বুধন ওঁরাও এর শূন্য উদাস দৃষ্টি কেন জানি না আজও হন্ট করে। বুধন ছিল মিনগ্লাস চা বাগানের কর্মী। কুলি লাইনে গিয়েছিলাম বুধনের ঘরে। তার স্ত্রী মারা গেছে ম্যালেরিয়ায়। সময়টা ২০০৮ সাল। মালবাজার, জলপাইগুড়ি। মশামাছির মতো মানুষ মরে যাচ্ছে ম্যালেরিয়ায়। আমি গেছি ডেথ অডিট করতে। সদ্য স্ত্রী বিয়োগের শোক সামলে বুধন উত্তর দিচ্ছিল শান্তভাবে আমার প্রশ্নগুলির। উঠে আসার আগে পাল্টা প্রশ্ন হঠাৎ। ডাক্তারবাবু, ওষুধ তো নিয়ম করে খাইয়েছিলাম। তাও কেন মরে গেল বৌটা ? কোনো উত্তর ছিল না আমার কাছে। গাড়ি ঘুরিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলাম। বিকল্প ওষুধ তখন ছিল না আমার হাতে।
সেই সময়ের জলপাইগুড়ি জেলার ডেপুটি সি এম ও এইচ বিক্রমদা, ড: বিক্রম সিং বসুমাতা। পশ্চিমবঙ্গের যে দুজন জনস্বাস্থ্য আধিকারিক ম্যালেরিয়াটা গুলে খেয়েছেন তাঁদের একজন। ম্যালেরিয়া নিয়ে যা কিছু শিখেছি সেটা ওই বিক্রমদার পায়ের তলায় বসেই শিখেছি। আমার গুরুদেব। বিক্রমদার উদ্যোগে ভারত সরকারের টিম এলো সার্ভে করতে, ক্লোরোকুইন সেনসিটিভিটি স্টাডি। প্রমাণিত হল যে ক্লোরোকুইন কাজ করছে না। তাহলে বিকল্প কি? বুধনের মতো হৃদয় বিদারক কাহিনীর কি তাহলে অন্ত নেই?
বিকল্প ওষুধ ছিল না হো চি মিনের হাতেও। ১৯৬৭ সালে হো চি মিন বিশেষ অনুরোধ পাঠালেন চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই কে। বন্দুক, কামান, গুলি গোলা নয়, ওষুধ চাই বলে। এমন ওষুধ যেটা আবিষ্কার হয় নি। ওই সময়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের গাদাগুচ্ছের গেরিলা যোদ্ধা ম্যালেরিয়ায় পটাপট মারা যাচ্ছিল। বাজার চলতি ওষুধ ক্লোরোকুইন কাজে দিচ্ছিল না। তাই এই নতুন ওষুধের আবদার।
চীনের দক্ষিণ প্রদেশগুলি যেমন হাইনান, উনান, গুয়াংসি, সেখানেও একই অবস্থা। চৌ এন লাই তখন মাও সে তুং কে বুঝিয়ে ওষুধ আবিষ্কারের জন্য একটা গোপন প্রজেক্ট চালু করেন। নাম প্রজেক্ট ৫২৩। তারিখ ২৩শে মে, ১৯৬৭ সাল। প্রজেক্ট ৫২৩-এর প্রধান হিসেবে ১৯৬৯ সালের গোড়ার দিকে নিযুক্ত হন বেজিং মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি অফ ফার্মাসির ছাত্রী স্নাতক তু ইউ ইউ। বয়েস তখন ৩৯ বছর। চীনা ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন ঘেঁটে ঘুটে প্রায় ৬৪০ টা ওষুধ চিহ্নিত করেন তু। অবশেষে আর্টিমিসিয়া আনুয়া হার্ব এর থেকে তৈরি হল ওষুধ। ডাই হাইড্রো আর্টিমিসিনিন। ইঁদুর, বাঁদরের পর্ব পেরিয়ে হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট। ফার্মাসিস্ট তু নিজের শরীরে প্রয়োগ করলেন।
সফল ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের শেষে ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হল সায়েন্টিফিক জার্নালে পেপার নাম না দিয়ে। ১৯৮১ তে ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের মিটিং-এ তু পাঠ করলেন তাঁর প্রবন্ধ। ২০১৫ সালের ৫ই অক্টোবর তু আরো দুজনের সাথে ভাগাভাগি করে নিলেন মেডিসিনের নোবেল প্রাইজ প্রথম চীনা মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে।
গঙ্গা, তিস্তা আর মেকং দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। হো চি মিন, চৌ এন লাই, মাও সে তুং মারা গেছেন অনেকদিন। এই আবিষ্কার হো চি মিনের প্রা প্রিয় গেরিলাদের কোনো কাজে লাগে নি। ওটা ছাড়াই তারা দোর্দন্ডপ্রতাপ আমেরিকানদের দেশ ছাড়া করেছিল। সে অন্য প্রসঙ্গ। জলপাইগুড়িতে ফেরত আসি।
ভারত সরকারের স্টাডি রিপোর্ট সরকারি ভাবে আমাদের হাতে আসতে অনেক দেরি। ততদিন হাতে হাত রেখে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। সেই সময় স্বাস্থ্য সচিব উচ্চ পর্যায়ের টিম নিয়ে জেলায় আসলেন অন্য কাজে। সিএমওএইচ ভূষণ স্যার, ড: ভূষণ চক্রবর্তী সেই টিমের হাতে পায়ে ধরে কিছু অর্থ বরাদ্দ করতে সফল হলেন। কর্তৃপক্ষকে অর্থ বরাদ্দ করতে আরেকজনের উজ্জ্বল ভুমিকা ছিল। তাপস দা, প্রয়াত ড: তাপস সেন। আমার আরেক গুরুদেব। যাই হোক, ওই বরাদ্দ দিয়ে আমরা এসিটি কিনলাম। আর্টেমিসিনিন কম্বিনেশন থেরাপি। ক্লোরোকুইন রেজিস্ট্যান্ট ম্যালেরিয়ার একমাত্র ওষুধ। ম্যাজিকের মত কাজ। ক্লিনিশিয়ান বন্ধুরা খুশি। পেসেন্টরা খুশি, পেসেন্ট পার্টিরা খুশি। স্বাস্থ্য দপ্তরের জয় জয়কার।
আজ যদি ভাবতে বসি, তাহলে মনে হয় সবচেয়ে বড় জয়ধ্বনিটা বোধ হয় ওই নোবেলজয়ীর প্রাপ্য ছিল। যিনি তাঁর দেশের ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের ভূমিকাকে উপনিবেশিক দাসত্বের বশে অবহেলায় উড়িয়ে দেন নি। আমাদের দেশেও গাছ গাছড়া থেকে তৈরি ওষুধ ব্যবহারের একটা ঐতিহ্য আছে। দুঃখের বিষয় যে ওই জ্ঞান ভান্ডারকে আমরা, মর্ডান মেডিসিনের লোকজন তেমন ভাবে কাজে লাগাতে পারলাম না, কিছু ভুলভাল বাবা’রা তাই নিয়ে ব্যবসা করে কোটি টাকা কামিয়ে নিল অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা করে। “উড়াইয়া দেখ ছাই পাইলেও পাইতে পারো অমুল্য রতন।” এই প্রবাদ বাক্য অনুসরণ করে আমাদের দেশে কবে একজন ফার্মাসিস্ট রিসার্চ সায়েন্টিস্ট তু-কে আমরা খুঁজে পাবো? কবে? এসিটি ও যদি কালের নিয়মে অকেজো হয়ে যায়? নতুন ওষুধ কই? বিশ্ব ম্যালেরিয়া বিরোধী দিবসে আজ দেশ জুড়ে অনুষ্ঠিত সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, মিটিং মিছিলের ভিড়ে সামান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সামান্য জিজ্ঞাসা থাকলো আপনাদের কাছে।
২৫শে এপ্রিল, ২০২৪
দারুণ লেখা। এখন এ যে কত বৎসর ধরে এই এক মূর্খ ধান্দাবাজ প্রধানমন্ত্রীর রাজত্বে বাস করে যাব!
যে বিন্দুমাত্র তার দেশ কে দেশের মানুষ কে ভালোবাসে না।আর কিছু ভক্ত অন্ধের মতো একেই তোল্লা দিয়ে যাবে।
ভালোবাসা💙।লেখাটার আন্তরিক প্রাণ টায়।💕🙏
কিছু তো লিখতে পারতা গো।
কতদিন যে লেখো না।💙🙏