ব্রজ রায়। জন্ম ১৯৩৬ সালের ৩০ নভেম্বর ২৪ নম্বর গোবিন্দ বোস লেন, ভবানীপুর এ বাবা মায়ের অষ্টম সন্তান। বাবা নিরঞ্জন রায় মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ।মা বঙ্গলক্ষী রায়। খুবই আর্থিক অনটনের সংসারে শিক্ষকদের প্রিয়পাত্র ব্রজ রায় এর লেখা পড়া হয়।
পনেরো বছর বয়সে স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতা বাপি চ্যাটার্জির সখ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯৫৩ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগদান করেন। ১৯৫৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। কয়েক মাস পর পোস্ট অফিসের চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৬৬র ১ মে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। মনোযোগ দিলেন নাটকে। তৃপ্তি চৌধুরীর সহায়তায় ১৯৬৬ সালের১৩ অক্টোবর ক্লেমব্রাউন মঞ্চে ‘ওরা অন্ত্যজ ‘ নাটক দিয়ে শুরু। মায়াকোভস্কি (সাম্যবাদী তো সেই/যে পোড়ায় পেছু হঠবার অসহ্য সেতুটাকে।) আবৃত্তি করতে করতে তৃপ্তি চৌধুরীর হাত নিজ হাতের অঞ্জলিতে নিয়ে তিরিশ বছর বয়সে যৌথ মাত্রা শুরু করেছিলেন।
তখন ব্রজ রায় এর চিন্তা ভাবনা আর সি সি আইকে নিয়ে। সংগঠনের ফান্ড বাড়িয়ে পৃথিবী পাল্টানোর স্বপ্নে ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই অনন্ত সিং এর নেতৃত্বে পার্ক স্ট্রিট এর কাছে পোস্টাল ক্যাশ ভ্যান ডাকাতিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন। আমেরিকান লাইব্রেরীর জন্য বরাদ্দ কৃত পার্শেল বোমা কলকাতা জি পি ও তে বিস্ফোরণ এর কারণে ১১ নভেম্বর ১৯৬৯ ব্রজ রায় আর তৃপ্তি চৌধুরী গ্রেফতার হন। এ পি ভি আর এর সম্পাদক দেবাশিস ভট্টাচার্য এর সাথে জেলে বসেই সখ্যতা হয়। ১০ ডিসেম্বর ১৯৭৮ ঐ সংগঠনের মিছিলে পা মেলান তিনি।১৯৮৫ সালের ৫ নভেম্বর ব্রজ রায় তৃপ্তি চৌধুরী সহ পাঁচ জন জে বি এস হলডেন এর মৃত্যু দিবসে সিদ্ধান্ত নেন মরনোত্তর দেহদান এর মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি ও কলা ও প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন এর আন্দোলনের সূত্রপাত করার।
এর পরে এক সঙ্গে ৩৪ জন অঙ্গীকার পত্রের স্বাক্ষর করে গণদর্পণ এর মাধ্যমে সরকারের পক্ষের ডাঃ কালিকিঙ্কর ভট্টাচার্য এর হাতে অর্পণ করা হয়। এ ছাড়াও তিনি নর্মান বেথুন জনস্বাস্থ্য আন্দোলন, উৎসমানুষ, পি আর সি , পরিবেশ আন্দোলন , বিজ্ঞান আন্দোলন সহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ও বৃহত্তর বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে সমস্ত আন্দোলনের শরিক ছিলেন।
ব্রজ রায়ের মৃত্যুতে সমাজ একজন সরল , একনিষ্ঠ, বিজ্ঞান মনস্ক প্রতিবাদী মানুষকে হারালো। বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের স্মৃতির প্রতি।
১৪ই এপ্রিল, ২০২১
আজ ব্রজ রায়ের মরদেহ সরকারি ব্যবস্থাপনায় শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল থেকে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে রোগ নির্ণায়ক ময়না তদন্ত হবে। করোনায় মৃত মানুষের এই পরীক্ষা হবে। যা এশিয়া মহাদেশে প্রথম । তারপর দেহ সরকারি ব্যবস্থাপনায় সৎকার করা হবে। এই ব্যবস্থার দাবী ব্রজদা দীর্ঘদিন করে এসেছেন। আজ ব্রজদার দেহ দিয়েই এই মহাদেশে সম্ভবত প্রথম প্যাথলজিক্যাল অটোপসি হতে চলেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক মাইল ফলক। রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের পূর্ণ সহযোগিতায় এই কাজ হতে চলেছে।
ডা জয়ন্ত ভট্টাচার্য লিখলেন
গতকাল গণদর্পন তথা পশ্চিমবঙ্গে মরণোত্তর অঙ্গ ও দেহদান আন্দোলন এবং চেতনার প্রাণপুরুষ ব্রজদা কোভিডে প্রয়াত হয়েছেন।
একজন individual কিভাবে institution হয়ে ওঠেন তার এক জীবন্ত দলিল ব্রজদা। তাঁকে নিয়ে আমার ছোট্ট স্মৃতিচারণ।
######
১৯৯৬ সালের কথা। রায়গঞ্জে ব্রজদা এলেন আমাদের বাড়িতে। উপলক্ষ্য আমার বৃদ্ধা মা (স্বপাক ব্রাহ্মণ বিধবা) তাঁর মরণোত্তর দেহ ও অঙ্গদানের অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করে ব্রজদার হাতে তুলে দেবেন বলে। মা-র অঙ্গীকারপত্র হাতে নিয়ে ব্রজদা বলেছিলেন – “মাসীমা আপনাকে একটা প্রণাম করি?”
মা-র দেহ উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে দিয়ে এলাম ২২শে জানুয়ারি, ২০০৯-এ। উত্তরবঙ্গে প্রথম মরণোত্তর দেহদান। মা-র দেহ নিয়ে যাত্রা করার আগে রায়গঞ্জ আই ব্যাংক মা-র দুটো কর্নিয়া নিয়ে নিয়েছিল। ২৬ জানুয়ারি, ২০০৯-এ সে কর্নিয়া উত্তরবঙ্গে প্রথমবারের জন্য প্রতিস্থাপিত হয়েছিল প্রায় অন্ধ ১৩ বছরের অনেকা দেবশর্মার চোখে। ও পরে মাধ্যমিক পাস করেছিল।
ব্রজদা মা-র স্মরণ সভার জন্য একটি দীর্ঘ মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেছিলেন। আমাদের মাঝে এক অনির্বচনীয় সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।
ব্রজদা স্মৃতি হয়ে গেলেন। আমার মাকে এ কথা আর জানাতে পারবোনা। হয়তো ঐ দূরের নীহারিকায় দুজনের দেখা হবে, কথা হবে।???
অনেক অজানা তথ্য জেনে সমৃদ্ধ হলাম
ব্রজ রায় এর মতো সমাজে নতুন দিক দর্শনের , নতুন পথে পা ফেলার মানুষের প্রয়োজন চিরকালীন .
একটি অন্য ধারার মানুষ। যা বিশ্বাস করতেন তার জন্য মন দিয়ে কাজ করতেন। কখনও প্রচার চান নি, সুবিধা চান নি, শুধু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
প্রণাম মানুষটিকে। দেহদান আন্দোলনের মধ্যেই উনি বেঁচে থাকবেন।
ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য নিজেও এই আন্দোলনের শরিক। ওঁকেও নমস্কার।
ওনাকে প্রণাম। লেখার গুনে ওনার অসাধারণ জীবন আরও মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে
ছোট, অথচ সুন্দর স্মৃতিকথিকা। চিরদামাল যুবকটিকে আবার এনে দিল আমাদের সামনে।
তবে, শেষ বাক্যের ভাবালুতা জয়ন্তানুগ নয়।