো চিকিৎসা সম্ভব না।”
ছেলেটা কী বুঝল জানি না। আমার দ্রুত আরোগ্য কামনা করে ফোন রেখে দিল।
ছেলেটার ওপর বিরক্ত হতে গিয়েও পারলাম না। চারিদিকের খবর শুনলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম ছেলেটার বাবা মা ছাড়া তো আর কেউ নেই, ওনাদের কিছু হয়ে গেলে তো ওর জীবনটাই শেষ! যেখানে হাসপাতালে বেড পাওয়াটাই দুষ্কর, ভোট বৈতরণী পাড় করতে গিয়ে স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার যেখানে কারও সময় নেই, সিস্টেম যেখানে বারবার ফেল করছে… সেখানে সাময়িক অক্সিজেন সাপোর্ট তো কিছুটা হলেও একজনের জীবন বাঁচাতে পারে। পাশ থেকে আমার স্ত্রী বলে উঠলো, “যে মানুষটা গোটা পৃথিবীর কাছে একটা সংখ্যামাত্র, সেই মানুষটা হয়তো কারও কাছে গোটা পৃথিবী!”
বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকি, কোনটা বলব। চুপ করে বসে থাকতে দেখে হেড স্যার নিজেই বললেন, “কি মনে হল? যতই নিজে ওপরে ওঠো…সেই পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী…এরাই পৃথিবীতে সবথেকে আপন, বিপদে আপদে এরাই সবথেকে বড় ভরসা!”
অসাধারন। একটা লেখাতে কতকিছু বলা যায়, ন পড়লে অভুক্ত থাকতাম। ভালো থাকবেন।