পেট্রোল পাম্পে ঢুকল বিদিশা। স্কুটিতে তেল একটু কম আছে। হেলমেটের স্ট্র্যাপটা ঢিলে করে সীটটা খুলে উঠিয়ে দিল যেমন দেয়। তারপর ফুয়েল ট্যাংকের ঢাকনাটা খুলে পাম্পের ছেলেটার দিকে একশ টাকার তিনটে নোট বাড়িয়ে দিল। অনেকদূর যেতে হবে। পেট্রল একটু বেশী করে নিয়ে নেওয়া দরকার।
‘আর যাচ্ছে না দিদি।’
সম্বিত ফিরতে বিদিশা দেখে ডিস্পেন্সারের ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ড দুশো তিয়াত্তরে আটকে গেছে।
‘ঠিক আছে, ওটাই দাও।’
বলতে না বলতেই একটা কালো রঙের হন্ডা সিটি গাড়ি ব্যাক গিয়ারে গড়িয়ে এসে স্কুটিটাকে হাল্কা ধাক্কা মারল। বিদিশা চেঁচিয়ে উঠল, ‘কি হচ্ছে কি? গাড়িটা দেখে ব্যাক করতে পারছেন না?’
চটজলদি কালো গাড়িটার নম্বর প্লেট সহ ছবি তুলে রাখল সে। গাড়িটা ড্রাইভ করছে বছর তিরিশ-পঁয়ত্রিশের এক যুবক। পাশের সীটে বসে এক মহিলা। আধুনিক সাজগোজ। মহিলা গাড়ির দরজা খুলে পাল্টা বিদিশার উপরে চেঁচাতে যেতেই, ভদ্রলোক তাকে থামিয়ে দিয়ে বিদিশা-কে বলল, ‘স্যরি,আমারই ভুল হয়েছে ম্যাডাম। আপনার স্কুটির ড্যামেজ চার্জ আমি দিয়ে দেব।’
দেখা গেল স্কুটির বিশেষ কিছু ক্ষতি হয় নি। তাই বিদিশা বলল, ‘তার দরকার নেই। সেরকম কিছু হয় নি।’ তার কাজে যাওয়ার তাড়া আছে। করোনার মধ্যে ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই।
গাড়ির পাশের সীটের মহিলাটি তখন মোবাইলে কথা বলছে। তার কোলে খুলে রাখা একটা বাড়ির প্ল্যান বলে মনে হল। আর ড্যাশবোর্ডে রাখা খুব দামী কোম্পানীর একটা কসমেটিকের সেট। ভদ্রলোক কসমেটিক-এর সেটটা দেখিয়ে কি একটা বলল মহিলাটিকে। মহিলার চোখদুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপর সে নিজের মুখের মাস্ক দেখিয়ে কি বলল শোনা বা বোঝা গেল না। তেল নেওয়া শেষ। পেমেন্ট করে গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে চলে গেল।
লকডাউনের মধ্যে নিউটাউনের এদিকে একটাই পেট্রোল পাম্প খোলা আছে। রাস্তাঘাট খাঁ-খাঁ। ভর দুপুরেও ভয় ভয় লাগে। এমার্জেন্সী সার্ভিস ছাড়া কোনো গাড়ি রাস্তায় বেরোনোর কথাই নয়। এই কালো গাড়িটার কি এমন এমার্জেন্সী কাজ থাকতে পারে! গাড়িতে তো কোনো স্পেশাল লকডাউন পারমিটও লাগানো নেই। কে জানে, আমাদের এই দেশে উঁচুমহলে যোগাযোগ থাকলে সবকিছুই সম্ভব!
২
বিদিশা প্যানাসিয়া হাসপাতালের নার্স। তাকে নিজের কাজে যেতে হবে। অপারেশন থিয়েটারে কাজ করে সে। নার্সদের বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাস দিয়েছে এই লকডাউনে। কিন্তু সে স্কুটার চালাতে জানে, গাড়িও। স্কুটার চালানো সেফ। এতে বাসের মত অন্যদের থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা কম। আর তাছাড়া ফেরার সময় ষ্টাফ বাসের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না।
খুব দরকার হলে, বিশেষতঃ ছুটি পেতে অনেক রাত হয়ে গেলে, ছোড়দা প্রবীর ওর পুলিশের গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দেবে সে ভরসা আছে। ওদের বড়দা সমীর ইঞ্জিনিয়ার। ব্যাঙ্গালোরে থাকে। প্রবীর পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর। সে এখনো ব্যাচেলর। প্রবীর আর বিদিশা পিঠোপিঠি ভাইবোন। বিদিশার স্বামী অরূপ অধ্যাপনা করে রবীন্দ্রভারতীতে। ইতিহাস পড়ায়।
লকডাউনে স্বাস্থ্যকর্মী এবং পুলিশ কারোর পক্ষেই ঘরবন্দী থাকার উপায় নেই। বিপদ মাথায় নিয়ে চলাফেরা এবং কাজ করা। আবার এরাই সমাজে সবচেয়ে অপ্রিয়। প্রবীর গত তিনদিন বাড়ি ফেরার সুযোগ পায় নি। মা খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ফোন করলেন বিদিশাকে।
‘তুই ভালো আছিস তো? অরূপের খবর কি?’
‘হ্যাঁ মা, এখনো ঠিক আছি। কিন্তু খুব কাজের চাপ আছে। আর ভয় ভয় করছে, কখন কোভিডের খপ্পরে পড়ে যাই। অরূপ বাড়িতে। অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে।’
‘বুঝতে পারছি, আমাদেরও সেই একই চিন্তা। তোর যা কাজ! ভীষণ ভয় লাগছে। সাবধানে থাকিস। তোর শ্বশুরমশাই ভালো আছেন?’
‘হ্যাঁ। ওনাকে তো ঘর থেকে বেরোতে একেবারে বারণ করে দিয়েছি। উনি দোতলায় থাকেন। আমি বাড়ি ফিরে দোতলায় যাই না।’
‘সন্তু আজও ফেরেনি। ফোন করলে খালি বলছে, কাল সকালেই আসছি। অথচ আসছে না। তুই কিছু জানিস?’
সন্তু হল প্রবীরের ডাকনাম।
‘ওরও খুব চাপ যাচ্ছে। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ওকে ফোন করে নিচ্ছি।’
চারদিন পরপর কাজের পর আজ বিদিশার ছুটি। খাটনি, বিরক্তি, ভয়, পিপিই থেকে মুক্তি। সকালে জলখাবারের পাট শেষ। অরূপের এখন রোজই রবিবার, আবার রোজই কাজ- ঘরে বসে। অনলাইনে উত্তরপত্র দেখছে। চা খেতে ডাকল বিদিশা।
‘এখানে পাঠিয়ে দাও।’
‘ধ্যুৎ’ বলে বিরক্ত হয়ে ফোনে খবরের চ্যানেলগুলো দেখতে লাগল বিদিশা। আজকাল ওদের খবরের কাগজ আর বিশেষ পড়া হয় না। শুধু অরূপের বাবার জন্যই খবরের কাগজ কিনতে হয় বাড়িতে। সকালের টাটকা খবরের কাগজ- আগের প্রজন্মের বাঙালির এক আয়েশ।
মোবাইলে খবর পড়তে পড়তে একটা খবরে এসে আটকে গেল চোখ।
‘চিংড়িঘাটার কাছে খালের ধারে মহিলার মৃতদেহ।’
এসব আজকাল খুবই সাধারণ খবর। এসব দেখলে আগে ভীষণ ভয় ও অস্বস্তি হত। আজকাল গা সওয়া হয়ে গেছে। লকডাউনের মধ্যে তো অপরাধের সংখ্যা কমে গেছে বলছে। কিন্তু কোথায় কি! লকডাউন, নকডাউন- কিছুতেই কিছু হওয়ার নয় এই সমাজের।
চিংড়িঘাটা মানে তো প্রবীরের এলাকা।
প্রবীরকে ফোনে ধরতে ও বলল, ‘অবস্থা খুব খারাপ। পাবলিককে ঘরে আটকে রাখা যে কি কঠিন! অথচ একটু লাঠিও চালানো যাবে না। তার মধ্যে খুনখারাপি-র কমতি নেই।’
‘খুন? এর মধ্যেও?’
‘কেন আজকের কাগজ দেখিস নি?
‘হ্যাঁ, দেখলাম তো। আশ্চর্য্য! আবার এক যুবতীর মৃতদেহ লিখেছে। কেসটা কি?’
‘উচ্চমধ্যবিত্ত মহিলা। বছর বত্রিশ বয়স। আগে এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতো। গত বছর দুয়েক ধরে রিয়েল এস্টেট বিজনেস করে পার্টনারশিপে।’
‘বিবাহিত?’
‘ছিল। মিউচুয়াল সেপারেশন হয়ে গেছে দু’বছর।’
‘আগের হাজব্যান্ড কি করে?’
‘প্রফেসর। যাদবপুরে পড়ায়।’
‘ধরা হয়েছে?’
‘নাঃ, জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বুঝতেই তো পারছিস সেনসিটিভ কেস। তাছাড়া মিউচুয়াল সেপারেশন। দু’বছর কোনো যোগাযোগ নেই।’
‘খুনটা হল কি ভাবে?’
‘তাই তো বোঝা যাচ্ছে না।’
‘কেন? পোষ্টমর্টেম হয়েছে তো।’
প্রবীর বলল, ‘সেটাই তো রহস্য। পোষ্টমর্টেমে ভারী শরীর টেনে নিয়ে গেলে পিঠের দিকে যেরকম ছড়ে যাওয়ার দাগ থাকে তা ছাড়া শরীরে তেমন কোনো আঘাতের চিহ্ন পায় নি। গুলি, ধারালো অস্ত্রের ক্ষত, ধস্তাধস্তির চিহ্ন, আঁচড়, গলায় দাগ, ইঞ্জেকশন দেওয়ার দাগ- কিচ্ছু না। পাকস্থলীতে বিষের চিহ্ন মেলেনি।’
‘তা আবার হয় না কি! কিছু একটা সূত্র তো থাকবে।’ বিদিশার গলায় অবিশ্বাস।
‘প্রাথমিক রিপোর্টে বলছে মৃত্যুর কারণ অ্যানাফাইল্যাক্সিস হতে পারে। ভিসেরা অ্যানালিসিসের জন্য পাঠিয়েছে।’
‘অ্যানাফাইল্যাক্সিস? অদ্ভুত তো!’
‘অ্যানাফাইল্যাক্সিস কি জিনিস জানিস, লিলি?’ লিলি হল বিদিশার ডাক নাম।
‘সেটা এক ধরণের অ্যালার্জি জাতীয় রিঅ্যাকশন। সাধারণতঃ কোনো ওষুধ বা কেমিক্যাল থেকে কারো কারো হতে পারে। যেমন কারো পেনিসিলিনে অ্যালার্জি থাকতে পারে। সে না জানা থাকলে সে প্রথমবার পেনিসিলিন নিতে গেলে অ্যানাফাইল্যাক্সিস হতে পারে। খুব দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে না পারলে মৃত্যু প্রায় অবধারিত। কিন্তু সে তো অ্যাক্সিডেন্টালি হয়ে থাকে।’
‘ ও। তা কাদের অ্যানাফাইল্যাক্সিস হয়?’
‘প্রথমতঃ খুব কম মানুষের হয়। ইন ফ্যাক্ট কার কিসে অ্যালার্জি জানা না থাকলে আগে থেকে এটা বোঝা সম্ভবই নয়। অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আসে।’
‘হুঁ। তার মানে এটা ভিকটিমের ঘনিষ্ঠ কারো কাজ।’
‘হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু এরকম তো কখনো শুনি নি।’
‘তুই আসতে পারবি একবারটি বাড়িতে।’
‘সে যেতে পারি। মাকে একবার দেখেও আসা যাবে। কিন্তু তোরা তো রাস্তায় আটকাবি আমাকে।’
‘একটা স্পেশাল পাস পাঠিয়ে দিচ্ছি মেল করে। ওটা প্রিন্ট করে গাড়ির উইন্ড স্ক্রীনে লাগিয়ে নিবি। আর তোর আই কার্ডটা সঙ্গে রাখিস।’
৩
বিদিশা আর অরূপ বিকেলেই পৌঁছে গেল বিদিশার বাপের বাড়ি। রাস্তা খাঁ খাঁ। রাস্তায় পুলিশ গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল। তবে উইন্ডস্ক্রীনে সাঁটা পাস দেখে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিল।
‘তুই কি এই কেসের আই ও নাকি।’ বিদিশা বলল।
‘সে তো বটেই। না হলে লকডাউনের মধ্যে এই ঝামেলা নিতে যাব কেন? এমনি ঝামেলার শেষ নেই। তাছাড়া কেসটায় ওষুধের গন্ধ পাচ্ছি। তাই তোকে ডাকলাম।’
‘আই ও মানে?’ অরূপ জিজ্ঞাসা করল।
বিদিশা বলে, ‘ইনভেষ্টিগেটিং অফিসার। পুলিশের ভগ্নীপতি, এইটুকু না জানলে চলবে?’
‘সন্তুকে যদি জিজ্ঞাসা করি, বাবরের জন্ম কোথায় হয়েছিল? বলতে পারবে?’
‘বাবরের জন্ম যেখানেই হয়ে থাকুক, এই কেস কিন্তু এখনি অনেক ডালপালার জন্ম দিয়েছে।’
চা- জলখাবার এল। মাস্ক নামিয়ে দূরে দূরে বসে খাওয়া বিরাট ঝকমারি। হাজরায় ওদের বাড়ির বসার ঘরটা নেহাৎ অনেক বড়। তাই এভাবে ফাঁকা ফাঁকা বসা যায়।
জানলাগুলো হাট করে খুলে দিল বিদিশা। ‘ভালো করে হাওয়া চলাচল করুক।’
প্রবীর বলল, ‘যা বলছিলাম, এই ভদ্রমহিলা, মানে ভিকটিম ইন্দ্রানী সান্যাল ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আগে স্কুলে পড়াতো। কিন্তু সেপারেশনের পরে সন্দীপ আগরওয়ালের সঙ্গে কনস্ট্রাকশন এজেন্সীর ব্যবসা শুরু করে।’
‘এই বয়সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়াটা স্বাভাবিক। তাছাড়া ব্যবসা করা অপরাধ না কি?’ অরূপের ধারণা বাঙালি ব্যবসা বিমুখ হয়েই গোল্লায় গেছে।
‘এই যে রিগ্যাল কনষ্ট্রাকশান এজেন্সী, এরা কাজ করে মূলতঃ নিউটাউনে। কিন্তু এটাই ওদের একমাত্র আয়ের উৎস নয়।’ প্রবীর বলল।
‘মানে?’
‘এখনি এর বেশী বলতে পারছি না।’
‘এদের অফিসও কি নিউটাউনে।’
‘হ্যাঁ।’
‘ওইজন্য কাগজে ছবিটা দেখে চেনা চেনা লাগছিল। একে আমি আগে দেখেছি মনে হচ্ছে। দাঁড়াও।’
মোবাইলে ফেসবুক খুলে ইন্দ্রাণী সান্যাল নামে সার্চ করতেই অনেক ইন্দ্রাণী সান্যাল বেরিয়ে পড়ল।
‘এই মহিলা মনে হচ্ছে। অন্ত্রেপ্রেনর। ফ্রম শিলিগুড়ি, রিলেশনশিপ কমপ্লিকেটেড।’
অরূপ জিজ্ঞাসা করল ‘কোথায় দেখেছ একে?’
‘পেট্রোল পাম্পে তেল ভরছিল গত শুক্রবার।’ সেদিনের ঘটনাটা বলল বিদিশা।
‘ওই দিনই খুনটা হয়েছে। তবে গাড়ির সঙ্গের লোকটার বিবরণের সাথে সন্দীপ আগরওয়ালের কোনো মিল নেই। সে ভীষণ মোটা আর তার বিএমডব্লিউ গাড়ি। ইন্দ্রাণীর নিজের স্কোডা। এর মধ্যে কালো হন্ডা সিটি এল কোথা থেকে?’
‘তা কি করে বলব? আচ্ছা, ইন্দ্রাণী রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় জড়ালো কি ভাবে।’ বিদিশা অবাক গলায় বলে।
‘ও স্কুলে চাকরি করত। তবে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইন্টেরিয়র ডেকরেশন শিখেছিল। তাছাড়া ওর বাবা শিলিগুড়ির নামকরা আর্কিটেক্ট।’
এবার অরূপ জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা সন্তু, ইন্দ্রাণীর প্রাক্তন কোথায় আর কি পড়ায়?’
‘ভদ্রলোকের নাম সুমিত চৌধুরী। যাদবপুরে ইতিহাস পড়ায়।’
‘সুমিত চৌধুরী? চিনি তো। অধ্যাপকদের সংগঠন করে। যদিও আলাপ নেই।’ অরূপের চোখদুটো উজ্বল হয়ে ওঠে।
‘ভুলেই গেছিলাম। তোমার তো একই সাবজেক্ট।’
‘ছোড়দা, ওনাকে আর একবার জেরা করা যায়?’ বিদিশা বলে।
‘ফোন তো করাই যায়।’
সুমিত চৌধরীকে ফোনে ধরল প্রবীর। মোবাইলের হ্যান্ডস ফ্রী মোডে সবাই শুনল।
‘ইন্দ্রাণীর কিছুতে অ্যালার্জি ছিল আপনি জানতেন?’
‘হ্যাঁ ডাষ্ট অ্যালার্জি ছিল। আর….. ও হ্যাঁ একবার বছর চারেক আগে রাবার গ্লাভস পরে গার্ডেনিং করতে গিয়ে চোখমুখ-হাত-পা ফুলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।’
‘এই ব্যাপারটা আপনাদের বাড়িতে ছাড়া আর কে কে জানত?’
‘তা তো জানি না। গত দু-বছর তো আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয় নি।’
‘কোন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল?’
‘ইজি কিওর নার্সিং হোম। আমার বাড়ির কাছেই।’
‘ঠিক আছে। আপাততঃ এটুকুই। আবার দরকার হলে ডাকব। থানায় আসবেন।’
ফোন কেটে দেওয়া হল।
‘রাবার, মানে ল্যাটেক্স অ্যালার্জি। কিছু কিছু ডাক্তার-নার্সের মধ্যে ধরা পড়ে। গ্লাভস পরতে হয় তো। কখনো কখনো মারাত্মক হতে পারে। কিন্তু শুধু চামড়ায় কন্ট্যাক্ট থেকে জীবন সংশয় বা অ্যানাফাইল্যাক্সিস হওয়া বোধহয় সম্ভব না।’
বিদিশার কথায় সংশয় বাড়ল বই কমল না।
‘ফরেনসিক পরীক্ষায় ইঞ্জেকশনের কথা তো বলছে না।’
‘হুম্’ প্রবীর আর অরূপ সিগারেট ধরাল।
বিদিশা চুপচাপ ফেসবুক সার্চ করতে করতে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,’ এই ছবিটা দেখ।’
একটা কোনো হোটেলে পার্টির ছবি। ইন্দ্রাণীর প্রোফাইলে বারোদিন আগে আপলোড করা হয়েছে। ছবিটা ডাউনলোড করে এনলার্জ করা হল। ইন্দ্রাণীর হাতে ওয়াইনের গ্লাস। সবাই একে একে ছবিটা দেখল।
তারপর বিদিশা ছবিতে আঙুল দেখিয়ে প্রবীরকে কি একটা বলল। পার্টির অনেক লোকজনের মধ্যে এক যুবকের ছবি ক্রপ করে ওর কলিগকে পাঠালো প্রবীর।
‘এর সম্বন্ধে এখনি খোঁজ কর।’
পরদিন সকালে প্রবীরের ফোনে ঘুম ভাঙ্গল বিদিশা আর অরূপের।
পার্টির ছবির ওই লোকটাকে ধরা হয়েছে খড়গপুর থেকে। ওর নাম দীপক পাঁজা।’
‘গাড়িটা ধরা পড়েছে?’
‘হ্যাঁ। নম্বর প্লেট চেঞ্জ করে ফেলেছিল। তবে পেট্রোল পাম্পে তোর তোলা ছবিটা খুব কাজে দিয়েছে। ইন্দ্রাণীর সাথে তার খুব সামান্য পরিচয় ছিল, এই মৃত্যুর সাথে তার কি সম্পর্ক- এইসব বলে এড়িয়ে যাওযার চেষ্টা করছিল। তারপর তোর তোলা গাড়ির ছবি আর শুক্রবার সারাদিনে তার মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন দেখাতেই আর কথা বাড়ায় নি। ‘
‘কসমেটিক সেটটা পাওয়া গেছে?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু ওটার কি ভ্যালু?’
‘ওটাই তো সব। ফরেনসিক টেষ্ট করতে পাঠা।’
‘রিয়েলি?’
‘হ্যাঁ, আমি মজা করছি না।’
৪
তিনদিন পরে রবিবার প্রবীর আর তার জুনিয়র বিদিশাদের বাড়িতে বসে। কেসের সমাধান হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, আজকের কাগজেই আছে- কলকাতা জুড়ে সাতজন ধরা পড়েছে ড্রাগ চোরাচালানের দায়ে।
অরূপ বলল, ‘লকডাউনের মধ্যেও ড্রাগ? পুলিশ অবশ্য ভালো কাজ করছে বলা যায়।’
‘অবশ্যই। তবে এগুলো মার্ডার কেসের তদন্তের বাই প্রোডাক্ট। ড্রাগের ব্যাপারে বাকি তদন্ত করছে সেন্ট্রাল নারকোটিক এজেন্সী। আমরা ওদের হেল্প করছি।’
অরূপ বলল, ‘মার্ডার কেসটার কি হল?’
‘প্রথম থেকে বলি।’
‘অবশ্যই’ অরূপ এবং বিদিশা বলে উঠল।
‘গতকালের আগের শনিবার সকালে ইন্দ্রাণী সান্যালের মৃতদেহ পাওয়া যায় চিংড়িঘাটার খালের পাশে। চোখমুখ ফোলা, কিন্তু বাইরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। প্রাথমিক ভাবে ভাবা হয়েছিল শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
কিন্তু ফরেনসিক রিপোর্টে সেরকম কিছু বলল না। বরং বলল অ্যানাফাইল্যাক্সিস হতে পারে। বিষক্রিয়া আছে কিনা জানার জন্য ভিসেরা অ্যানালিসিস করতে পাঠাল।’
‘অ্যানাফাইল্যাক্সিস! এই প্রথম জানলাম।’ অরূপ কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল।
‘পুলিশের চাকরি করতে কত কি যে দেখতে হচ্ছে! যা বলছিলাম, ইন্দ্রাণীর প্রাক্তন স্বামীর থেকে জানা গেল চার বছর আগে একবার রাবার গ্লাভস পরে ইন্দ্রাণীর ভয়ঙ্কর অ্যালার্জি হয়েছিল। নার্সিংহোমের থেকে রেকর্ড ঘেঁটে জানা গেছে ঘটনাটা সত্যি। ল্যাটেক্স অ্যালার্জি। সুতরাং সে মিথ্যা বলে নি। আমাদের সন্দেহের রাডারে কিন্তু সুমিত চৌধুরীও ছিল।’
কাজের মেয়ে বিন্তি চা-স্ন্যাক্স দিয়ে গেল।
বিদিশা বলল, ‘কিন্তু ল্যাটেক্স গ্লাভস পরে অ্যালার্জি হলেও মানুষ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তার জন্য জিনিসটা শরীরের ভেতরে প্রবেশ করানো দরকার। এখানেই অপরাধী এক অদ্ভুত উপায় ভাবল।’
এবার প্রবীর বলল, ‘দীপক পাঁজা লোকটা কেমিষ্ট্রি নিয়ে পড়াশুনো করেছে। ভাল ছাত্র ছিল। পরে বখে গিয়ে অপরাধে হাতেখড়ি। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির কেস, ড্রাগ পাচারের কেস- গুণের শেষ নেই। আর আজকাল ইন্টারনেট করে খারাপ-ভাল সব ধরণের জ্ঞানলাভই তো করা যায়।
সে ইদানিং ফ্ল্যাটবাড়ি কেনাবেচা আর ভাড়া দেওয়া-নেওয়ার এজেন্সী খুলেছিল। সেটা অবশ্য শো-পিস। পর্দার আড়ালে ড্রাগ কেনাবেচার কারবার চালাত সে। তাতেই আসল লাভ। এই লকডাউনের বাজারে সবাই ঘরবন্দী। তার ড্রাগের ব্যাবসা ফুলেফেঁপে উঠেছিল। ইন্টারনেটের ‘ডার্ক ওয়েব’ ব্যবহার করে ঘরবন্দী খদ্দেরদের সাথে যোগাযোগ করত সে। ‘ডার্ক ওয়েব’ হল ইন্টারনেটের একটা গভীর, গোপন অংশ। যাতে ব্যবহারকারীর ‘আই পি অ্যাড্রেস’ বা ঠিকানা খুঁজে বের করা যায় না।
ইন্দ্রাণী রিয়েল এষ্টেট ব্যবসার সূত্রে দীপক পাঁজার সংস্পর্শে আসে। তারপর গত কয়েক মাসে দুজনে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে। ইদানিং রিয়েল এষ্টেট ব্যবসায় মন্দা চলছে। ইন্দ্রাণীর আবার টাকা আর সাফল্যের নেশা। সে তার বেশ কিছু পুঁজি দীপকের ব্যবসায় ইনভেষ্ট করে। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখে, তার আসল কারবার হল ড্রাগের। ইন্দ্রাণী তখন ড্রাগের মুনাফা দাবী করে। সেটা না পেয়ে সে তারপর দীপককে ব্ল্যাকমেল করতে থাকে।
দীপক হল পুরনো অপরাধী। সে কিছু বুঝতে না দিয়ে ইন্দ্রাণীর সাথে প্রেম-প্রেম খেলা চালিয়ে যায়। কিন্তু তলায় তলায় তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার ছক কষে।
ইন্দ্রাণী তাকে কোনো দূর্বল মুহুর্তে রাবার গ্লাভসে অ্যালার্জি হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়ার ঘটনাটা বলে থাকবে।’
বিদিশা বলে, ‘অনেক মেয়েরা ঠোঁটে লিপষ্টিক লাগিয়ে সেটা ঠোঁটের ভিতর-বাইরে ঘষতে থাকে। ঠোঁটের ভিতরের দিকে কিন্তু চামড়া খুব পাতলা হয়ে মিউকোসা নামক সূক্ষ্ম পর্দা হয়ে মুখের ভিতরে চলে গেছে। সেখানে কোনো ওষুধ বা রাসায়নিক লাগালে তার কিছুটা সরাসরি রক্তে মিশে যেতে পারে।
অপরাধী ল্যাটেক্স সলিউশন জোগাড় করে এবং খুব দামী একটা বিদেশী কসমেটিক সেট কেনে। তারপর খুব সাবধানে প্যাকেট খুলে লিপষ্টিক দুটো বের করে সেগুলো ভালো করে ল্যাটেক্স সলিউশনে ভেজায়। তারপর আবার প্যাকেট বন্ধ করে ইন্দ্রাণীকে সেটা উপহার দেয়। ইন্দ্রাণী প্যাকেট খুলে লিপষ্টিক ঠোঁটে লাগাতেই মুখচোখ ফুলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বদ্ধ গাড়িতে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার অভাবে মারা যায় সে।’
‘কালো হন্ডা গাড়ির গ্লাভস বক্সে ল্যাটেক্স সলিউশনের শিশি পাওয়া গেছে। কসমেটিক্স সেটের ফরেনসিক টেষ্ট করে লিপষ্টিকে ল্যাটেক্স পাওয়া গেছে এবং সেটা ইন্দ্রাণীর ডেডবডিতে পাওয়া লিপস্টিকের সঙ্গেও মিলেছে।’ প্রবীর বলে।
অরূপ তবু ভ্রু কুঁচকে বসে ছিল। ‘কিন্তু একটা জিনিস আমার এখনো খটকা লাগছে, ফেসবুকের ছবিটা থেকে অত লোকের মধ্যে দীপকের ছবিটা বের করলে কি করে?’
‘ছবিটা এনলার্জ করতেই দেখা গেল ওই লোকটার কোমরে ইংরেজি ‘এইচ’ অক্ষর লেখা হন্ডা গাড়ির চাবির রিং ঝুলছে। বাকিটা অনুমান আর জেরা।’