ইয়াস দীঘায় গেছে। মৃদুমন্দ মেঘ লুকোচুরি খেলছে। আমি চশমা ঠিক করে দূরে নিমগাছ দেখছিলাম। ঝিরিঝিরি পাতা ফুরফুরা বাতাস।সব মিলে চমৎকার ব্যাপার। এমন সময় তিনি এলেন। মাঝারি উচ্চতা, ছোটোখাটো ভুঁড়ি, দুপাশে বিস্তীর্ণ টেম্পোরাল টাক, মাথার পেছনে একটা ঘোড়ার ন্যাজের মতো ঝুঁটি, ছোট্ট ছাগল দাড়ি। পরনে একটা হাফহাতা গেঞ্জি- ওপরের অংশটা নীল, মাঝেরটা সাদা, নিচের অংশটা লাল; হাফপ্যান্ট কমলা রঙের, মোজাছাড়া সাদা জুতো এবং হাতে একটা লম্বা হাতলওয়ালা বাঁশ তাতে এক টুকরো কালো কাপড় ঝুলছে। হাঁদা ভোঁদা আর নন্টে ফন্টের বাইরে এরকম চমৎকার চরিত্র আমি কোথাও দেখিনি। (আশাকরি উনি আমার ফেসবুক পড়েন না, নাহলে রামকৃষ্ণ যাদবের মতো আমিও একহাজার কোটি টাকার মানহানির কেস খেয়ে যাবো)
“দাদা করোনা হলে প্রথমেই স্টেরয়েড ক্যানো খাবো?”
আমি একবার নিমগাছ আরেকবার ওনার মাথার ন্যাজটা দেখলাম, দুটোই হিলিহিলি বাতাসে ফুরফুরাচ্ছে। অনেক ভেবে উত্তর দিলাম “যাতে মরে না যান-সেই জন্য”
নবাগত ওনার হাতলওয়ালা কাপড় ঝোলানো বাঁশে একটু ভর দিয়ে বললেন “তারপর? স্টেরয়েড বন্ধ করলেই আবার করোনা হয়ে মরবো নাকি?”
আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম “সে আবার কিরকম কথা হলো?”
“জানেন না? স্টেরয়েড অসুখটা চেপে রাখে? তারপর ওটা বন্ধ করলেই সোডার মতো ভসভস করে ফুলে ফেঁপে বেরিয়ে ওঠে?”
আমি মাথা টাথা চুলকে বললাম “তাই নাকি?”
উনি ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভুরু টুরু কুঁচকে আমাকে খানিক দেখলেন তারপর বললেন “জানেন না? লোকে যে বলে আপনি ডাক্তারি করেন?” ওনার বিষ্ময় ছাগলদাড়ি বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।
আমি বলি “দুর্মশয়-ডাক্তারি করতে গেলে কী আবার ডাক্তারি জানতে হয় নাকি? আপনি তো আমাকে অবাক করলেন গো!” আমার মুখটাই বিষ্ময়বোধক চিহ্নের মতো দেখায়।
তবুও ভদ্রলোকের জিজ্ঞাসা শেষ হয় না। “স্টেরয়েড যদি খাইও-মানে যদি একান্তই খেতে হয়” ভদ্রলোক একান্তে প্রশ্ন করেন “তাহলে কতোদিন খাবো?”
আমি ফিসফিস করে বলি “যতদিন করোনা-বিদায় না হয়, ততদিন”
ভদ্রলোক বোধহয় এরকম নির্বোধ মার্কা উত্তর ঠিক আশা করেন নি। যৎপরনাস্তি বিরক্ত হয়ে ছটফট করে ওঠেন “আঃ, সেটা কতোদিন?”
“কম ইনফেকশন হলে দু হফতা, মাঝারি বা বেশী হলে ছয় হফতা অবধি”
“কিন্তু স্টেরয়েড কী কাজ করবে দাদা? যে ওটাই খেতে হবে? চিরটা কাল শুনলাম স্টেরয়েড খেতে নেই আর আজ শুনি উল্টো কথা”
আমার খুব মিচকি হাসি পেলো। মিচিক করে হেসে নিলাম। “য্যামন কুকুর তার ত্যামন মুগুর। করোনা শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে,আমাদের রোগ প্রতিরোধ করার জন্য তৈরি সৈন্যসামন্ত দিয়ে আমাদেরই শরীর ধ্বংস করার চেষ্টা করে আর আমরা স্টেরয়েড দিয়ে সেই প্রয়াসে ব্যাগড়া দিই”
সম্ভবতঃ ভদ্রলোক বোঝেন নি অথবা বুঝেছেন। তোম্বা মুখ করে খানিকটা কী ভাবলেন তারপর আমার বসার ভাঙা পাঁচিলে বসে ওনার বংশদন্ড ধরে বললেন “ধরুন এটা আমার গিন্নী,”। আমি মনে মনে ধরলাম। বাস্তবে ওনার গিন্নীকে ধরার দুঃসাহস আমার নেই।
“ধরুন গিন্নীর করোনা হয়েছে” তারপর উনি কাদামাখা রাস্তায় একটা দাগ কেটে বললেন “ধরুন এটা আমার গিন্নীর শুগার”। তারপর বললেন “স্টেরয়েড খাওয়ালে শুগার বেড়ে যাবে” বলে উঠে দাঁড়িয়ে ঐ দাগটা লাঠির ডগা দিয়ে টেনে লম্বা করতে লাগলেন।
দেখলাম বুড়ো রাস্তা টাস্তা টপকে চলে না যায়। তাই চটপট থামিয়ে দিয়ে বললাম “আরে কি মুশকিল, করেন কী? এবার তো রাস্তার কাদায় গড়াগড়ি খাবেন বরং থাক স্টেরয়েড খাওয়ানোর মোটেই দরকার নেই। আপনি বসুন”।
ভদ্রলোক কমলা প্যান্টের পেছনটা একটু ঝেড়েঝুড়ে ফের থেবড়ে বসলেন। বিজয়ী মার্কা মুখ করে বললেন “দেখেছেন? কত্তো সহজে বুঝিয়ে দিলাম। এবার বলুন দেখি না খাওয়ালে কী হবে?”
একটা ঝোড়ো কাগ ধড়ফড়িয়ে উড়ে গেল। মনে হয়এবার আবার বৃষ্টি হবে। চটপট উত্তর দিলাম “না না, সেরকম কিছু হবে না তবে মরে যাবেন”
যুগপৎ বিষ্মিত এবং আশ্চর্যান্বিত ভদ্রলোক বললেন “তাহলে?”
“তাহলে শুগারের ওষুধপত্র বদলাতে হবে” বলতে না বলতেই হাওয়া হিড়হিড় করে বৃষ্টিকে টানতে টানতে নিয়ে এলো। প্রথমে ঝিরিঝিরি তারপর গুড়িগুড়ি শেষে খলবলিয়ে।
ভদ্রলোক ধড়ফড় করে উঠে লম্বা বাঁশের লাঠিটাকে টিপেটুপে দিতে একটা কালো ছাতাপড়া কাপড় ফস করে খুলে গেল। উনি ওটা মাথার ওপরে তুলে ধরে হাঁটা দিলেন। আমি পাজামা গুটিয়ে বৃষ্টি পোয়াতে লাগলাম।
ছাব্বিশে মে কুড়ি একুশ, সন্ধ্যা আট্টা চৌচল্লিশ।
(দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বিশেষজ্ঞ)