৩রা এপ্রিল, ২০২২
সকালে যখন প্রথমবার ঘুম ভাঙলো তখন ঘড়িতে পৌনে সাতটা। দেরিতে ঘুমোনোর বদ অভ্যেস তৈরি হয়ে গেছে। অ্যালার্ম না দেওয়া থাকলে কোনোদিন এত সকালে ঘুম ভাঙে না। অথচ এই আমিই এগারো-বারো ক্লাসে রোজ ভোর চারটেয় সময় উঠে পড়তে বসতাম। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলে মন-মেজাজ অনেক তরতাজা থাকে। শিলংয়ের আরামদায়ক আবহাওয়া আর লেপের আদরে বহুদিন বাদে এমন গভীরভাবে ঘুমোলাম। জানলার পর্দা ঠেলে ঝকঝকে নরম রোদ বিছানায় এসে পড়ছে। সে রোদে চোখ ডুবিয়ে মধু দেওয়া লিকার চা খেলাম। চোখে যেটুকু পাতলা ঘুমের রেশ ছিল সেটা কাটলো। তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে হালকা ব্যায়াম সারলাম। তাড়াতাড়ি সাফসুতরো হয়ে যেতে হবে। ঠিক সাড়ে আটটায় গাড়ি আসবে। আজ প্রথমে রুট ব্রিজ, তারপর মাওলিনলং (এশিয়ার সবথেকে পরিষ্কার গ্রাম) হয়ে ডাউকি লেক ভ্রমণ। রাতে শুধুই পুলিশ বাজারটুকুই দেখা হয়েছিল। এবার ছোট্ট শহরের বাকি অংশগুলো ধীরে ধীরে চোখের সামনে উঠে এলো। শিলংয়ের রূপের বর্ণনা দিতে বিশেষণ কম পড়ে। সবটাই স্বচ্ছ, সুন্দর, পরিষ্কার, পরিপাটি। রাস্তার হঠাৎ বাঁক, রাস্তা থেকে অনেকগুলো ধাপ সিঁড়ি উঠে ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি, কাস্ট আয়রনের ব্যালকনি, রুচির ছাপ মাখা পাঁচিল। রাস্তা বরাবর সারি সারি পাইন আর ফার গাছ। বড় রাস্তার বাঁহাতে স্বপ্নের মতো গলফ খেলার মাঠ। অল্প দূরত্বের মধ্যে বিভিন্ন সরকারি অফিস, আদালত, সেনা বিভাগের বাড়িগুলো। তাদের সৌন্দর্য তুলে ধরা আমার মতো শখের কলমচির কাজ নয়। শিলংয়ে সাধারণত চারতলার বেশি বাড়ি বানানোর অনুমতি দেওয়া হয় না। ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা বলে এই বিধিনিষেধ। দম্ভভরা উদ্ধত কংক্রিটের জঙ্গল এখানে আকাশ ফুঁড়ে ওঠে না। এই শিলংয়ের প্রেমে পড়া যায়। বারবার।
গাড়ি শিলং পেরোলেই সিমেন্টের তৈরি বাড়ি ক্রমশ কমে আসে। অধিকাংশই কাঠ আর পাথর দিয়ে বানানো ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি। তিন কোনা মাথা। ফটোজেনিক কথাটার বাংলা মানে কী হবে জানিনা। শিক বিহীন জানলায় একটি দুটি খাসি জনজাতির শিশুর মুখ। মাথায় অল্প চুল, চ্যাপ্টা নাক, স্বল্প উচ্চতা। ওই পাহাড়, ওই জানালা, ওই শিশুর মুখ, ওই পাতলা সরল হাসি… পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট ক্যামেরার পক্ষেও এই মুহূর্তটুকুকে ধরে রাখা সম্ভব নয়। এ শুধু চোখের দেখা। প্রাণের আরাম। ভবিষ্যতের সঞ্চয়।
“শিলংয়ের খাসি মাংস শুনেছি খুব বিখ্যাত। এসেছি যখন চেটেপুটে খেয়ে যাব।” ঋতায়ণের কথায় ঘোর কাটলো। বললাম, “এখানে খাসির মাংস খাবো বললে তোর আর জ্যান্ত ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই।” প্রথমে সে ব্যাটা কিছুতেই বুঝতে পারে নি। পরে বুঝতে পেরে সবাই মিলে একপ্রস্থ হাসির ধুম হ’ল। নিশ্চয়ই বুঝবেন, এ নিছক মজা করার জন্যই বলা। খাসি জনজাতিকে (বা কোনও জাতিকেই) অপমানজনক কথা বলার প্রশ্নই ওঠে না। বরং, তাঁদের দেশ ঘুরে এসে বারবার শ্রদ্ধা করতে, ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। তারপর গোটা রাস্তা জুড়ে সবাই মিলে ঋতায়ণকে যেভাবে খ্যাপানো হলো, ভারত মহাসাগর, মুদ্রাস্ফীতি, আলেকজান্ডার, শেন ওয়ার্ন হয়ে টয়ে আলোচনা যা যা খাতে বয়ে চললো, যেরকম আদিরসাত্মক কথার ফোয়ারা উঠলো; তার বর্ননা ভদ্রসমাজে অন্তত লেখার ভাষার না এলেই মঙ্গল।
রাস্তার দু’পাশে প্রতিমুহূর্তে দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। এদিক-ওদিক যেখানেই তাকাই পাহাড়ের খাঁজে বর্ষার জলে পুষ্ট অজস্র জলধারা। পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে কুলকুল শব্দে তারা বয়ে চলেছে। পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে জমি তৈরি করে অল্পস্বল্প চাষের আয়োজন। পাহাড়ের কত রকমের প্রকারভেদ। কোথাও কালচে পাথর, কোথাও ঈষৎ হলদেটে। আমাদের ড্রাইভার রফিকদা ভালোই বাংলা জানে। রফিকদা জানালো, এদের মধ্যে কোনও কোনও পাথর থেকে কয়লা তৈরি হয়। কোনোটা বা চুনাপাথর। সুযোগ পেলেই পাথর ছুঁয়ে দেখছি। তার বুকে হাত রেখে অনুভব করতে চাইছি পৃথিবীর আদিমতম দিনের স্পন্দন।
হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরতেই চাপ চাপ কুয়াশার অন্ধকার। রফিকদা জানালো, এখানেও আর একটা ভিউ পয়েন্ট। ওপরে উঠলে চারদিকটা অসাধারণ দেখায়। কুয়াশার জন্য দেখা মিললো না। পাহাড়ি সুন্দরীর মনের তল খোঁজা ভার। সে অত সহজে সবার কাছে যখন তখন দেখা দেবে কেন? তার জন্য ধৈর্য্য ধরতে হয়। তার ইচ্ছে হ’লে তবেই দর্শনলাভ সম্ভব। শিলং পিক নিরাপত্তাজনিত কারণে আপাতত বন্ধ। এখানেও দেখা পেলাম না। কী আর করা যাবে? পাশের রেস্তোরাঁয় পেটপুজোর জন্য ঢুকলাম। রেস্তোরাঁর নিচের তলার কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। টিপটিপ বৃষ্টি আর ঘন সাদা কুয়াশার রহস্যময় অন্ধকারে চারদিক ব্যাপ্ত। রেস্তোরাঁ চালাচ্ছে জনা চার পাঁচেক বছর সতেরো আঠারোর ছেলেমেয়ে। অর্ডার নেওয়া, টেবিল পরিষ্কার করা, খাবার পরিবেশন; সবকিছুর মধ্যেই আন্তরিকতার ছাপ স্পষ্ট। মুখে সবসময় মিষ্টি একটা হাসি লেগে আছে। এখানে লোকজন মৃদুভাষী। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ জোরে কথা বলে না।
খেয়েদেয়ে গাড়িতে ওঠা হ’ল। পরবর্তী রাস্তায় শুধুই কুয়াশার রাজত্ব। একদিকে উঁচু পাহাড়। অন্যদিক সাদা ধোঁওয়ায় ছাওয়া। দু’ফুটের বেশি দৃষ্টি যায় না। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। মন খারাপ হচ্ছিল।
বলতে বলতে গাড়ি এক জায়গায় এসে থামলো। এখানে শেকড়ের তৈরি সেতু দেখা যায়। কাছে যেতেই জলের গর্জন ভেসে আসছিল। ছোট্ট, খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। গর্জনে গর্জনে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, “ওহে সাজানো সভ্যতা! এ তোমার কংক্রিট, ইন্টারনেট, এসি, দামী গাড়ির দুনিয়া নয়। এ আমার রাজত্ব। এখানে এলে মাথা নিচু করে আসতে হয়। আমার বিশালত্বের কাছে তুমি তুচ্ছ, নগন্য, ক্ষুদ্র!” বেশ খাড়াই সিঁড়ি ভেঙে অনেকটা ওপরে উঠে আবার নেমে যেতে হবে। এখানে বেশ গরম। আরশিকে কোলে নিয়ে উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অবশেষে তার দেখা পাওয়া গেল। নদীর এপার-ওপার দুটো গাছ পরম আলিঙ্গনে নিজেদের জড়িয়ে ধরেছে। আজন্মকালের বন্ধন। সেটাই সেতু। নিচে পাহাড়ি নদীর জলোচ্ছ্বাস। যেন বা কিশোরীর প্রাণখোলা নাচের ছন্দ। কিংবা দ্রুত কোনও তবলার বোল। পড়াশোনা করে জানলাম, এরকম এক একটা সেতু তৈরি করতে প্রায় দশ-পনেরো বছর সময় লাগে। অধিকাংশ সেতুর বয়স পাঁচশো ছাড়িয়েছে। মেঘালয়ে দোতলা শেকড়-সেতুও আছে। সারা পৃথিবীতে আর কোথাও এমন জিনিস নেই! যদিও সেখানে পৌঁছে ফিরে আসতে প্রায় কুড়ি ঘন্টা ট্রেকিং করতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের যাওয়া হয়ে ওঠে নি। ঋতায়ণ এখানেই এক কান্ড করে বসলো। বিভিন্ন ভঙ্গিতে বৌয়ের ছবি তুলতে গিয়ে ভেজা পাথরে পিছলে নিজেই চিৎপটাং করে জলে পড়লো। অগভীর জল। বিপদ কিছু হয়নি কিন্তু জামাকাপড় সব ভিজে গেছে। কী মনে করে আমি একসেট ট্রাউজার-টি-শার্ট বাড়তি রেখেছিলাম। আমার জামাকাপড় পরেই ঋতায়ণ বাকি রাস্তাটা ঘুরলো। বাড়তি জামাকাপড় না নিলে কী হ’ত কে জানে! ওর ভেজা পোষাক গাড়ির ছাদে বেঁধে শুকোতে দেওয়া হ’ল।
পরবর্তী গন্তব্য মাওলিনলং। এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম। এখানে হোম-স্টের ব্যবস্থা আছে। চারদিক কল্পনার থেকেও নির্মল। একটা কুটোও আবর্জনা নেই। আঁকা ছবির মতো চার্চ, ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি। কোথাও বেতের কাজ করা ময়লা ফেলার জায়গা। কোথাও বড় গাছের তলায় বাঁশের পাকানো বেদী। এখানেই প্রথম কলসপত্রী গাছ দেখলাম। সেই ছোটবেলার জীবন বিজ্ঞান বইতে পড়া পতঙ্গভুক গাছ। কলসীর মধ্যে প্রচুর পিঁপড়ে দেখলাম। মৃত্যুর নির্মম অথচ নেশাতুর আহ্বান।
এরপর রাস্তায় আর কুয়াশা নেই। কোথাও কোথাও পাহাড় ফুঁড়ে ছোট ছোট জলধারা নেমে এসেছে। অনেকটা নিচে বিস্তীর্ণ সমতলভূমি চোখে পড়লো। বসতিও আছে। লোকজনকে চাষ করতে দেখলাম। রফিকদা জানালো এটা বাংলাদেশের সিলেট প্রদেশ। কাঁটাতার শুরু হ’ল একটু পরে। এক প্রকৃতি, এক মাটি, এক আকাশ। শুধু মাঝে কাঁটাতারের বেরসিক উপস্থিতি। চারদিকে অসংখ্য সুপুরি গাছ। সুপুরি পচিয়ে এক ধরনের মদ তৈরি হয়। হঠাৎ আবার জলের গর্জন শুনতে পেলাম। সামনে লোহার সাঁকো। একটা বাঁক ঘুরতেই উদ্দাম বোরহিল জলপ্রপাত। বহু উঁচু থেকে দু-ধাপের জলপ্রপাত বেয়ে সাদা জলরাশি নেমে আসছে। নিচে নেমে পাহাড়ি নদী তৈরি করছে। নদী সোজা চলে যাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। অনির্বচনীয় সে শোভা!
এবার আজকের শেষ দ্রষ্টব্য ডাউকি হ্রদ। ছবিতে দেখেছি স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল। নৌকোর ছায়া এমনকি হ্রদের তলার নুড়ি-পাথর অব্দি পরিষ্কার দেখা যায়। সামনে নিরাপত্তারক্ষীদের ক্যাম্প আছে। এখানে নদীর এপার-ওপার ভারত-বাংলাদেশ। নদী পেরিয়ে এপারে আসা নিতান্তই ছেলেখেলা। কাঁটাতার নেই। ডাউকি পৌঁছে হতাশই হলাম। বৃষ্টির মরশুম শুরু হয়ে গেছে বলে জলের পরিষ্কার ভাবটা নেই। পরিষ্কার জল পেতে হ’লে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে আসতে হবে। হ্রদে নৌকোবিহারের জন্য অজস্র নৌকো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরগুলো সবই কী সুন্দর গোল! যেন কেউ বায়না দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বানিয়েছে। একটা পাথর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এনেছি। ডাউকিতে দুপুরের খাবার খেয়ে এবার শিলংয়ে ফেরার পালা।
রফিকদা জানিয়েছিল, ফেরার সময় আবার কুয়াশার অন্ধকার পড়বে। তখন গাড়ি চালানো নাকি বেশ কষ্টকর। তবে সেটা যে এতটাই কষ্টকর তা কে জানতো? গাড়ির হেডলাইট কুয়াশার অন্ধকারে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দু’দিকে অন্ধকারে জ্বলা বিপদসীমাগুলোও নেই। গাড়ি শম্বুকগতিতে এগোচ্ছিল। কদাচিৎ দু-একটা গাড়ির আলো ছাড়া পুরো চরাচর নির্জন। একটু অসতর্ক হ’লে গাড়ির চিহ্নটুকুও খুঁজে পাওয়া যাবে না। রফিকদা-ই বললো, আজ মাত্রাতিরিক্ত কুয়াশা। সাধারণত এত কুয়াশা হয় না। প্রকৃতির কাছে মানুষ যে কত অসহায় তা এসব পরিস্থিতিতে বোঝা যায়। এক একটা মিনিট বহুযুগ মনে হচ্ছিল।
প্রায় একঘন্টা বাদে আলোর দেখা পাওয়া গেল। একটা বাজারে এসেছি। সারি সারি গাড়ি কুয়াশার জন্য আটকে ছিল। এবার সবাই ধীরে ধীরে গতি বাড়াচ্ছে। যথারীতি হর্নের উৎপাত নেই। শৃঙ্খলা আর নিয়মানুবর্তিতার ছাপ সর্বত্র। এবার বাকি নিরুপদ্রব পথ পেরিয়ে শিলং পৌঁছোলাম। রাতের খাবার চটপট খেয়ে নিতে হবে। সাড়ে ন’টায় আশ্রমের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সারাদিনের ক্লান্তি মুছতে এবার একটা জাঁকিয়ে ঘুম দরকার। কাল আবার বেরোতে হবে।