এরকম প্রেস্ক্রিপশন রোজ পাই। চাইলে অগুনতি দেওয়া যায়। ডিগ্রির জায়গাটা খেয়াল করুন। লেখা ‘Community-acquired respiratory tract infections (Mumbai)’ অর্থাৎ কিনা ‘শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ (মুম্বাই)’ নামক ডিগ্রির অধিকারী। একবার পেয়েছিলাম ‘Acute myocardial infarction (France)’ ডিগ্রিধারীকে। গ্রামের গরীব গুর্বো লোকে বিশ্বাস করেই এদের কাছে যায়। নামের পাশে হিজিবিজি ইংরেজিতে কী লেখা সেসব বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। ইনিও এলাকায় শিশুদের চিকিৎসক বলে পরিচিত। রীতিমতো পাশ করা ডাক্তারের সাথে পাল্লা দেওয়া ভিজিট নিয়েই রোগী দেখেন। তাছাড়া বিএসসি পাশ ডাক্তার, এলএলবি করা ডাক্তার, ফিজিওথেরাপিস্ট ডাক্তার… নাঃ! কোথাও কোনও কমতি নেই। নির্ভেজাল হাতুড়ে এমনকি হাতুড়ের কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতুড়ে সবাই এদেশে ডাক্তার। কেউ দেখার নেই, কেউ বলার নেই। যে কেউ এদেশে নামের আগে ‘ডাক্তার’ কথাটি বসিয়ে নিতে পারে। পাঁচু পোদ্দার থেকে হারাধন মল্লিক কেউ অন্য কিছু না জানুন, সবাই ডাক্তারিটা ঠিক জানেন। মোড়ের মাথায় বসে ঠিক বলে দেবেন, “বুজলেন দাদা, ওসব জ্বরফর নিয়ে ডাক্তারের কাচে গিয়ে লাভ নেই। ক’টা ক্যালপল আর দু’দিনে দুটো অ্যাজিথ্রাল। ব্যাস! ওই করেই তো বোকাইয়েরা কয়েকশো টাকা খসিয়ে দেবে!”
এরপর যেদিকে দুচোখ যায় পুরিয়া, জড়িবুটির বিপুল সাম্রাজ্য। বাদবাকি সারা পৃথিবীতে যা-ই হয়ে যাক, এদেশে এখনো তেনাদের ভরা সংসার। দু’মাসের বাচ্চার একটানা জন্ডিস, খিঁচুনির রোগ, হার্টের রোগ ইত্যাদি যা যা (যেগুলো ফুসমন্তরে সারে না) সত্যিকারের রোগ; তার প্রতিটিতেই দীর্ঘদিন পুরিয়া চিকিৎসার কল্যাণে ঘেঁটে গিয়ে শেষমেশ হাসপাতালে এসে পৌঁছোনো দেখতে দেখতে হাঁফিয়ে গিয়েছি। খবরে পড়েছি, পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশেও হোমিওপ্যাথি পাশ করা কেউ আর নামের সামনে ‘ডাক্তার’ কথাটি লিখতে পারবেন না। উন্নত দেশগুলোর কথা তো বাদই দিলাম। এদেশে? থাক…
আপনি পাশ করা ডাক্তার খুঁজতে যাবেন? পোস্টগ্রাজুয়েশনে ডাক্তারি আসনের সত্তর শতাংশ সংরক্ষিত। অর্থাৎ? আজ এক্ষুনি ইমার্জেন্সি কিছু দরকার হ’লে আমার হাতের কাছে যেসব পাশ করা ডাক্তার পাবো তার প্রতি দশজনের মধ্যে মাত্র তিনজন নিজেদের যোগ্যতায় পাশ করেছেন। অদূর ভবিষ্যতে একমাত্র কর্পোরেট হাসপাতাল ছাড়া নিজেদের যোগ্যতায় পাশ করা ডাক্তার খুঁজতে অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগবে।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। প্রতি মুহূর্তে কোর্টকাছারি, পাড়ার মস্তান, লোকাল নেতার চোখরাঙানি সামলে কোনও মানুষেরই কাজ করতে ইচ্ছে করে না। যে ছেলে বা মেয়েটি ডাক্তারি পরীক্ষায় নিজের যোগ্যতায় পাশ করেছে সে চাইলে (চেষ্টা করলে) সম্ভবত ভারতবর্ষের যে কোনও পরীক্ষা পাশ করতে পারবে। কাজেই আগামী দিনে মেধাবী ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি পড়তে আসার আগে একশোবার ভাববে। এর চেয়ে অনেক কম কষ্টে আরও আরামদায়ক জীবনযাপনের হাজার একটা উপায় আছে।
আপনি বলবেন, প্রত্যন্ত গ্রামে পাশ করা ডাক্তার পাওয়া যায় না। অথচ, প্রচুর পাশ করা হদ্দ বেকার ডাক্তার বসে বসে আকাশের তারা গুনছে আর খুঁটে খুঁটে খুপরি ঘরে কোনোমতে কিছু রোগী দেখে দিন গুজরান করছে। যারা একটা সরকারি চাকরি পেলে বর্তে যাবে। তারা আর কী চায়? একটু কাজের নিরাপত্তা। কথায় কথায় নেতা বা তাঁদের পোষ্য প্রশাসকদের চোখ রাঙানি থেকে মুক্তি। একটু স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ। পোড়াদেশে সেটাও অনেক বেশি চাওয়া। যাঁরা মনে করেন ডাক্তার মানেই বিশাআআআল ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স আর হাইফাই লাইফস্টাইল তাঁরা আসলে প্রায় কিছুই জানেন না। একজন সদ্য পাশ করা ডাক্তার থুড়ি, সদ্য পাশই বা বলি কেন… পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের নিচে অধিকাংশ ডাক্তারের জীবন ও জীবিকা নিয়ে লিখবো একবার। কত ঘন্টা খেটে তাঁরা কী রোজগার করেন সেটা শুনলে বেশিরভাগেরই ভাবনার সাথে মিলবে না সম্ভবত। আপনি আবার বলবেন, এরপর যদি শুধু কর্পোরেটেই নিজের যোগ্যতায় পাশ করা ডাক্তার পাওয়া যায় তাহলে সাধারণ মানুষ কী করবে? এত খরচ করে সাধারণ মানুষ চিকিৎসা করাতে পারবে নাকি? ঠিক কথা। অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে যে সাধারণ মানুষ চিকিৎসা ক্ষেত্রে সত্তর শতাংশ সংরক্ষণ নিয়ে মাথা ঘামান নি, চিকিৎসক নিগ্রহের সময় ‘বেশ হয়েছে শালাদের’ বলে বগল বাজিয়েছেন আবার আশাও করেছেন ডাক্তাররা ঠিক অগ্নিশ্বরের মতো আবির্ভূত হবেন… তাঁরা প্লিজ এখনো সেটাই বাজান। বগল। এর মধ্যেই কিছু লোকজন আছেন যাঁরা কর্পোরেটের ‘রক্তচোষা ডাক্তার’ নিয়ে জনপ্রিয়, রোমহর্ষক থ্রিলার লেখেন। তাঁদের মঙ্গল হোক। পারলে বিলটা খুলে তার কত অংশ ডাক্তারের ভিজিট সেটা দেখে নেবেন। তাও যা লেখা থাকে ডাক্তার আসলে তার থেকেও বেশ খানিকটা কম হাতে পান।
একটা পচে যাওয়া সমাজে বড় হওয়া ছেলে বা মেয়েটি হঠাৎ পাঁচ বছর বাদে ডাক্তারি পাশ করে মহাপুরুষ বা মহামানবী হয়ে উঠবেন, এমন আশা করাটাই তো ভুল। সেই ছেলে বা মেয়েটির বড় হয়ে ওঠার দিনগুলোয় ঠিক যে রকম চারপাশ আপনি সাজিয়ে দিয়েছিলেন, আজ প্রতিদানে সে ঠিক সেরকমটিই দেবে। দোহাই, কোনও বিশেষ উদাহরণ নিয়ে হাঁকডাক শুরু করবেন না। ওরকম উদাহরণ প্রতিটি পেশা ধরে দেওয়া যায়।
আশাহীন, সমাধানহীন, উপায়হীন একটা সময়। পকেটভর্তি গান্ধীছাপ কাগজ থাকলে আপনার জন্য কর্পোরেটের দরজা খোলা। প্রান্তিক হদ্দগরীব লোকগুলোর অসহায়তা ছুঁয়ে দেখার মতো ডাক্তারের সংখ্যা ক্রমশ কমবে। কমতে বাধ্য। যারা নিজের যোগ্যতায় পাশ করে নি তারা অন্যের কষ্ট ছুঁয়ে দেখবে বা দেখার ইচ্ছে থাকলেও ডাক্তারিটা করার ক্ষমতা রাখবে, এসব আশা করাও ভুল।কোচিং সেন্টার আর ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষাপুষ্ট ডাক্তারের সাথে গায়ে গতরে খাটা হরেন মন্ডল কিংবা কালু সোরেনদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়বে। অথচ, হাত না ছাড়ার কথা ছিল আমাদের…
সবার স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে বুকভরা স্বপ্ন ছিল। বহুদিন ধরে জমানো স্বপ্ন। কেন জানি না, স্বপ্নগুলো শুধুই ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে…