চক্রব্যূহ
দমটম আটকে আসছে। একেবারে বিচ্ছিরি অবস্থার মধ্যে ফেঁসে গেছি। জানি না কবে এর থেকে মুক্তি পাব।
রোজ ঘুম থেকে উঠে প্রায় ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত একই রোগে আক্রান্ত শয়ে শয়ে রোগী দেখে যাচ্ছি। যে রোগের মাথামুণ্ডু কিছুই এখনও ভালো করে বুঝে উঠতে পারিনি। কার যে কি পরিণতি দাঁড়াবে বলা মুশকিল।
রোগীরা সবাই শেষে একটাই প্রশ্ন করেন, ‘ডাক্তারবাবু, ভয় নেই তো?’
উত্তর দিতে গিয়ে ইদানীং মেজাজ হারাচ্ছি। বলছি, ‘আমি জ্যোতিষী নই।’ এই প্রথম মাঝে মাঝে অন্যদের দেখে হিংসে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি যদি ডাক্তার না হয়ে অন্য কিছু হতাম, বেশ হতো। বাড়িতেও সকলের মুখ ভার। রাতে ফিরে যেটুকু সময় বাড়িতে থাকছি সেটুকু সময়েও অজস্র ফোন। একটা ফোনে কথা বলতে বলতে তিনটে মিসকল হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই হাসপাতালে বেডের জন্য, অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য, ভ্যাকসিনের জন্য ফোন করছেন। এসব ব্যাপারে আমার কিছু করার ক্ষমতা নেই বলতেও খারাপ লাগছে। আমি সারাদিন রোগী দেখে বাড়ি ফিরে স্নান করি। ফোনের ঠ্যালায় স্নান করতে করতে রাত বারোটা বাজছে।
মাঝে মাঝেই রোগীরা বেমাক্কা খারাপ হয়ে যাচ্ছেন। আমার আত্মবিশ্বাসে আরও চিড় ধরছে। রাতে শুয়েও শান্তি নেই। অদ্ভুত অদ্ভুত সব দুঃস্বপ্ন দেখছি।
এতো রোগী বেড়ে গেছে যে সকলকে দেখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেককেই ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। তারা যেতে চাইছেন না। কাকুতি মিনতি করছেন। সঞ্জয়দা আর গৌড়কে যাতা বলছেন। এই দুজন আমার মুখ চেয়ে সে সমস্ত কটু কথা হজম করছে। এরা দুজন না থাকলে সম্ভবত সব ছেড়েছুড়ে আমায় পালিয়ে যেতে হতো।
রোগী দেখেও শান্তি নেই। ফোন পাচ্ছি, ‘ডাক্তারবাবু, কোথাও ডক্সিসাইক্লিন পাচ্ছি না। আইভারমেক্টিন পাচ্ছি না। কী করব?’ কী উত্তর দেব জানি না। ডক্সিসাইক্লিন, আইভারমেক্টিন আদৌ কোভিডে কতটা কাজে লাগে তাও জানিনা। সরকারি প্রটোকলে আছে বলে প্রেসক্রিপশের পর প্রেসক্রিপশনে একই ওষুধ লিখে চলেছি। যার ফলে অভাব আরো তীব্রতর হচ্ছে।
টেস্টের কথা আর বলে লাভ নেই। এক ভদ্রলোক পাঁচদিন পরে এসেছেন। কাশি আর জ্বর কমার বদলে দুটোই বেড়েছে। বললাম, ‘পরীক্ষা করাননি কেন?’
উনি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, দুদিন পরপর গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে ঘুরে এসেছি। পঞ্চাশ- ষাট’টা পরীক্ষা হবে। অন্তত শ’তিনেক রোগী লাইন দিয়েছে। রীতিমতো মারামারি হচ্ছে। বেসরকারি জায়গায় করানোর ক্ষমতা নাই।’
রাতারাতি পালস অক্সিমিটারের দাম বেড়ে গেছে। আইভারমেক্টিন যেটির আদৌ কোভিডে কোনো ভূমিকা আছে কিনা বলা মুশকিল সেটা নিয়েও কালোবাজারি শুরু হয়েছে। অনেকেই টেস্ট করাতে পারছেন না, একটা পালস অক্সিমিটার জোগাড় করতে পারছেন না, রোগীকে কোথাও ভর্তিও করতে পারছেন না। ভগবানের উপর ভরসা করে রোগীকে বাড়িতে ফেলে রাখছেন। ভগবান যে গরীব মানুষের উপর বিশেষ সদয় নন, সেটা ডেথ সার্টিফিকেট লেখার সময় হাড়ে হাড়ে বুঝছি।
অথচ পরিস্থিতি দিব্যি অন্য রকম হতে পারত। আমরা প্রথম ঢেউয়ের পর অনেক সময় পেয়েছিলাম। চিকিৎসকরা সেসময় বারবার সতর্ক করেছেন দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে। সেসময় অঞ্চল ভাগ করে দিব্যি ফিভার ক্লিনিক গড়ে তোলা যেতো। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, করোনা পরীক্ষার জন্য কিট মজুত করে রাখা যেতো। নার্সিং স্টাফ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের জ্বরের রোগীর চিকিৎসার জন্য দিব্যি কাজে লাগানো যেতো। সরকারি হাসপাতাল গুলোয় উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরী করা যেতো।
তার বদলে কয়েকদিন আগে পর্যন্তও হাজার হাজার লোক নিয়ে রাজনৈতিক মিটিং মিছিল চলেছে। আমাদের দেশ চালানোর দায়িত্ব যাদের হাতে তাঁরা সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরীর বদলে পরস্পরের প্রতি কুৎসায় মেতেছেন। ধর্মের নামে মানুষ খেপিয়েছেন। আর ভোট মিটতেই সব ধর্মের মানুষ যখন সংকটে তখন তাঁদের সংকট আরো বাড়িয়ে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। লোকাল ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
রোগীরা অনেকেই এখন বলছেন, ‘ডাক্তারবাবু, এরচেয়ে কমদামের বিষ লিখে দিন। খেয়ে একেবারে মরে যাই।’
এক মুসলিম যুবক দেখাতে এসেছিলেন। তাঁর বাবা দুদিন আগেই করোনায় একটি সরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন। তাঁরও জ্বর আসছে। তিনি বলছিলেন, ‘ডাক্তারবাবু, বাবা আজ পর্যন্ত সব রোজা করেছেন। এবার জ্বর আসার পরে অসুস্থ শরীরেও প্রথম তিনদিন রোজা রেখেছিলেন। আর কি হয়ে গেল!’
যে কটি ছেলে মাঠে ময়দানে নেমে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছিল তারাও ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যেও হতাশা আসছে। এই মুহুর্তে অন্যরাও এগিয়ে না এলে তারা বেশীদিন লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে না।
জানি না শেষ পর্যন্ত কী হবে? যখন এই মহামারীর ইতিহাস লেখা হবে, সেটা পড়ে ভবিষ্যতের মানুষরা আমাদের কী ভাববে? কাপুরুষ, স্বার্থপর, ধান্দাবাজ নাকি বোকাহাবা?
A REQUIEM –MOST POIGNANT SINCE THAT OF MOZART’S SINCE : 1791 Dec ( … unfinished)
———- nirmalyada