আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। ধারাবর্ষণে আর বজ্রবিদ্যুতে প্রকৃতির যাবতীয় কালিমা ধুয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির একটানা আওয়াজের একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে। ছোটবেলায় এরকম একটানা বৃষ্টি হলেই মনে মনে বারবার গাইতাম- ‘আমি যে জলসাঘরে বেলোয়ারী ঝাড়।’ তখন ‘জলসাঘর’ মানে বুঝতাম প্রবল বৃষ্টিতে জলাশয় টইটম্বুর। তার মধ্যে ছোট্ট একটা ঘর। খড়ে ছাওয়া। সামনে কাঠের তক্তা দেওয়া পাটাতন। সেই পাটাতনে বসে আমি কোনাকুনি করে চ্যাপ্টা ঢিল ছুঁড়ে দিচ্ছি জলে। চ্যাপ্টা ঢিল জলে একবার ডুবে আবার ভেসে উঠছে, ব্যাঙের মতো। সে এক দারুণ মজার খেলা! জলের মাঝে ঘর কেমন করে হ’ল? তার উত্তর খুঁজতাম ‘বেলোয়ারী’র মধ্যে। জলাশয়ের মধ্যে জেগে উঠেছে এক চিলতে বালির চর। তার ওপরেই ঘর। ঘরের পাশে ছোট একটা ‘ঝাড়’। বাঁশেরই হবে বোধহয়। আজ ভাবতে বসলে নিজেই হেসে ফেলি। ভেবে ফেলার কোনও গন্ডী ছিল না তখন। তখনও যুক্তির বেড়াজালে যা খুশি ভাবনাগুলো আটকা পড়েনি। আচ্ছা, এখনও কেউ কাগজের নৌকো ভাসায়? বর্ষার জমা জলে ঢেউ তুললে নৌকোগুলো দুলতে দুলতে যেত। সামনের নর্দমার কাছটা একটু ঢালু। ওখানে গেলেই নৌকোর গতি হঠাৎ বেড়ে যেত। তারপর একদিকে হেলে গোঁত্তা খেয়ে নর্দমায় গিয়ে পড়তো। পাতিলেবুর গাছটা ফলের ভারে নুয়ে পড়তো। খড়ের গাদার ওপর লাগানো পেঁপে গাছগুলো উল্টে যেত। সামনের মোরাম বিছানো রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো কাঁচা আম, ভাঙা ডালপালা। বাইরে বেরোলে গা শিরশির। জল জমে পুকুর আর রাস্তা একাকার। সেসব আজ বহুদিন আগের আবছা স্মৃতি। আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই তা গেছে।
হাসপাতালের সামনেটায় জল জমেছে। হাঁটতে গেলে গোড়ালি ডুবে যায়। থাকার জায়গাতেও জল ঢুকে এসেছে। চারদিক বৃষ্টিতে ধোঁওয়া ধোঁওয়া। আউটডোর খাঁ খাঁ করছে। শুধু ভ্যাক্সিন নেওয়ার ভিড়। তবে আশঙ্কাজনক রোগীর সংখ্যা খুব একটা কমেনি। কষ্ট করে হলেও তাদের চলে আসতেই হচ্ছে। আগের দিনের সিকল সেল অ্যানিমিয়ার বাচ্চার শারীরিক অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো। রক্ত আর অন্যান্য চিকিৎসা পেয়ে ধুঁকতে থাকা বাচ্চাটা এখন নিজে হাতে খাচ্ছে, কথাটথা বলছে। এটুকুই এ পেশার পুরস্কার। মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে কেটে কেটে বলে দেওয়া যায়- আমি ভয় পাই না।
নবদ্বীপ থেকে এসেছে অয়ন। (নামটা ইচ্ছে করেই বদলে দিলাম) জ্বর, হাড়ে ব্যথা, চামড়ায় লাল-কালো ছোপছোপ, লিভার বেড়েছে, লসিকা গ্রন্থিগুলো ফুলেছে। রক্তের রিপোর্টে লাল রক্ত, সাদা রক্ত সব তলানিতে এসে পৌঁছেছে। রক্ত দিতে হবে। নিশ্চিতভাবে রোগ ধরার জন্য অস্থিমজ্জার পরীক্ষা করা দরকার। যদিও অস্থিমজ্জার পরীক্ষা না করেও বলে দেওয়া যায় খুব সম্ভবত রক্তে বাসা বেঁধেছে কর্কটরোগ! এখন এসবের চিকিৎসা অনেক উন্নত। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হ’লে অনেক রোগীকেই সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা যায়। সকাল সকাল বাচ্চার মা কাঁদতে শুরু করেছে-
– বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দিন না ডাক্তারবাবু… আপনারা ভগবান। আপনারা চাইলে সব পারেন। একটু চেষ্টা করুন না স্যার…
কে বোঝাবে, আমরা কেউ ভগবান নই। ভগবান-ভগবান মিথ্যে বুদবুদটার ভেতরে থাকতে থাকতে আমরা হাঁফিয়ে উঠি। ডাক্তারি একটা বিজ্ঞান। আমরা চাইলেই ফুসমন্তরের ম্যাজিক করে সব সারিয়ে দিতে পারি না। আমরাও ভুল করি। প্রতিদিন ভুল করি, প্রতিদিন শিখি। জানি, প্রিয়জনকে কষ্ট পেতে দেখলে আপনি খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরতে চান। আপনি বুঝতে পারেন না, কখনও ডাক্তার আপনার চেয়েও অসহায়। আপনার তবু ভেবে ফেলার স্বাধীনতা আছে- স্টেথো কাঁধে ‘ভগবান’ কোনও মন্ত্রশক্তিতে সব রোগ ভ্যানিশ করে দেবেন! ডাক্তারের সামনে সেটুকুও রহস্যের ধোঁয়াশা নেই। তিনি মৃত্যুকে বড় পরিষ্কার দেখতে পান। কাঠখোট্টা, আবেগহীন মৃত্যু। আপাতত অয়নের সামনের রাস্তাটার একদিকে খাড়াই পাহাড় অন্যদিকে গভীর গিরিখাত। অনেকটা পথ হাঁটা বাকি। অনেকটা যন্ত্রণা… অনেকগুলো নির্ঘুম রাত…
এক রোগীকে নিয়ে পড়ে থাকার সময় নেই। পাশের ঘরে রোগীর রক্ত কমে যাওয়ার রোগ। পিলে বেড়ে গেছে। শেষবার রক্ত পেয়েছিল এক বছর আগে।
– আগের বার কোত্থেকে রক্ত পেয়েছিল?
– এখান থেকেই
– কাগজ দেখি। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টগুলোও বের করো।
– কাগজ ত কিছু নাই ডাক্তারবাবু।
– নেই মানে? সঙ্গে আনোনি কেন? পুরোনো রক্তের রিপোর্ট না দেখে চিকিৎসা হয় নাকি?
– কাগজ সব হারি গেছে।
– খুব ভালো। কাগজ সব হারিয়ে দিয়ে হাসপাতালে এসে উদ্ধার করেছো। এইটুকু খেয়াল করে রাখতে পারো না, বাচ্চার চিকিৎসা করাবে কী করে?
– (চুপ)
– যাও বাড়ির লোককে বলো, সব খুঁজে বের করে নিয়ে আসতে। কাল যেন নিয়ে আসে।
– সে সব আর পাবা যাবে নি। কথায় গেছে ঠিক নাই।
খুব রেগেমেগে আরও কিছু একটা বলার চেষ্টা করছি, থামিয়ে দিয়ে মা বললো-
– গেল বছর আমফান ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড করে গেছে। পরপর পাঁচদিন তিরপল টাঙিয়া ছিলি। চারদিক ভিজে একসা। কাগজগুলা কথায় গেল কে জানে…