খবরের কাগজের প্রথম পাতা হোক কিংবা চ্যানেলের প্রাইম টাইম, দলীয় রাজনীতির আলোচনা না হলে যেন সবটাই ফিকে! কিন্তু এক ছোট্ট ভাইরাস বদলে দিলো সবকিছু।
স্বাস্থ্য বিষয়টি বরাবর এ দেশে পিছনের সারিতে থাকে। শুধু সংসদের আলোচনা, বাজেট বরাদ্দ কিংবা নির্বাচনের ইস্যুতে নয়। এ দেশে সংবাদ মাধ্যমেও গুরুত্বের নিরিখে এই বিষয়ের স্থান বেশ পিছনে। গত এক বছরে অবশ্য পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেল যে।
২০২০ সালে যখন ইতালি, ফ্রান্স, এমনকি আমেরিকার মতো বিশ্বের প্রথম সারিতে থাকা দেশগুলো নাকানিচুবানি খাচ্ছিলো, তখনি প্রথম ধাক্কা লাগে, আর এখন ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে করোনা মহামারি যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তাতে ভারতের অবস্থা করুণ বললেও মনে হয় কম বলা হবে।
যুদ্ধ বিমান, পরমাণু শক্তি, কূটনীতির কৌশল সব যেন গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। জীবন যে কতখানি দামি, তা যেন একবার গোটা বিশ্বকে ঝাঁকিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে একটা ভাইরাস। এক মহামারির কবলে গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
ভারতের মতো দেশে স্বাস্থ্য বরাবর তলানিতে। বাজেট বরাদ্দ ২ শতাংশের কম। করোনা আবহেও সেই পরিস্থিতির বিশেষ বদল হয়নি। জনস্বাস্থ্য নিয়ে বাড়তি পরিকল্পনা তো দুর অস্ত। নূন্যতম কর্মসূচিও নির্ধারণ করা হয়নি। কারণ, কেন্দ্র-রাজ্য নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দল ও সরকার তখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এই যে স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা, তার দায় যেমন নিঃসন্দেহে সরকারের, তেমনি এই দায় কি সংবাদ মাধ্যম এড়িয়ে যেতে পারে?
স্বাস্থ্য সংবাদ বলতেই বোঝানো হয়, কোন হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়নি, কিংবা কোন চিকিৎসকের গাফিলতিতে কোন রোগী মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে, ব্যস এই টুকুই। এর বাইরে দেশের জনস্বাস্থ্য নীতি নিয়ে খবর কিংবা আলোচনার জন্য সংবাদপত্রের পাতায় জায়গা নেই। মানুষের আগ্রহ নেই। তাই ও খবর কেউ শুনবে না। এই বলেই আমরা দায় এড়িয়ে গিয়েছি। যার মাশুল আমাদের গুনতে হচ্ছে। কেন ভারতে স্বাস্থ্য বরাদ্দ কম এ নিয়ে হাতে গোনা কয়েকটা প্রতিবেদন হয়েছে। কিংবা এ দেশে প্রাথমিক স্তরের স্বাস্থ্য পরিষেবায় স্বাস্থ্য কর্মীর সঙ্কট কেন, এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমও বিশেষ মাথা ঘামায় না।
বিশ্বের যে কোনও শিক্ষিত সমাজের মানুষ স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। সেই আগ্রহ গড়ে তোলার পিছনে সংবাদ মাধ্যমের যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা মানুষকে সংবাদ পরিবেশন করেছেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে বাড়তি নজর দিয়েছে। মানুষ পড়েছেন, দেখেছেন। সচেতন হয়েছেন।
আর এ দেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম মনে করে, রাজনৈতিক হিংসা আর দলীয় চর্চার বাইরে সবকিছুই বড় অপ্রয়োজনীয়।
যদি মেনে নেওয়া হয়, জনস্বাস্থ্য, বিজ্ঞান নিয়ে ঘণ্টা খানেক আলোচনা হলে মানুষ আগ্রহ দেখাবেন না, তার দায় ও কিছুটা সংবাদ মাধ্যমের নিতেই হবে। কারণ, আমরা যারা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা মানুষের মধ্যে সেই আগ্রহ গড়ে তুলতে সক্ষম হইনি।
সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের রয়েছে। এই দায় এড়ানোর জায়গা নেই। তাই আজকে ভারতে যখন দৈনিক করোনা সংক্রমণ চার লাখ ছাড়িয়েছে, যখন সাধারণ মানুষের দিনের পর দিন অসতর্ক ভাবে বাইরে যাওয়া, সামাজিক দূরত্ব বিধি না মেনে চলা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তখন সরকারের পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন থাকছে।
ফেব্রুয়ারির শেষে নির্বাচনের দামামা বাজতেই কিন্তু এ রাজ্য থেকে মহামারির খবর প্রায় ‘উধাও’ হয়ে গেল। সংবাদপত্র কিংবা খবরের চ্যানেলে চোখ রাখলে মনে হচ্ছিলো, দেশে আর করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব নেই।
গত কয়েক মাসে একবারের জন্যও প্রশ্ন তোলা হয়নি, অক্সিজেন প্লান্ট তৈরির কাজ কতখানি এগিয়েছে?
ভ্যাকসিনের জোগান ঠিক হবে তো? দ্বিতীয় ঢেউ আসলে রোগী সামলানোর পরিকল্পনা কতখানি বাস্তবায়ন হচ্ছে?
প্রশ্নগুলো তুললেই যে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে যেত এমন না। কিন্তু প্রশ্ন তোলা যে জরুরি। এই প্রশ্ন করতে ভুলে গেলে, যে একদিন সংবাদমাধ্যম তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে।
করোনা মহামারি শুধু সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোকে নয়, দেশের সংবাদ মাধ্যমকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, ‘স্বাস্থ্য ই সম্পদ’ শুধু স্কুল পাঠ্যে আটকে থাকলে আমরা কেউ রেহাই পাবো না।