শুরুর কথা
জেনেভা শহরে ১৯৮১ সালে ৩৪তম ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যসেম্বলি-র অধিবেশন বসেছে, ৪-২২ মে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সদস্য সমস্ত দেশ অংশ করেছে। সেখানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর ভাষণে বিশ্ববাসীর সামনে বললেন – আমাদের অত্যুন্নত আধুনিক হাসপাতালের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু ঊচ্চমূল্যের আরও বেশি টেকনোলজি নির্ভর মেডিসিনের প্রলোভন সামলাতে হবে … প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, দূরত্ব এবং অর্থ উভয় দিক থেকেই, সমস্ত মানুষের নাগালের মধ্যে থাকতে হবে … ভারতে আমরা চাইবো মানুষের দরজায় স্বাস্থ্য পৌঁছক, কেন্দ্রীভূত বৃহৎ হাসপাতাল-মুখী হবার পরিবর্তে। স্বাস্থ্যসেবা শুরু হবে যেখানে মানুষ আছে সেখান থেকে এবং যেখানে সমস্যার শুরু সেখান থেকে।” বললেন – “স্বাস্থ্য ক্রয় করার যোগ্য কোন পণ্য নয়, কিংবা অর্থের মূল্যে কোন পরিষেবা নয়। এটা হল জানার, জীবনযাপনের, অংশগ্রহণের এবং মানুষ হয়ে ওঠার একটি প্রক্রিয়া।” খুবই মূল্যবান কিছু মতামত দিলেন স্বাস্থ্য, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, স্বাস্থ্যের পণ্য হয়ে ওঠা এরকম কিছু মৌলিক বিষয়ের স্বাভাবিক, সহজলভ্য সমাধানের পথে। বিশেষ করে যখন বলেন স্বাস্থ্য কোন পণ্যও বা কোন পরিষেবা নয়, “it is a process of knowing, living, participating and being”। আজ প্রায় ৩০ বছর পরে একবার খোঁজ নিতে হবে স্বাস্থ্যের সরণিতে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা।
আমাদের দেশের কাহিনীতে প্রবেশের আগে আন্তর্জাতিক চিত্র একবার দেখে নিতে হবে। কয়েকটি মূল বিষয় আমাদের প্রথম থেকেই নজরে থাকলে ভালো –
(১) যেমন ১৯৮১ সালে ভারতের তরফে বলা হয়েছিল “Health is neither a commodity to be purchased nor a service to be given” অর্থাৎ আমাদের স্বাস্থ্যের প্রয়োজন, অতি মূল্যবান স্বাস্থ্য পরিষেবার নয় এবং স্বাস্থ্যকে কোন মূল্যেই স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।
(২) ক্লিনিকাল হেলথ তথা ব্যক্তির স্বাস্থ্য এবং পাবলিক হেলথ তথা জনস্বাস্থ্য এ দুয়ের মাঝে বিস্তর ফারাক – দুটি আলাদা দর্শনের জগৎ। আমরা আমাদের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ৫-৭ বা তার বেশি সময় ধরে যা শিখি তা হল একজন ব্যক্তি রোগীকে সবচেয়ে ভালোভাবে কি করে চিকিৎসা করা যায়। এখানে জনস্বাস্থ্য বা জনতার স্বাস্থ্য একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে পাস করে বেরনো চিকিৎসক সমাজের মানসিক অবস্থানে এবং সামাজিক দর্শনে রয়ে যায় ক্লিনিকাল হেলথের দুর্মর ছাপ। পাবলিক হেলথ এখানে দুয়োরাণী। একটা উদাহরণ হচ্ছে, এ মুহূর্তে ভারতে ৩০,০০,০০০-এর বেশি মানুষ মারাত্মক এবং মারণান্তক সিলিকোসিস রোগে ভুগছে। এ রোগ আমাদের প্রায় পড়ানো হয়না বললেই চলে। এ রোগ দরিদ্র হবার রোগ, দারিদ্র্যের অভিশাপের রোগ – পেটের দায়ে কৃষিতে সংকুলান না হবার খাদানে, বিভিন্ন ক্রাশার নিয়ে কাজ করার রোগ। ক্লিনিকাল হেলথের শিক্ষা আমাদের কাছে এ রোগকে invisible, indiscernible করে রেখেছে। একে visibility এবং discernibility-র স্তরে তুলে আনার প্রচেষ্টা কি আমরা চালাবো? এরকম আরও অনেক রোগের কথা বলা যায়। প্রসঙ্গত, আমেরিকায় অ্যাসেবেস্টোসিস রোগে (সিলিকোসিস ধরনের একটি রোগ) বছরে প্রায় ৪০,০০০ মানুষ মারা যায়। এ নিয়ে নিউ ইংল্যান্ড জার্নালের (NEJM) মতো পত্রিকায় ১৫ আগস্ট, ২০১৯, সংখ্যায় বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হল “A Most Reckless Proposal – A Plan to Continue Asbestos Use in the United States”। আমরা কবে পারবো এরকম এক পদক্ষেপ নিতে?
(৩) প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিকল্প কোন Health and Wellness Centre (HWC) হতে পারেনা। জনস্বাস্থ্যের আতুর ঘর হল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখানে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা হয়, চিকিৎসা মাল্টি-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগীর এবং আরও অনেক অবহেলিত রোগের। Do We Care-এর সুপরিচিত বিশেষজ্ঞ লেখিকা সুজাতা রাও বলেন – Money was available to conduct a heart surgery, a cochlear implant, or C-section but not for essential medicines and basic diagnostics, preventive education, rehabilitative care, nursing for the elderly, school health and adolescent care, or for addressing the direct causal factors of communicable and non-communicable diseases, or treatment of injuries, fevers, snake bites – conditions that were critically important for the poor.” (pp. 24-25) HWC এখানে নিরুত্তর। আমরা HWC চাইনা, চাই উপযুক্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যা ১৯৪৮-এ “ভোর কমিটি”-র রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিল এবং সাম্প্রতিক কালে শ্রীনাথ রেড্ডির সুপারিশে যা রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রাক্তন মহাসচিব (১৯৯৮-২০০৪ সময়কালের) গ্রো হারলেম ব্রান্টল্যান্ড এবং রাষ্ট্র সংঘের প্রাক্তন মহাসচিব বান কি মুন (২০০৭-২০১৬ সময়কালের) ২০১৮ সালে ভারতে আসেন স্বাস্থ্যের অবস্থা পরিদর্শনের জন্য। পরে ল্যান্সেট-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন “India’s health reforms: the need for balance” (২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, পৃঃ ১-২) শিরোনামে। ব্রান্টল্যান্ডের উপলব্ধি ছিল – “ভারতের নতুন স্বাস্থ্যসংস্কারের যে সব প্রোগ্রাম সেক্ষেত্রে একটি ঝুঁকি রয়েছে যে, এই প্রোগ্রামগুলো যে অর্থ খরচ হবে সেটাকে টার্শিয়ারি কেয়ারমুখী কোড়ে তুলতে পারে। এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য সরকারের স্বাস্থ্য বাজেটের অন্তত ২/৩ অংশ ব্যয়ের ঘোষিত নীতিকে গুরুত্বহীন করে তুলতে পারে।” ব্রান্টল্যান্ড এক্ষেত্রে আমেরিকার উদাহরণ দিয়েছেন – যেখানে জিডিপির ১৭.২% স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হলেও সার্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা নেই।
(৪) ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (UHC) এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্য – এই দুটি ধারণার মাঝে ফারাক আছে। UHC-তে ধরে নেওয়া হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো যে পরিষেবা দেবে মানুষকে তার জন্য মানুষ স্বাস্থ্যের জন্য ইন্সিউরেন্স থেকে টাকা পাবে। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ভিত্তিই ছিলো “equitable access to basic health services” এবং এর জন্য ব্যয় বহন করবে রাষ্ট্র, রোগীকে কোন ব্যয় বহন করতে হবেনা। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য কি সরকারি বা বেসরকারি ইন্সিউরেন্সের আওতায় আসবে? হাঙ্গরের মতো হাঁ করে রয়েছে বহুজাতিক ইন্সিউরেন্স কোম্পানিগুলো। একবার যদি স্বাস্থ্য সুরক্ষার রাষ্ট্রীয় কবচ সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সরকারের তরফে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারি ইন্সিউরেন্সের কথা বলা হলেও শেষ অব্দি তা বেসরকারি ইন্সিউরেন্সের হাতেই চলে যাবে। ল্যান্সেট পত্রিকায় ২৪ আগস্ট, ২০১৯-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ জানাচ্ছে – ২০১৮-তে সবচেয়ে বেশি রেভেন্যু দেয় এরকম ১০০টি সংস্থার ৬৯টি কর্পোরেট সংস্থা, ৩১টি সরকারি সংস্থা। (“From primary health care to universal health coverage – one step forward and two steps back”, Lancet, August 24, 2019, pp. 619-621) পূর্বোক্ত প্রবন্ধে দুটি মনোযোগ দেবার মতো পর্যবেক্ষণ আছে – “UHC, unlike PHC, is silent on social determinants of health and community participation.” এবং “the term coverage rather than care either suggests a limited scope of care or is being used to suggest enrolment in an insurance scheme…Insurance-based models of UHC risk being promoted at the expense of funding PHC and other public health programmes.”
(৫) ১৯৭৮-এর আলমা-আটার ঘোষণাপত্রে স্পষ্টত “New International Economic Order (NIEO)”-এর ধারণা উচ্চারিত হয়েছিলো। দেশের সম্পদ বিতরণের ব্যাপারেও সেখানে আলোচনা হয়েছিলো। স্বাভাবিকভাবেই এরকম দৃষ্টিকোণ থেকে মেডিক্যাল সিলেবাসও তৈরি হচ্ছিলো। পরিস্থিতি বদলের সাথে সাথে মেডিক্যাল সিলেবাস এবং শিক্ষার ধরণও বদলে যাবে।
২১ নভেম্বর, ২০১৮-তে NEJM-এ প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের শিরোনাম – “Disease and Famine as Weapons of War in Yemen”। প্রবন্ধটি শুরু হচ্ছে এভাবে – How can the medical community take stock of the humanitarian disaster in Yemen? কিভাবে পৃথিবীর মেডিক্যাল সমাজ ইয়েমেনে যে মানবিক বিপর্যয় চলছে তার বিবেচনা করবে?
কোথায় ইয়েমেন? মধ্য এশিয়ার একফালি দেশ – রেড সি, আরব সাগর এবং সৌদি আরব দিয়ে ঘেরা। ২০১৬ থেকে ইয়েমেনের মানুষ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, জীবনহানি, শিশুমৃত্যু, কলেরা, দুর্ভিক্ষ, কলেরার মতো মহামারী প্রত্যক্ষ করছে। ইয়েমেন গৃহযুদ্ধ চলছে। কেন চলছে? কোন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক কারণে এ যুদ্ধ আমার এ প্রবন্ধের বিবেচ্য সেটা নয়। সে আলোচনা অন্য পরিসরে আবার কখনো সুযোগ পেলে করা যাবে। আমাদের আলোচনার জন্য এটুকু তথ্য আপাতত প্রয়োজনীয় যে ইয়েমেনীদের একাংশের যে প্রতিরোধ সংগ্রাম তার বিরুদ্ধে একসাথে জোট বেঁধেছে সৌদি আরব, আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স। অর্থনৈতিক অবরোধ এবং সমস্ত প্রচেষ্টা চলছে ঐটুকু দেশকে গুঁড়ো করে দেবার জন্য। এ বিষয়ে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন তথ্য আমার এ প্রবন্ধে পরে আলোচনা করবো।
NEJM-এর লেখাটিতে ফিরে আসি। লেখার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আমরা জানছি ২০১৮-র অগাস্ট মাসে একটি স্কুল বাসের ওপরে সামরিক বিমান হানায় ৫০ জনেরও বেশি খুদে স্কুল ছাত্র মারা গিয়েছে। কিন্তু “woefully underreported relative to the magnitude of the ongoing crisis” – বর্তমানে যে পরিমাপের সংকট চলছে তার তুলনায় করুণভাবে এ নিয়ে প্রায় কোন রিপোর্ট নেই। এরপরে প্রবন্ধে একটি অমোঘ মন্তব্য রয়েছে – “এরকম অবহেলা আমাদের সামগ্রিক সংবেদনশীলতা যে বিবশ হয়ে পড়েছে (numbing of our collective sensitivity) তা বড়ো দগদগে করে দেখায়।” কোথায় রাখবো আমরা মানবাত্মার এবং আমাদের মরমী অস্তিত্ব ভুলুন্ঠিত হবার অপমান? একই ঘটনা কয়েক বছরের মধ্যে আমরা ইরাকে দেখেছি, দেখেছি সিরিয়াতে, দেখেছি আফগানিস্তানে। আমাদের যাপনে আর চৈতন্যে এভাবে হয়তো কষাঘাত করেনি – পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন!
স্মরণে রাখবো ১৯শে অগাস্ট হল World Humanitarian Day – বিশ্বমানবতা দিবস! ৭ জানুয়ারি, ২০১৭-তে ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত “Malnutrition in Yemen: an invisible crisis” শিরোনামের প্রবন্ধ থেকে আমরা জানছি – ১ কোটি ৪৪ লক্ষ মানুষ মারাত্মকভাবে খিদের অসুখ অপুষ্টিতে ভুগছে, ৩৭০,০০০ ইয়েমেনি শিশু ভয়ঙ্কর অপুষ্টিতে আক্রান্ত। UNICEF-এর হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১ কোটি (সঠিক হিসেব ৯৯০,০০০০) শিশুর কোন না কোনরকম “nutrition assistance” প্রয়োজন। ইয়েমেন খাদ্যের মূল্য বেড়েছে ৫৫%, জিডিপি-র সংকোচন হয়েছে ৩৩%। ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭-এ ল্যান্সেটে প্রকাশিত আরেকটি প্রবন্ধ – “Millions in need of humanitarian assistance in Yemen” – খুব স্পষ্ট করে জানালো – “The Saudi-led coalition, which has received logistical and intelligence support from the UK, the USA, and France, closed air, land, and sea access on Nov 6”।
একটি ক্ষুদ্র দেশকে সমস্ত দিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে কেবলমাত্র উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য। সমস্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, রোগ-মোকাবিলার প্রক্রিয়া এবং মাধ্যম, জলের ও বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হবার ফলে প্রতি ১০ মিনিটে একজন করে শিশু মারা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সরবরাহ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হবার আরো কিছু ধারাবাহিক ফলাফল আছে – (১) হাসপাতালে জেনেরাটর চালানো যাচ্ছেনা, (২) কোন আইসিইউ বা ইমার্জেন্সি ব্যবস্থা চালানো যাচ্ছেনা, (৩) ভ্যাক্সিন এবং ওষুধ সরবারাহের জন্য যে cold chain দরকার তা রক্ষা করা যাচ্ছেনা। এর দরুণ কোন প্রতিষেধক টীকা দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
ফলাফল? যেখানে ২০১৫-তে কোন ডিপথেরিয়া রোগী ছিলনা সেখানে ২০১৮-তে ৪৮ জন ডিপথেরিয়া রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে, ৩০০০-এর বেশি হামের রোগী (মৃত্যুর সংখ্যা ২০-র বেশি), নিউমোনিয়া এবং পোলিও সংক্রমণের আশঙ্কা গভীরভাবে দানা বাঁধছে। বোধহয় নিয়তির পরিহাস! ৮ জানুয়ারি, ২০১৯-এর আনন্দবাজার পত্রিকার খবর অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে হামে মৃত্যুর সংখ্যা ১৮। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেটা গভীর উদ্বেগের বিষয়। এবার সংখ্যাতাত্ত্বিক তুলনায় আসা যাক – পশ্চিমাবঙ্গের প্রায় ১০ কোটি জনসংখায় ১৮ জনের মৃত্যু, আর যুদ্ধবিক্ষত ইয়েমেনে ৩ কোটি মানুষের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ২০-র বেশি।
এখানে আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে হ্যাফডান ম্যালারের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাশিয়ার আলমা-আটা-য় গ্রহণ করা Declaration of Alma-Ata – International Conference on Primary Health Care”-এর কথা যেখানে প্রথম WHO-র তরফে বিশ্ববাসীর সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা (comprehensive primary health care) সুনিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে “২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য”-র শ্লোগান গৃহীত হয়েছিল। আলমা-আটা সনদের ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল – An acceptable level of health for all the people of the world by the year 2000 can be attained through a fuller and better use of the world’s resources, a considerable part of which is now spent on armaments and military conflicts. A genuine policy of independence, peace, détente and disarmament could and should release additional resources that could well be devoted to peaceful aims and in particular to the acceleration of social and economic development of which primary health care, as an essential part, should be allotted its proper share – অস্যার্থ, পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের স্বাস্থ্যের সুযোগহীন মানুষটির জন্যও প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা সুরক্ষিত করতে হবে এবং এজন্য স্বাধীনতা, শান্তি, দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা এবং নিরস্ত্রীকরণের নীতি গ্রহণ করতে হবে যার মধ্য দিয়ে একটি দেশের সুষম বিকাশের জন্য আরো বেশি মানবসম্পদ সৃষ্টি হতে পারে।
১৯৫০-৭০-র দশক জুড়ে বিশ্বরাজনীতিতে দ্বিমেরু বিশ্বের জীবন্ত উপস্থিতি ছিল। প্রবল পরাক্রান্ত, আগ্রাসী ও মুক্ত পুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো ভিন্ন একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব – সমাজতান্ত্রিক বলে যার উপস্থিতি ছিল জনমানসে। দ্বিমেরু বিশ্বের উপস্থিতির জন্য রাজনৈতিক এবং সামাজিক একটি পরিসর তৈরি হয়েছিল যাকে বলতে পারি “তৃতীয় পরিসর”। বিশ্বের মানুষের স্বাভাবিক আশা-আকাঞ্খা এবং দাবী নিয়ে দর কষাকষির ক্ষমতা বেশি ছিল। পরবর্তীতে একমেরু বিশ্বের উদ্ভব এসবকিছুকে পরিপূর্ণভাবে বিনষ্ট করে দেয় – আজকের ভারত এর একটি প্রোজ্জ্বলন্ত উদাহরণ। এ সময়েই পৃথিবী জুড়ে শ্লোগান উঠেছিল – স্বাস্থ্য আমার অধিকার। আবার অন্যদিকে তাকালে প্রান্তিক অশিক্ষিত বুভুক্ষু মানুষের কাছে শিক্ষা এবং বই পৌঁছে দেবার আন্দোলন, শিক্ষার অধিকারের আন্দোলন জনচেতনায় চেহারা নিচ্ছিল। এর উদাহরণ লাতিন আমেরিকায় পাউলো ফ্রেইরে-র আন্দোলন। ব্রেখটের সেই বিখ্যাত যুক্তি যেন নতুনভাবে জন্ম নিল – “ভুখা মানুষ বই ধরো, ওটা তোমার হাতিয়ার”। যদিও এ পরিসরে এ বিষয়ে আর কোন আলোচনা সমীচীন নয়। বরঞ্চ আমরা একটু ইতিহাসে ফিরে যাই। দেখে নিতে চেষ্টা করি কিভাবে ধীরে ধীরে “সকলের জন্য স্বাস্থ্য”-র শ্লোগান স্বাস্থ্যপরিষেবার পণ্য চেহারায় রূপান্তরিত হল। কিভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও কর্পোরেট পুঁজির চাপে এবং খোদ মেডিসিনের জগতের বিভিন্ন পরিবর্তন এ ঘটনা বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করলো, WHO হয়ে উঠলো অনুঘটক বা ঢাল।
ভুলে যাবার ঐতিহাসিক অধ্যায়
ভারী কৌতুহলোদ্দীপক একটি কাহিনী বলছেন স্বয়ং একজন যাঁদের হাত ধরে আধুনিক বিশ্বের আন্তর্জাতিক দরবারে প্রথম বিশ্ব স্বাস্থ্যনীতি জন্ম নিয়েছিলো। ১৯৪৫ পর্যন্ত স্বাস্থ্য একটি “ভুলে যাওয়া” তথা “forgotten” বিষয় ছিলো – One interesting example is that health was “forgotten” when the Covenant of the League of Nations was drafted after the first World War. Only at the last moment was world health brought in, producing the Health Section of the League of the Nations, one of the forerunners of the present FAO, as well as WHO. (K. Evang, “Political, national and traditional limitations to health control”, in Health of Mankind eds. G. E. W. Wolstenholme and Maeve O’Connor [CIBA Foundation Symposium], 1967, pp. 196-211)
ইভাং-এর বয়ানে – কে ভেবেছিলো যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন রাষ্ট্রপুঞ্জের চার্টার তৈরি হচ্ছে তখন স্বাস্থ্য আবার “forgotten” হয়ে যাবে? ঠিক এটাই ঘটেছিলো যখন ১৯৪৫-এর বসন্তে সান ফ্রান্সিসকোতে “জরুরী ভিত্তিতে” বিশ্ব স্বাস্থ্য-কে আলোচ্য তালিকায় আনা হয়। তিন জন মানুষ সেদিন উদ্যোগ নিয়েছিলেন – ব্রাজিলের তরফে ডাক্তার Paula Souza, চীনের তরফে ডাক্তার Szeming Sze এবং নরওয়ের তরফে ডাক্তার ইভাং স্বয়ং। (পূর্বোক্ত, পৃঃ ২০২-২০৩)
সেসময়ে মাত্র কয়েকটি দেশ ছিলো লীগ অব নেশনস-এ। আমেরিকা কখনো সদস্য-ই হয় নি, ১৯৩৩-এ জার্মানি বেরিয়ে যায়, সাত বছর সদস্য থাকার পরে জাপানও ১৯৩৩-এ বেরিয়ে যায়, ইটালি ১৯৩৭-এ, সোভিয়েট রাশিয়াকে বহিস্কার করে দেওয়া হয় ১৯৩৯-এ। ইভাং আরেকবার বিস্মিত হন – Who would have thought, therefore, that health would again be “forgotten” when the Charter of the United Nations was drafted at the end of the Second World War? ঠিক এ ঘটনাটিই ঘটেছিলো যখন বিশ্ব স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ নিয়ে ১৯৪৫-এর বসন্তে সান ফ্রান্সিসকোতে জরুরী ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য-কে আলোচ্য তালিকায় আনা হয়। তিন জন মানুষ সেদিন উদ্যোগ নিয়েছিলেন – ব্রাজিলের তরফে ডাক্তার Paula Souza, চীনের তরফে ডাক্তার Szeming Sze এবং নরওয়ের তরফে ডাক্তার ইভাং স্বয়ং। ফলে এ বয়ানের গুরুত্ব এতো বেশী!
এখানে যেকোন জিজ্ঞাসু পাঠককে ভাবাবে, স্বাস্থ্যের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বারেবারে ভুলে যাওয়া হচ্ছিলো কেন? সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর হবে সম্ভবত বাণিজ্য হিসেবে স্বাস্থ্য কতোটা লাভজনক হতে পারে এবং কি পরিমাণ মুনাফা দিতে পারে তা তখনো অব্দি বহুজাতিক কোম্পানী এবং বিশ্বে প্রভুত্বকারী ইউরো-আমেরিকার দেশগুলোর মাথায় আসে নি, বোধ করি ভালোভাবে নজরেও আসে নি।
২০০৫ সালে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীগুলোর পৃথিবীতে বিক্রীর পরিমাণ ছিল ৫০০ বিলিয়ন ডলার, ২০০৭-এ হল ৭১২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দু বছরে বিক্রী বেড়েছে শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশী। (সূত্রঃ Adriana Petryana – When Experiments Travel, Princeton University Press, 2009) ২০১৮-তে এর পরিমাণ হবার কথা ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। আরো গুরুত্বপূর্ণ হল এশিয়া এবং আফ্রিকায় ওষুধ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত বাজার বৃদ্ধির হার ১৭%, পূর্ব ইউরোপে ১১% এবং লাতিন আমেরিকায় ১০%। অথচ সমগ্র বিশ্বে এ হার মাত্র ৪%। আরেকটা তথ্য হল ২০০৫ সালে প্রযুক্তি-নির্ভর মেডিসিনের চাপে পড়ে ব্রাজিলকে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে।
এরকম একটি লাভজনক বিনিয়োগের চিত্র যতোদিন না স্পষ্ট হয়ে ঊঠেছে, ততদিন অব্দি নিও-লিবারাল অর্থনীতির কান্ডারীরা স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিনিয়োগ কর্মে সেভাবে হাত লাগায় নি। ১৯৭০-এর দশকের শুরু থেকে স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ ও বিপুল মুনাফার ধারণা নির্দিষ্টভাবে দানা বাঁধতে শুরু করে। সাথে সাথে বদলাতে শুরু করে ১৯৪৫ সাল অব্দি আন্তর্জাতিক জগতে “forgotten” বিষয়টির চরিত্র। এক নতুন যাত্রাপথ জন্ম নেয় – ১৯৭৮ সালের আলমা আটা সম্মেলনের “সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা”-র (comprehensive primary health care) এবং “২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য”-র বোধ থেকে ২০১৫-তে এসে অতিমাত্রায় বিক্রয়যোগ্য “স্বাস্থ্য পরিষেবা”-র পণ্য বাজারের বোধে প্রায় পূর্ণত রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া। অধুনা গবেষকেরা দেখিয়েছেন, আফ্রিকার যে দেশগুলোতে এবোলা (Ebola) এরকম মারনান্তক চেহারা নিল সে দেশগুলোতে IMF এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-এর চাপে জনস্বাস্থ্যখাতে ক্রমশ খরচা কমিয়ে প্রযুক্তি নির্ভর (যে প্রযুক্তি যেমন সিটি স্ক্যানার বা MRI কিনতে হয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে) স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয়েছে। ফলে এবোলা যখন মহামারির চেহারা নিয়েছে তার সাথে মোকাবিলা করার মতো কোনরকম পরিকাঠামো এ দেশগুলোতে ছিল না।
আমাদের এ আলোচনায় আমরা চারটে বিষয় নিয়ে ভেবে দেখবো – (১) “সকলের জন্য স্বাস্থ্য”-র শ্লোগান কি করে স্বাস্থ্য পরিষেবার মুক্ত বাজারের অর্থনীতির আওতায় চলে এলো; (২) প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার সংহত ধারণা কিভাবে বেছে-নেওয়া (selective) স্বাস্থ্য পরিষেবার ধারণাতে রূপান্তরিত করা হল, যার ফলে ঝাঁ চকচকে অত্যন্ত দামী (নামীও বটে) পাঁচতারা হাসপাতাল বা নার্সিং হোম “ভালো স্বাস্থ্য”-র সমার্থক হয়ে উঠলো; এবং (৩) ক্লিনিক্যাল হেলথ বা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ও এর চিকিৎসা এবং পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্যের মধ্যেকার দার্শনিক অবস্থানগত পার্থক্য মুছে গিয়ে দুটোই একাকার হয়ে গেলো, এবং (৪) কিভাবে জনমানসে “ভার্টিকাল হেলথ” অর্থাৎ ব্যক্তিরোগীর রোগ ধরে চিকিৎসা প্রতিস্থাপিত করছে “হরাইজন্টাল হেলথ” অর্থাৎ জনস্বাস্থ্য বলতে যা বোঝায় সে ধারণাকে। একইসাথে আমরা নজরে রাখবো মেডিসিনের জগতে শিক্ষাক্রমের ক্রম-রূপান্তর এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে ত্বরাণ্বিত করলো এবং এ পরিবর্তনের একটি উপাদান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিল।
সলতে পাকানোর কাহিনী
আমরা গত শতাব্দির ৬০-৭০-এর দশকের কথা ভাবি। দীর্ঘকালীন উপনিবেশিকতার পরে এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর একটা বড় অংশ ধীরে ধীরে স্বাধীনতা অর্জন করছে। দুটি বিষয় এসব দেশের কাছে গুরুত্ব নিয়ে হাজির হল। একদিকে, নিজস্ব যা যৎসামান্য সম্পদ আছে (বিশেষ করে মানব সম্পদ) তার সর্বোচ্চব্যবহার করতে হবে; অন্যদিকে, যুদ্ধ-দারিদ্র্য-বুভুক্ষা-দীর্ণ অগণন মানুষের কাছে স্বাস্থ্যের ন্যূনতম সুযোগ পৌঁছে দিতে হবে। ১৯৬৭ সালে একটি গবেষণা দেখালো – Some developing countries have developed health care programmes at the most peripheral level to meet the health and development needs of the deprived populations. Each experience has followed a particular approach. China uses mass education programmes and “barefoot doctors” to deliver primary health services. (Amor Benyoussef, Barbara Christian, “Health care in developing countries”, Social Science and Medicine 1967, 11 (6-7): 399-408) এদের আলোচনায় স্পষ্টভাবে বলা হল চীনে নগ্নপদ চিকিৎসক বা “barefoot doctors” এ সমস্যার অনেকটা সমাধান করেছে। এছাড়াও তানজানিয়া, কিউবা, ভেনেজুয়েলা এবং নাইজেরিয়াতে প্রায় একইরকম পদ্ধতিতে ফল পাওয়া যাচ্ছে। পৃথিবীতে সূচনা হল প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ধারণার। ১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকেই মেক্সিকোতে ডেভিড ওয়ার্নার-এর (সুবিদিত গ্রন্থ Where There Is No Doctor-এর লেখক) উদ্যোগে তৃণমূল স্তরে গ্রামের সাধারণ মানুষকে সামিল ও প্রশিক্ষিত করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত করার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। লাতিন আমেরিকার অনেকগুলো দেশেই ওয়ার্নারের প্রভাবে জনস্বাস্থ্য আন্দোলন পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। আমাদের ভারতে শুরু হয়েছিল জামখেদ আন্দোলন যা পরে জনস্বাস্থ্য অভিযান-এর রূপ নেয়।
একেবারে হালে পৃথিবীর সবচেয়ে মান্য ও চিকিৎসক মহলে সর্বাধিক পঠিত নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ এমন মন্তব্য করা হয়েছে যে আমেরিকা থেকে আগত একজন পর্যটকের কাছে কিউবা “অবাস্তব” এবং “মাথা ঘুরিয়ে দেবার মনে হয়”। হুবহু জার্নালের ভাষায় বললে – For a visitor from the United States, Cuba is disorienting…Cuban health care system also seems unreal. There are too many doctors. Everybody has a family physician. Everything is free, totally free — and not after prior approval or some copay. The whole system seems turned upside down. It is tightly organized, and the first priority is prevention. Although Cuba has limited economic resources, its health care system has solved some problems that ours has not yet managed to address. [আমেরিক থেকে আগত একজন পর্যটকের কাছে কিউবা মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো…কিউবার স্বাস্থ্য পরিষেবার বিষয়টি কেমন অবাস্তব বলে মনে হয়। প্রত্যেকের একজন করে পারিবারিক চিকিৎসক আছে। সমস্ত কিছু বিনামূল্যে – কোন ইন্সিউরেন্স কোম্পানির আগাম অনুমোদন ছাড়াই। সমস্ত ব্যবস্থাটি মনে হয় আপাদ-মস্তক উল্টে আছে। সমগ্র ব্যবস্থা সুশৃঙ্খলভাবে সংগঠিত, এবং প্রাথমিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রতিরোধ বা প্রিভেনশন-এর ওপরে। যদিও কিউবার অর্থনৈ্তিক সামর্থ্য নিতান্ত সীমিত, এর স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা এমন কিছু সমস্যার সমাধান করেছে যা আমাদের ব্যবস্থা এখনো নজর করে উঠতে পারেনি।] (Edward Campion and Stephen Morrissey, “A Different Model – Medical Care in Cuba”, New England Journal of Medicine 2013, 368(4): 297-299)
মোদ্দা বিষয় হল, ১৯৭০ থেকে ১৯৭৮-এর মধ্যে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের বিভিন্ন রূপ তৈরি হতে থাকে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮-এর মধ্যে চীন সোভিয়েট রাশিয়ার সহযোগিতায় এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশের সমর্থনে হু-কে তৃণমূল স্তরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে প্রসারিত করা এবং রোগের ক্ষেত্রে সামাজিক ভূমিকার ব্যাপারে আরো বেশী যত্নবান ও সক্রিয় হবার জন্য চাপ দিতে থাকে। এক গবেষক দেখিয়েছেন (Anne-Emmanuel Birn, “The stages of international (global) health: Histories of success or successes of history?”, Global Public Health 2009, 4(1): 50-68), যদিও সোভিয়েট রাশিয়া ১৯৪৯-১৯৫৭ পর্যন্ত সময়ে হু-র সদস্য ছিলো না কিন্তু হু-র বাৎসরিক বাজেটের ৬% যোগাত এ দেশটি। ১৯৫৯ সালে সদস্য হবার পরে এর পরিমাণ বেড়ে হয় ১৩%।
১৯৭৮- “সকলের জন্য স্বাস্থ্য”-এর ঐতিহাসিক শ্লোগান
১৯৭৮ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সেসময় অব্দি সবচেয়ে বড়ো সম্মেলন হল অবিভক্ত রাশিয়ার কাজাখিস্তানে, ৬-১২ সেপ্টেম্বর। ১৩৪টি দেশের প্রতিনিধি, ৬৭টি আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং বহুসংখ্যক অ-সরকারী সংগঠন এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO এবং শিশুদের আন্তর্জাতিক সংস্থা UNICEF ছিল এ সম্মেলনের যৌথ আহ্বায়ক।
উল্লেখজনকভাবে, চীন এ সম্মেলনে অংশ নেয় নি। ১৯৭৮-এ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব ছিলেন ডঃ হাফডান ম্যালার (Halfdan Mahler)। তাঁর দার্শনিক অবস্থানের ও চিন্তার একটি প্রতিফলিত চেহারাও বটে এ সম্মেলন। ইতিহাস বহু সময়েই নৈর্ব্যক্তিক হলেও ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে ব্যক্তির ভূমিকা বিশেষভাবে গুরত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ ঐতিহাসিক সম্মেলনে ঘোষণা করা হল – Health for All by 2000 A.D (২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য)। এ ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের অভিমুখ ও গতিবেগের জন্ম দিলো। ২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য ভীষণভাবে অধরা থেকে গেলেও বেশ কয়েকটি দেশে সরকারী স্তরে ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ-সরকারীভাবে comprehensive primary health care বা সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার ধারণা ক্রমশ বেগবান হয়ে ওঠে। ডঃ ম্যালারকে আমরা আরেকবার দেখি ২০০০ সালে, বাংলাদেশের সাভারে। First People’s Health Assembly সংগঠিত হয়েছিল সাভারে। মজার ব্যাপার হল, comprehensive primary health care বা সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা এ সম্মেলনে বলা হলেও একমাত্র ডঃ ম্যালার ছাড়া হু-এর তরফে আর কোন উচ্চপদস্থ কর্তা ব্যক্তি এ সম্মেলনে উপস্থিত হন নি। হু-এর মধ্যেকার বিভাজন সামনে আসতে শুরু করলো ২০০০ সালের মধ্যেই। এ সম্মেলনে আক্ষেপ করে বলা হল – The WHO must be an open and democratic organization that can also respond to the grass roots: listening to the people should not be difficult for Gro Harlem Brundtland, a former politician, and it is regrettable that she is not attending the People’s Health Assembly. Her success as director general depends on the growth of popular health movements all over the globe which will be able to back up her call to make health central to the development process. (“The People’s Health Assembly”, British Medical Journal 321 (2000): 1361-2)
একদিকে চীন থেকে কিউবা পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য লাগাতার প্রয়াসের ফলিত চেহারা, হু-র তৎকালীন ডিরেক্টর জেনেরাল ডঃ ম্যালার-এর বিশেষ মতাদর্শগত অবস্থান, আবার অন্যদিকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির বর্তমান সর্বগ্রাসী শক্তি ও উপস্থিতির তুলনায় দুর্বলতর অবস্থান এবং একমেরু বিশ্ব না থাকা – সবকিছুর সামগ্রিক যোগফলে ও ফলশ্রুতিতে জন্ম নিল ১৯৭৮-এর সনদ। মোট ১০টি অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদে বিভক্ত এই ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট ভাষায় বলা হল – “that the attainment of the highest possible level of health is a most important world-wide social goal whose realization requires the action of many other social and economic sectors in addition to the health sector”। অর্থাৎ স্বাস্থ্য-কে অর্জন করা এবং একে রক্ষা করা আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষের মধ্যে একটি এবং এ লক্ষ অর্জনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যের বাইরেও আরো অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ জড়িয়ে আছে। এক কথায় বলা যায় স্বাস্থ্য একটি ব্যতিক্রমহীনভাবে রাজনৈতিক বিষয়ও বটে। আরো বলা হল – The people have the right and duty to participate individually and collectively in the planning and implementation of their health care. অর্থাৎ একজন নাগরিকের (প্রজার নয়) প্রতিচ্ছবি এলো ঘোষণাতে।
আমরা দেখবো কিভাবে নাগরিকের দায়িত্ব ও অধিকারের এ ধারণা পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে পর্যবসিত হল consumer বা ভোক্তার ধারণায় এবং সামাজিক মানুষের পরিবর্তে একক ব্যক্তি ও অর্থনৈতিক মানুষের ধারণায়। দায়িত্ব ও অধিকারের ধারণা রূপান্তরিত হল স্বাস্থ্যের মুক্ত বাজারে ক্রেতার তথাকথিত choice-এর বোধে। স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাও খুব স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারিত হয়েছিলো ১৯৭৮-এর ঘোষণাপত্রে। নয়া-অর্থনৈতিক নীতি ও ধারণায় যেমন জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনুষঙ্গের মাঝে বিভাজন রেখা টানা হয় সেরকম কোন বিভাজন রেখা এখানে অনুপস্থিত। স্বাস্থ্যকে তখনো রাষ্ট্রের পরিবর্তে খোলা বাজারের হাতে অর্পণ করা হয় নি।
ডেভিড ওয়ার্নার যখন ১৯৬০-৭০-এর পশ্চিম মেক্সিকোতে হতদরিদ্র জনজাতির মাঝে একেবারেই স্থানীয় সম্পদ ও জনতাকে ব্যবহার করে স্বাস্থ্যের বোধ ও এর জন্য আন্দোলন গড়ে তুলছেন তখন তাঁকে সম্মিলিত ল্যান্ড ব্যাংক-ও গড়ে তুলতে হচ্ছে দারিদ্র্যের মাত্রা হ্রাস করার জন্য। সেসময়ে তাঁর স্বাস্থ্য আন্দোলনের বৃহৎ প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছে নাফটা বা North American Free Trade Agreement। নাফটা মেক্সিকো সরকারকে চাপ দিচ্ছে যাতে এদের বীজ ও প্রযুক্তি অবাধে ব্যবহার করা যায়। এবং এ ঘটনা ঘটাতে পারলে জমি ব্যাংক উঠে যাবে, কৃষক আবার ঋণের জালে জড়াবে, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অস্তিত্বও থাকবে না। এরকম সহজবোধ্য কারণে জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনুষঙ্গের মাঝে বিভাজন রেখা টানা নয়া অর্থনীতির প্রবক্তাদের জন্য খুব জরুরী হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ের একটি প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে যে আমেরিকা ইরাকে যুদ্ধের জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে প্রস্তুত, কিন্তু এইডস, যক্ষা এবং ম্যালেরিয়ার মোকাবিলার জন্য তৈরী Global Fund-এ মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার দেয়। (John H Hall, Richard Taylor, “Health for all beyond 2000: the demise of of the Alma-Ata Declaration and primary health care in developing countries”, Medical Journal of Australia 178 (2003): 17-20)
এ সনদে আরো বলা হল – “A genuine policy of independence, peace, détente and disarmam ent could and should release additional resources that could well be devoted to peaceful aims and in particular to the acceleration of social and economic development of which primary health care, as an essential part, should be allotted its proper share.” এ বক্তব্য থেকে নিতান্ত পরিষ্কার হয় যে যুদ্ধখাতে ব্যয়বরাদ্দ স্বাস্থ্যকে সঙ্কুচিত করে এবং প্রথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কার্যকরী করতে হলে শান্তির জন্য প্রচেষ্টাও একটি অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, যুদ্ধখাতে ব্যয়-বরাদ্দ কমিয়ে জনকল্যাণমূলক ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ানোর মতো ঘোরতর রাজনৈতিক বার্তাও ছিলো এ ঘোষণাপত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট।
মুশকিল হচ্ছে তেলের এবং খনিজ সম্পদের বাজারের জন্য সমগ্র পশ্চিম এশিয়া ও মিশর অশান্ত হয়ে না উঠলে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রীর বিপুল মুনাফা হয় না। স্বাস্থ্য এখানে দুয়োরাণীর-ও অধম যে! এজন্য এরকম সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সনদপত্র মুক্ত বাজারের প্রবক্তাদের পক্ষে হজম করা অসম্ভব একটি ঘটনা। ২০১৫ সালে ফরচুন পত্রিকার সমীক্ষা অনুযায়ী সবচেয়ে লাভজনক প্রথম ১০টি লগ্নীর মধ্যে চিকিৎসা পরিষেবার অবস্থান।
এ কারণে ১৯৭৮-এর প্রতিক্রিয়ায় এবং এ প্রবণতাকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিহত করার জন্য আরেকটি আন্তর্জাতিক কার্যক্রম সেসময় দিয়েই জন্ম নিতে থাকলো। অতি সংক্ষেপে সে ইতিহাস একবার দেখে নেওয়া যাক।
তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে
১৯৭৭ সালে Allan Enthoven মুক্ত বাজারের উপযোগী Consumer Choice Health Plan (“এ ন্যাশনাল হেলথ ইন্সিউরেন্স প্রোপোজাল বেসড অন রেগুলেটেড কমপিটিসন ইন দ্য প্রাইভেট সেক্টর”) তৈরি করলেন। আমেরিকার কার্টার প্রশাসন এটাকে অনুমোদন করলো। নিঊ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে “Consumer Choice Health Plan” শিরোনামে দুটো কিস্তিতে প্রকাশিত হল এ লেখা। ১৯৭৯-এর ২৭শে ডিসেম্বর Wall Street Journal-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করে দেখালো যে হেলথ কেয়ার করপোরেশনগুলোর নীট আয় ১৯৭৯ সালে ৩০-৩৫% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ১৯৮০ সালে আরো ২০-২৫% আয় বৃদ্ধি প্রত্যাশিত। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর প্রাক্তন প্রধান সম্পাদক তাঁর এক প্রবন্ধে জানালেন – ১৯৭৯ সালে কেবলমাত্র বিভিন্ন ধরনের ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলার এবং যৌগিক পদ্ধতিতে প্রতি বছরে শতকরা ১৫ ভাগ হারে বাড়বে। (Arnold Relman, “The New Medical-Industrial Complex,” NEJM 1980, 303(17): 963-970) এ লেখাতেই রেলম্যান জানালেন যে আমেরিকানরা ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও মালিকনায় এবং মুনাফার তাগিদকে বিশ্বাস করে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো যে মেডিক্যাল পরিষেবাকে মুক্ত বাজারের হাতে ছেড়ে দেবার এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র হিসেবে দেখার প্রথম প্রস্তাব আসে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো-র সুবিখ্যাত গবেষণাপত্র “Uncertainty and the Welfare Economics of Medical Care”। এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল The American Economic Review-এ ১৯৬৩ সালে। মজার ব্যাপার হল জনস্বাস্থ্য নিয়ে WHO-র অবস্থান সাম্রাজ্যবাদ এবং কর্পোরেট পুঁজির চাপে যখন ক্রমাগত বদলে বদলে যাচ্ছে, সংকুচিত হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্র এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ তখন অর্থাৎ ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে WHO-র মুখপত্র Bulletin of the WHO-তে কেনেথ অ্যারো-র লেখাটির নির্বাচিত অংশ ছাপা হল। মূল লেখাটি ৩৩ পৃষ্ঠার, WHO ছেপেছিল ৯ পৃষ্ঠা। অ্যারো তাঁর অবস্থান প্রবন্ধের গোড়াতেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন – “the subject is the medical-care, not health. The causal factors in health are many, and the provisio of medical care is only one.” এরপরে তিনি “analysis of the medical-care market”-এ প্রবেশ করেন। বলেন – “in the analysis of the medical-care market is comparison between the actual market and the competitive model…” ইন্সিউরেন্সের প্রসঙ্গ আনেন অ্যারো – “It is frequently observed that widespread medical insurance increase the demand for medical care.” এক অদ্ভুত যুক্তি জালের মধ্যে আমরা প্রবেশ করলাম – একদিকে, ইন্সিউরেন্সের প্রসঙ্গ এলো স্বাস্থ্য পরিষেবার জগতে; অন্যদিকে, ইন্সিউরেন্সের বহু বিস্তৃত ব্যবহার যে স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা বাড়াবে এ প্রসঙ্গও চলে এলো। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি যে পণ্য দুনিয়ার অন্যক্ষেত্রের মতো এখানে শুধু কেনাবেচার-র সম্পর্ক নয় – একজন ব্যক্তি মানুষের অন্যের স্বাস্থ্য নিয়েও চিন্তা ও ঊদ্বেগ থাকে যা পণ্য জগতের অন্যক্ষেত্রে দেখা যাবেনা। তাঁর অভিমত – “The economic manifestations of this taste are to be found in individual donations to hospitals and to medical education, as well as in the widely accepted responsibilities of government in this area.” KFC, Nike কিংবা অ্যাডিডাসের ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয়ই এ দৃশ্য দেখতে পাবোনা।
প্রসঙ্গত আমরা স্মরণ করবো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রয়োজনে নতুন নতুন প্রযুক্তির জন্ম হয়েছিলো (যেমন নিউক্লিয়ার অ্যাক্সিলেরটর, যার ফলিত চেহারা সিটি স্ক্যানার, এম আর আই ইত্যাদি) এবং এর জন্য স্বাভাবিকভাবেই বিপুল অর্থের বিনিয়োগ হয়েছিলো। যুদ্ধোত্তর সময়ে এই বিনিয়োগের পরবর্তী দীর্ঘকালীন মুনাফা ধরে রাখার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে এ সমস্ত প্রযুক্তি রফতানি নিতান্ত জরুরী হয়ে পড়লো। মেডিসিনের জগত এক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল ও কার্যকরী অবস্থা তৈরি করতে পেরেছিল। কারণ সহজেই অনুমেয়। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব মুহূর্ত থেকে সবসময়েই মানুষের স্বাস্থ্য ও অসুস্থতা একসাথে সহাবস্থান করে। ফলে অসুস্থ মানুষ মেডিসিনের ও চিকিৎসকের ওপরে নির্ভর করবেই এবং এর সাথে সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থাকে যদি প্রযুক্তি নির্ভর করে তোলা যায় তাহলে অসুস্থতা থেকে আহরণ করা অবাধ মুনাফা নিয়ে দুশ্চিন্তা কমে যায়। এর পূর্বশর্ত দুটি – (১) চিকিৎসাকে মুক্ত বাজারের অর্থনীতির আওতায় আনতে হবে এবং সাধারণ জনসমাজকে এই অর্থনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী করে তুলতে হবে, (২) স্বাস্থ্য-র এবং “সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা”-র (comprehensive primary health care) ধারণাকে স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং “বেছে নেওয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা”-র (selective primary health care) ধারণা দিয়ে ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপিত করতে হবে। একই সাথে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে পূর্ণত মুক্ত করে ফেলতে হবে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন কিভাবে ১৯৭০ পরবর্তী সময়ে নয়া-উদারবাদী স্বাস্থ্যনীতি “have shifted resources from the public to the private sector, reduced benefits to recipients, and affected the lives of clients and workers alike.” (Mimi Abramovitz, Jennifer Zelnick, “Double Jeopardy: The Impact of Neoliberalism on Care Workers in the United States and South Africa”, International Journal of Health Services 2010, 40 (1): 97-117)
“Selective Primary Health Care” শিরোনামে প্রথম লেখা প্রকাশিত হল নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এ ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে। প্রাথমিকভাবে আলমা-আটা কনফারেন্স-এর প্রতিধ্বনির মতো কিন্তু ভিন্ন যুক্তিক্রম দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হল এর যাথার্থ্য। লেখার শুরুতে জানানো হল পৃথিবীর অনুন্নত বিশ্বের ৩০০ কোটি মানুষ “suffer from a plethora of infectious diseases.” আসল মজা শুরু হল তারপরে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা-কে উদ্ধৃত করে বলা হল – যে যুগে আমরা ক্রম-হ্রাসমান সম্পদ পাচ্ছি তখন কিভাবে যারা নীচের দিকে আটকা পড়ে আছে তাদের জন্য ২০০০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য ও ভালো-থাকা-কে সুনিশ্চিত করতে পারি? (Julia A. Walsh and Kenneth S. Warren, “Selective Primary Health Care: An Interim Strategy for Disease Control in Developing Countries,” NEJM 1979, 301(18): 967-974)
সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল এ লেখায় ২০০০ সালের উল্লেখ, “Selective Primary Health Care”–এর ধারণার আমদানি এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-এর আগমন ঘটলো স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্টে। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে ডেভিড প্রাইস দেখিয়েছেন “How the World Trade Organizaton is shaping domestic policies in health care”। (Lancet 354 (1999): 1889-92)। NEJM-এ ১৯৮১ সালে প্রকাশিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখায় (“Health Care in the Developng World: Problems of Scarcity and Choice”) লেখকেরা বললেন যে গ্রামীন জনসাধারণের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যাবস্থা-কেন্দ্রিক যে দৃষ্টিভঙ্গি “may need to be modified to address different problems arising from life styles and diets in the urban setting.” অদ্ভুত ব্যাপার হল শহর এবং গ্রামকে গুলিয়ে দেবার চেষ্টা এবং সামাজিক অসাম্যের ব্যাধিকে লাইফ স্টাইল এবং খাদ্যাভাসে সীমায়িত করে ফেলা।
এসমস্ত কিছুই ১৯৭৮-এর সম্মেলনের বিপরীতে ও বৃহৎ ওষুধ কোম্পানী এবং আমেরিকার উপযোগী মুক্ত নয়া-উদারবাদী বাজারের অর্থনীতির স্বপক্ষে। শুরু হল বিশ্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থার রূপান্তর। শুরু হল অসুস্থতা ফেরী করা বা “disease mongering”-এর বিশ্বব্যাপী জাল বিস্তারের সফল, সূক্ষ্ম ও বিপজ্জনক কার্যক্রম। (দ্রষ্টব্য – Ray Moynihan, Allan Cassels, Selling Sickness: How Drug Companies Are Turning Us All Into Patients, 2005)
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এর সম্পাদক আর্নল্ড রেলম্যান পরিষ্কার ভাষায় জানালেন যে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রাথমিক নীতি হবে “এমন এক নীতি যা দামের বিনিময়ে নির্ধারিত মুক্ত বাজারের শক্তিকে শক্তিশালী করবে”। (Arnold Relman, “The Allocation of Medical Resources”, Journal of Medical Education 1979, 55(2): 99-104)। অস্যার্থ, যা ছিল রাষ্ট্রের হাতে তাকে তুলে দিতে হবে মুক্ত বাজারের শক্তির হাতে। স্বাস্থ্য রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হবার বদলে (যেমন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ বা আলমা আটা-র ঘোষণায় বলা হয়েছিল) চলে যাবে বাজারের হাতে। এবং মুক্ত অর্থনীতি ও বাজার যা কেনা-বেচা করবে তা “স্বাস্থ্য পরিষেবা”, স্বাস্থ্য নয়। “স্বাস্থ্য” পর্যবসিত ও রূপান্তরিত হল “স্বাস্থ্য পরিষেবা”-তে। কৌতুকজনক অথচ অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণে এগিয়ে এলো বা গ্রহণ করতে বাধ্য হল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
এর বিপরীত স্বরও কিংবা সতর্ক বার্তা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু এতে কান দেবার মতো মানসিক অবস্থান পৃথিবীর প্রাধান্যকারী অংশের ছিলোনা। Kingman Brewster ১৯৭৯-র অক্টোবর মাসে “জার্নাল অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি অব মেডিসিন”-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন “Health at any price?” শিরোনামে। এ প্রবন্ধে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফারাক করলেন পণ্য দুনিয়ার “economic man” এবং সাধারণ রোগীর মাঝে। আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ফারাক হল এখানে আর্ত মানুষ বিশ্বাস করার মতো একজন “trustee” খোঁজে, পণ্য দুনিয়ার “provider” নয় – The trouble is that the patient, when he thinks something is wrong with him, is not an economic man. He is a fearful, ignorant, helpless, miserable creature. He does want health, almost at any price. He is not looking for what the economists call a ‘provider’. এ প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে মন্তব্য করেন চিকিৎসার “বাজার” পড়ে যায় কারণা “the physician-patient relationship is not one of a seller and a buyer bargaining for each other”।
আমরা বর্তমান সময়ে দেখবো পণ্য দুনিয়ার সাধারণ নিয়মের মধ্যে একজন “economic man” হিসেবে আর্ত, চিকিৎসাপ্রার্থী একজন রোগীকে গড়ে নেবার চেষ্টা চলছে। ক্রেতা-বিক্রেতার দরাদরির মধ্যে এসে পড়ছে চিকিৎসার মতো জীবন-মরণের সীমানায় দাঁড়ানো স্পর্শকাতর বিষয়টি। মেডিক্যাল কেয়ার বা স্বাস্থ্য পরিষেবা গিলে নিয়েছে স্বাভাবিক “স্বাস্থ্য”-র বোধকে। আমিও এখানে স্বাস্থ্যকে রাখলাম বন্ধনীচিহ্নের মাঝে। বাজারের কি পরিহাস বা শক্তি যাই বলুন!
হু-র আগে UNICEF “সিলেকটিভ প্রাইমারী হেলথ কেয়ার”-এর ধারণা গ্রহণ করে এবং GOBI (Growth monitoring, Oral re-hydration Solution, brestfeeding and Immunization) প্রকল্প গ্রহণ করে। এ বিষয়ে ফ্রান বম-এর গবেষণা পত্র উল্লেখযোগ্য (Fran Baum, “Health for All Now! Reviving the spirit of Alma Ata in the twenty-first century: An Introduction to the Alma Ata Declaration,” Social Medicine 2007, 2(1): 34-41) একই সাথে হারিয়ে যেতে থাকলো সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ধারণা।
২০০০ সাল থেকে আসতে শুরু করলো “universal health coverage (UHC)” বা “universal access to healthcare”-এর তত্ত্ব। WHO জানালো – The goal of universal health coverage is to ensure that all people obtain the health services they need without suffering financial hardship when paying for them. মেডিসিনের মান্য জার্নাল ল্যান্সেট এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করছে – “The resolution and its UHC concept firmly and narrowly centre on health insurance packages financed through pre-payment.” Lancet-এর আরেকটি পর্যবেক্ষণ – “the clinical sector commonly tends to emphasize specialist curative over health promotion or preventive primary care.” (“Public health, universal health coverage and Sustainable Development Goals: can they coexist?”, Lancet June 30, 2015, pp. 1-3) এ লেখাতেই বলা হল ভারসাম্যহীনভাবে UHC-র অনুপ্রবেশ স্বাস্থ্য ও সামাজিক ক্ষেত্রে অসাম্য বাড়িয়ে দেয়, স্বাস্থ্য ও এ সংক্রান্ত বিনিয়োগকে সম্পদশালী গ্রুপের পক্ষে “disproportionately” লাভজনক করে তোলে।
এছাড়াও, হেলথ সার্ভিস বা স্বাস্থ্য পরিষেবার মজা হচ্ছে যে যত পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারবে সে বিনিয়োগকারীর সার্ভিস ততো লোভনীয় ও আকর্ষণীয় হবে। এমন কি সাধারণ মধ্যবিত্ত, মায় দরিদ্র মানুষ পর্যন্ত ঘটি-বাটি বন্ধক রেখে এই সার্ভিস পাঁচতারা ঝাঁ-চকচকে প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে কিনবে। আর পাঁচটা পণ্যের মতো চিকিৎসা-তুল্য বিষয় হয়ে ওঠে কেনাবেচার সামগ্রী। ভারতের প্রসঙ্গে একেবারে হালে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এ মন্তব্য করা হল – যত বেশি করে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শুকিয়ে যেতে ও হ্রাস পেতে থাকলো তত বেশি করে প্রাইভেট সেক্টর সক্রিয় ও কার্যকরী হয়ে উঠলো (K. Srinath Reddy, “India’s Apirations for Universal Health Coverage”, New England Journal of Medicine 2015, 371 (1): 1-5) বর্তমানে প্রাইভেট সেক্টর ইন-ডোর রোগীর ৮০% এবং আউটডোর রোগীর ৬০%-এর পরিষেবা দেয়। এর ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্যখাতে ৭০% ভাগ খরচ নিজেদের পকেট থেকে মেটাতে হয়, মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ে। AIIMS-এর মতো সরকারী ভর্তুকী পুষ্ট আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা ছাত্রদের শতকরা ৫৪ জন পাড়ি দেয় বিদেশে, এদেশে থাকে না। এ তথ্য হু-র পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যাচ্ছে (“High-end physician migration from India”, Bulletin of the World Health Organization, জানুয়ারি ২০০৮, পৃঃ ৪০-৪৫)
আমেরিকান অর্থনৈতিক দর্শন তৈরি করে নেয় চিকিৎসা পণ্যের বাজার। সরকারী হাসপাতাল পড়ে থাকে হতদরিদ্রদের জন্য। Lancet-এ ২০১৪ সালের একটি প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছিল যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বাস্থ্যের লক্ষ্যসীমায় পৌঁছুন হল “an achievement that has the potential totransform health systems, especially for the poorest people.” রাষ্ট্রহীন মানুষেরা যাদের মধ্যে উদ্বাস্তু বা শরণার্থী, প্রমাণপত্রহীন পরিযায়ী মানুষ অথবা যাদের জন্মের নথিভূক্তি অস্বীকার করা হয়েছে, এদেরকে রাষ্ট্রের সর্বশক্তিমান কর্তাব্যক্তিরা “without legal entitlement to any rights to health care” বলে মনে করেন। (“What does universal health coverage mean?”, Lancet January 18, 2014, pp. 277-279) মানুষ হিসেবে এরা বেঁচে আছে অথচ স্বাস্থ্যের অধিকার নেই! এ এক বিচিত্র ছলনা – কে নেবে এ সমাধানের দায়িত্ব? এখানে আরেকটি প্রবন্ধের কথা বলবো যেখানে দেখানো হয়েছে নতুন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত প্রোগ্রামগুলো প্রাথমিকভাবে ধনীদের কাছে পৌঁছয়, এবং পরবর্তী সময়ে তা চুঁইয়ে পড়ে দরিদ্রদের মাঝে। (“Universal health coverage: friend or foe of health equity?”, Lancet June 25, 2011, pp. 2160-2161)
উল্লেখযোগ্য, এক্ষেত্রে ইউরোপীয় এবং আমেরিকান ধারণার মাঝে পার্থক্য রয়েছে। হু-র ইউরোপীয় রিজিওনাল অফিসের তরফে মার্গারেট হোয়াইটহেড-এর রিপোর্ট ১৯৯২ সালে জানালো – Equity is restricted unnecessarily if a country’s available resources are spent almost exclusively on high technology medical services which cater for a small segment of the population. অর্থাৎ স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ইক্যুইটির মতো বিষয়কে ইউরোপীয় রিপোর্টে সংযুক্ত করা হল রোগীর সামাজিক অবস্থার সাথে। আমেরিকান ধারণার মতো রোগী কেবলমাত্র একক ভোক্তা অর্থনৈতিক মানুষ হিসেবে থাকছে না। মেডিক্যাল টুরিজম-এর মতো “the medical poverty trap” বলে একটি নতুন শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হতে শুরু হয়েছে মেডিসিনের জগতে। (“Equity and health sector reforms: can low-income countries escape the medical poverty trap?”, Lancet 358 (2001): 833-36)
এবার ভারতের দিকে চোখ ফেরাই। ১৯৪৩ সালে স্যার জোসেফ ভোরের নেতৃত্বে যে “ভোর কমিটি” তৈরি হয়েছিল সে কমিটি রিপোর্ট জমা দেয় ১৯৪৬ সালে। সেসময়েও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল যে পাশ করা “অ্যালোপ্যাথিক” ডাক্তারদের ৭৭% রয়েছে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে, ২৩% সরকারি চাকরিতে। সেসময়ে ভোর কমিটির রিপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষজ্ঞদের একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এঁরা ছিলেন Dalrymple-Champneys (ডেপুটি চিফ মেডিক্যাল অফিসার, ইংল্যান্ড), জন রাইল (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি), হেনরি সিজারিস্ট (জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি), ডেন জে ভগান (অক্সফোর্ড) এবং আমেরিকার বিশ্বখ্যাত সংস্থা CDC-র প্রতিষ্ঠাটা জোসেফ মাউন্টেন। ১৯৪৭ সালেই Dalrymple-Champneys বলেছিলেন – “ভোর কমিটির সুপারিশ সম্ভবত পেছনে পড়ে রইবে।” ১৯৪৬ সালে হেনরি সিজারিস্ট সতর্ক করেছিলেন – “health education was wasted unless it is somehow combined with education in citizenship, which is impossible without history.” ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এ কথাগুলো বেশি প্রযোজ্য। কারণ, স্বাস্থ্যের নাগরিকত্বের কোন ধারণা এখানে গড়ে ওঠেনি। স্বাস্থ্য এখানে মৌলিক অধিকার নয়, মানবিধাকরও নয়।
১৯৮০-র দশকের শেষ থেকে নিও-লিবারাল অর্থনীতির পরিণতিতে এবং অভিঘাতে হাঙ্গর-সদৃশ কর্পোরেট সংস্থা এবং বহুজাতিক কোম্পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন এবং বিশ্ব ব্যাংকের চাপে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-র অবস্থান বদলাতে থাকে। কর্পোরেট হাসপাতাল এবং ভারতজোড়া নার্সিং হোমের বাজার গজিয়ে ওঠে। আর্ত রোগী দ্রুত রূপান্তরিত হতে থাকে “economic man”-এ। ডাক্তার বা হাসপাতাল “trustee” হবার পরিবর্তে হয়ে ওঠে “provider”, যেমনটা ব্রুস্টার সতর্ক করেছিলেন। প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সাথে (ভোর কমিটির রিপোর্ট স্মরণ করুন) জুড়ে যেতে থাকে বাণিজ্যীকিকরণ, কর্পোরাইটেজশন এবং বিপণন – স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে।
এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ পাঞ্জাবে এবং গুজরাটে ১৯৬০-৭০-এর দশকে সরকারি তথা জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় যে হাসপাতালগুলো তৈরি হয়েছিল সেগুলো একের পর এক কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। জানুয়ারি ২১, ২০১৯-এর Wire.in সংবাদপত্রের খবরের শিরোনাম – “Public Healthcare Facilities to Be Handed Over to Private Sector in Gujarat, Punjab”। এই মর্মে সরকারি বিজ্ঞপ্তিও জারী হয়েছে। জানুয়ারি ৯, ২০১৯-এ একই সংবাদপত্রের খবর – “In the Wake of Ayushman Bharat Come Sops for Private Hospitals”। এ খবরে জানানো হয়েছে – “The Narendra Modi government has announced plans to make hospitals into an “industry” under the Ayushman Bharat health insurance scheme and give a range of sops to private hospitals such as land and funding.”
একেবারে হালে এসে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এ সার্বিকভাবে এরকম আর্ত অবস্থার প্রতিফলন ঘটছে – “Primary Care – Will It Survive?” শিরোনামের প্রবন্ধে। বলা হচ্ছে – “primary care, the backbone of the nation’s health system, is at grave risk of collapse”।
এবার আমরা প্রবেশ করবো ক্লিনিক্যাল হেলথ তথা ব্যক্তি রোগীর চিকিৎসার ধরন ও পাবলিক হেলথ বা জনসমষ্টির চিকিৎসার ধরনের মধ্যেকার মৌলিক পার্থক্য এবং মেডিক্যাল পাঠক্রমের আধুনিক চরিত্র বোঝার দুনিয়ায়। Lancet-এ প্রকাশিত পূর্বোক্ত প্রবন্ধের পর্যবেক্ষণ ছিল ক্লিনিক্যাল সেক্টর সাধারণভাবে জোর দেয় “specialist curative over health promotion or preventive primary care”-এ। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে প্রকাশিত আরেকটি প্রবন্ধ – আমরা কি মেডিক্যাল শিক্ষার জগতে বুদ্বুদের বাজারে বাস করছি? (Scott F. Dowell, Jordan W. Taperro and Thomas R. Frieden, “Are We Living in a Medical Education Bubble Market?,” 2011, 364(4): 300-301)
এ প্রবন্ধের লেখকেরা বলছেন যে আমরা বর্তমানে বাজার অর্থনীতির সাধারণ নিয়মের মতো মেডিক্যাল শিক্ষার জগতেও আমরা একটি বুদ্বুদের বাজারে অবস্থান করছি। এর পরিণতিতে একটি সময় সমাগত যখন সে বুদ্বুদ ফেটে যাবে এবং “At the extreme, we will march down the debt-to-income-ratio ladder, through psychiatrists to cardiologists to orthopedists . . . until no one is left but the MBAs.”
মেডিক্যাল শিক্ষার এ চেহারা তো আমরা এ দেশেও প্রত্যক্ষ করছি। কেন ঘটছে এরকম ঘটনা? কেন গভীরভাবে বদলে যাচ্ছে মেডিক্যাল শিক্ষার ধরন-ধারণ? কেন পরিহার্য কিন্তু অবধারিত “অ-মানবিকীকরণ” ঘটছে বারংবার? সুজান ব্লক এবং অ্যান্ড্রু বিলিং কয়েক বছর আগে একই জার্নালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন “মৃত্যু থেকে শিক্ষা” শিরোনামে। (Susan Block nd Andrew Billing, “Learning from Dying,” New England Journal of Medicine 2005, 353(13): 1313-1315) এ প্রবন্ধে তাঁরা হাসপাতালের ওয়ার্ডের একের পর এক উদাহরণ তুলে ধরে দেখিয়েছিলেন যে বাস্তবে শেখানো শিক্ষাক্রমের বাইরে থাকে লুকিয়ে-থাকা তথা “informal or hidden curriculum”।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান সময়ের মেডিক্যাল শিক্ষার এই “hidden curriculum” এবং “especially the disease-centered, impersonal, high-throughput clinical years … still tends to undermine the best intentions of students and faculty members and the best interests of patients and families.”
আরও সাম্প্রতিক সময়ে নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে “How Medical Education is Mising the Bull’s Eye” (জুন ২৫, ২০২০)। এ প্রবন্ধে বলা হয়েছে – “Medical education is missing the bull’s-eye. The current standardized, homogeneous representation of white males in medical education is exclusionary and puts patients of color and women at risk for adverse health outcomes.” মেধাবী, আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন চোখে নিয়ে যে ছাত্র সমাজ মেডিক্যাল শিক্ষার জগতে প্রবেশ করে তারা ক্রমাগত এই অ-মানবিক শিক্ষাক্রম আর বাজারী হিংস্র অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার বুদ্বুদের বাজারের মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘ যাত্রা করে একজন পরিশীলিত ব্যবসায়িক চিকিৎসা-পরিষেবা বিক্রেতা হয়ে ওঠে। এ ট্র্যাজেডি কার? ছাত্রদের? সমাজের? চিকিৎসকের? রাষ্ট্রের? নাকি সম্মিলিতভাবে সবার?
এখানে আধুনিক মেডিসিনের জ্ঞানতত্ত্ব (epistemology) এবং ontology-র সাথে মেডিসিনের ছাত্র-ছাত্রীদের এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক জেরোম গ্রুপম্যান তাঁর পরিণত জীবনের উপলব্ধির কথা জানাচ্ছেন (যার কোন ভালো বাংলা করা যায় না) – I still find myself unable, except in retrospect, to retrieve the language of my youth and speak about “a great case.” It is as if medicine at this stage of my life has split into two streams — a current of marvelous biology and an undertow that pulls at the soul. From the bank where I stand, it is hard to imagine that these two streams can ever again flow as one. (“A Great Case”, New England Journal of Medicine, November 11, 2004 (351): 2043-2045)
আরেক বিখ্যাত লেখিকা জানান মৃত্যু ও বার্ধক্য-কে যদি নার্সিং হোম বা হাসপাতালে নির্বাসিত করতে হয় তাহলে – ways must be found to de-medicalize the final weeks or days, to nurture the dying and those who love them, an by this means to nurture ourselves. The real truth of healing lies in the nurture. (Sherwin B. Nuland, How We Die, New York, Vintage Bokks, 1993)
এ পথে আলো জ্বেলে
অথচ পাবলিক হেলথ-এর জগতে ডেভিড ওয়ার্নার বা এদেশের বিনায়ক সেন বা আরো অনেক ব্যক্তি বা সংগঠিত চিকিৎসকদের মতো নিবেদিত প্রাণ চিকিৎসকেরা আছেন। এদের কাছে জনস্বাস্থ্য একটি অস্তিত্ত্বগত দার্শনিক অবস্থান। হু-র ২০০৫-এর “Make every mother and child count” রিপোর্টের মতাদর্শ ও তার পরিব্যাপ্ত রূপ বহুলাংশে মনে প্রাণে গ্রহণ করেন এঁরা।
আমাদের নির্ভুলভাবে বোঝা প্রয়োজন, জনস্বাস্থ্যের দর্শন একটি মূলগতভাবে ভিন্ন অবস্থান। এটা কোন মেডিক্যাল শিক্ষার বুদবুদের বাজার নয় বা এখানে কোন লুকনো শিক্ষাক্রম নেই। এখানে সবকিছুই অবারিত খোলা এবং পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ। নিজের নিজের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, দৈনন্দিন জীবন-চর্যা এবং সর্বোপরি পড়শি-চেতনা ধরে আছে ভারতের মতো আরো বহু দেশের অসমসত্ত্ব বিপুল জনসমষ্টিকে। এই বিশেষ অবস্থান বুঝতে না পারলে মেডিক্যাল কলেজের প্রশিক্ষণ শেষ করা মাত্র জনস্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী চিকিৎসক হয়ে ওঠা যায় না। মুক্ত বাজারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্শন, বিশেষ করে এর উপজাত social psyche, এ দুয়ের প্রভেদ মুছে দিতে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু খোদ আমেরিকার বুকেই চিকিৎসকদের একাংশও ভিন্নতর উপলব্ধিতে পৌঁছন – We find it terribly and tragically inhumane that Mr. Davis and tens of thousands of other citizens of this wealthy country will die this year for lack of insurance. (“Dead Man Walking”, New England Journal of Medicine 369 (2013): 1880-81)
জনস্বাস্থ্যের দর্শন একটি ভিন্ন অবস্থান। এটা কোন মেডিক্যাল শিক্ষার বুদবুদের বাজার নয় বা এখানে কোন লুকনো শিক্ষাক্রম নেই। এখানে সবকিছুই অবারিত খোলা এবং পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ। নিজের নিজের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, দৈনন্দিন জীবন-চর্যা এবং সর্বোপরি পড়শি-চেতনা ধরে আছে ভারতের মতো আরো বহু দেশের অসমসত্ত্ব বিপুল জনসমস্টিকে। এই বিশেষ অবস্থান বুঝতে না পারলে মেডিক্যাল কলেজের প্রশিক্ষণ শেষ করা মাত্র জনস্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী চিকিৎসক হয়ে ওঠা যায় না। মুক্ত বাজারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্শন, বিশেষ করে এর উপজাত social psyche, এ দুয়ের প্রভেদ মুছে দিতে বদ্ধ পরিকর।
ঠিক এ ঘটনাটিই আজ ঘটছে। আমরা এর অনিবার্য শিকার হয়ে পড়ছি অধিকাংশ সময়ে। এর মুখোমুখি জ্ঞানতাত্ত্বিক সংগ্রাম আমরা গড়ে তুলতে পারবো কিনা বা কতোটুকু সাফল্য অর্জন করবো তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু আশু কাজ হল সমস্যাটিকে নিবিড়ভাবে বোঝা।
দানবীয় বহুজাতিক কোম্পানী এবং হিংস্রতম, আগ্রাসী কর্পোরেট পুঁজির কাছে মানুষ শব্দটির ততক্ষণই মূল্য আছে যতক্ষণ সে মুনাফা দিতে পারে। এজন্য ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা, দেহ ও মন থেকে অসুস্থতাকে বিযুক্ত করে দেখে কেবলমাত্র অসুখের জন্য সমস্ত ওষুধ ও প্রযুক্তি তৈরি হয়ে চলছে সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য, মেডিক্যাল শিক্ষাক্রমও বিপুল্ভাবে প্রভাবিত হয়। ৩০ লক্ষ ইয়েমেনী কিংবা ইয়েমেনের একটি প্রজন্ম নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এ দানবদের কাছে কোন বিবেচ্য বিষয়ই নয়।
এরপরেও বলার থাকে। আমেরিকায় গ্রামীণ চিকিৎসকের ঘাটতি নিয়ে হাহাকার উঠেছে। ২০১৯-এর জুলাই মাসে NEJM-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে “Implications of an Aging Rural Physician Workforce” বলা হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে (আমেরিকার) “Limited access to physicians can reduce access to preventive care and exacerbate unmet health needs, leading to costly hospitalizations and poor health status.” বলা হচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ৬৬% ঘাটতি রয়েছে চিকিৎসকের। বলা হচ্ছে – “In 2030, residents of rural areas will have access to one third as many physicians per capita as their suburban and urban counterparts will.”
ঠিক একই কথা প্রযোজ্য ভারতের ক্ষেত্রেও। ২০১৫ সালের একটি প্রবন্ধে রমন কুমার দেখিয়েছিলেন – “বর্তমানে ৩৮০-র বেশি মেডিক্যাল কলেজ-সম্পন্ন (পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক) ভারতে বছরে ৫০,০০০-এর বেশি এমবিবিএস ডাক্তার তৈরি হচ্ছে। যে দেশে আমরা হেলথকেয়ার প্রফেশনালদের ঘাটতি নিয়ে কথা বলে চলি সেখানে নতুন করে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয় উপযুক্ত কাজ পাচ্ছেনা কিংবা কর্মহীন। ২০৩০ নাগাদ ভারতবর্ষে আরও ১০,০০,০০০ ডাক্তার যুক্ত হবে। বর্তমানে বছরে ৫০,০০০ করে ডাক্টার তৈরি হচ্ছে যারা dysfunctional হয়ে থাকবে এবং ১৩০ কোটির দেশে কোন কাজ পাবেনা।” (“The leadership crisis of medical profession in India: ongoing impact on the health system”, Journal of Family Medicine and Primary Care, Apr-Jun 2015; 4(2):159-61)
আমেরিকান মডেলে অসাম্য এবং নিরুপয়তার কথা বারে বারে ধরা পড়ছে। অর্থনীতির জোরে ওরা এখনো অব্দি খানিকটা সামাল দিতে পারছে। ভারতবর্ষ নির্ভুল্ভাবে সেদিকেই যাত্রা করছি। জনতার স্বাস্থ্যের এবং, বিশেষ করে, সজীব প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য সর্বস্তরের মানুষকে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সাধ্যমতো আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে হবে, জোরালো দাবী তুলতে হবে। তা নইলে অর্থনীতির মতোই আমাদের স্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎও অসুরক্ষিত, অনিশ্চিত।
এখানে সম্প্রতি প্রয়াত জনস্বাস্থ্যের দুনিয়ার এক আপোষহীন জেহাদি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পল ফার্মারের প্রসঙ্গ আসবে – যিনি পৃথিবীর দরিদ্রতম এবং সুদূরতম মানুষটির কাছেও বিশ্বমানের চিকিৎসা পৌঁছে দেবার জন্য নিশ্চিত করার জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন।
২০০৪ সালে ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত হয় তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ “গ্লোবাল হেলথ ইকুয়িটি” (মে ২৯, ২০০৪)। এ প্রবন্ধে তিনি বলেন – প্রতিটি দশকে মেডিক্যাল এডুকেশনের দুনিয়ায় বড়োসড়ো অদলবদল হয়। কিন্তু যে বিষয়টিতে মেডিক্যাল শিক্ষকেরা অপরিচিত কিংবা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তাহল “health as a human right and the growing disparities of outcome between well-to-do and poor patients.” এপ্রসঙ্গে তিনি মেধার পরিযানের (ব্রেন ড্রেইন) বিষয়টি পাঠকদের নিজরে আনেন – “brain drain draws culturally and linguistically competent clinicians away from their home countries.” তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেন যে ১৯৯০-এর দশকে সমগ্র হাইতিতে যতসংখ্যক সাইকিয়াট্রিস্ট ছিল তার চেয়ে বেশি হাইতি-জাত সাইকিয়াট্রিস্ট ছিল কানাডার মন্ট্রিয়লে।
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেমস গলব্রেথ তাঁর “A Perfect Crime: Inequality in the Age of Globalization” (Daedalus , Winter, 2002, Vol. 131, No. 1, pp. 11-25) প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, কিভাবে ১৯৮০-র দশকের পর থেকে নিওলিবারাল অর্থনীতি পৃথিবীতে বিপুল পরিমাণে অর্থনৈতিক অসাম্য এবং অসহায়তা বাড়িয়ে তুলেছে। সে প্রবন্ধে গলব্রেথ জানিয়েছিলেন – “It has been, it would appear, a perfect crime. And while statistical forensics can play a small role in pointing this out, no mechanism to reverse the policy exists, still less any that might repair the damage.”
সম্ভবত গলব্রেথের ধারণার অভিঘাত পড়েছিল তাঁর ওপরে। পূর্বোক্ত লেখায় তিনি বলেন – “মেডিসিন প্রচুর এভিডেন্স তৈরি করছে। কিন্তু ইক্যুইটির কোন পরিকল্পনা এর মাঝে নেইঃ “we lack a rights-based approach to its distribution. Medicine and public health goods are still parochial, limited to a few beneficiaries.” বলেন – “যদি স্বাস্থ্যকে কখনও মানবাধিকার হিসেবে নির্মাণ করা হয় তাহলে এই অসাম্যগুলোকে মেডিক্যাল+ এডুকেশনের ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখতে হবে।” খোলাখুলি বললেন – “Too much conventional international health education shrinks from acknowledging the social roots of grotesque inequalities … too many of us are slow to incorporate rights into our health and teaching practices.” সবশেষে বললেন বিশ্বের নীচের তলার ১০০ কোটি মানুষ “continue to die from readily preventable or treatable disease”। এর উত্তর আমাদের মেডিক্যাল শিক্ষক্রম দেবে কি?
মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষাদান নিয়ে এরকম তীক্ষ্ণ প্রশ্ন কতজন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এভাবে করেছেন? সম্ভবত একজনও নন। তিনি নিজে PIH (পার্টনার্স ইন হেলথ)-এর কর্মীদের নিয়ে ২০১০ এবং ২০২১ সালে হাইতিতে তীব্র ভূমিকম্পের পরে ঠেলাগাড়িকে ব্যবহার করেছেন স্ট্রেচার হিসেবে, কার্ডবোর্ডকে ব্যবহার করেছেন স্প্লিন্ট হিসেবে। কিন্তু চিকিৎসা থেমে থাকেনি।
পল ফার্মারের মতো প্রায় একইরকম প্রশ্ন করা হয়েছিল মান্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত (সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৮) “Murmur of Politics and Economics” প্রবন্ধে। প্রবন্ধের লেখিক নিকোলা লিলিচ তাঁর সাব-সাহারান স্বাস্থ্যব্যবস্থার অভিজ্ঞতায় দেখেছেন – ২০,০০,০০০ মানুষের জন্য রয়েছে একটিমাত্র হাসপাতাল। একটি ১২ বছরের ছেলে তার বাবার ৪ ঘন্টা ধরে পায়ে হেঁটে এসে জানতে পারল যে হার্টের সমস্যা (রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ) রয়েছে এবং এর কোন চিকিৎসা সে ঐ হাসপাতালে। অসহায় এবং ক্ষুব্ধ লেখক সুতীক্ষ্ণ প্রশ্ন তোলেন – “আমাদের মেডিক্যাল স্কুলগুলোতে আমাদের শেখানো হয় মানুষ কিভাবে অসুস্থ হয় এবং সে অসুস্থতা কিভাবে সারিয়ে তোলা যায়। শেখানো হোয় একেবারে প্রাথমিক স্তরের এপিডেমিওলজির কিছু পাঠ, যেমন ধূমপান, মদ্যপান এবং অরক্ষিত যৌন সংসর্গ (unproteceted sex) কিভাবে এড়ানো যায়। আমাদের বায়োলজি শেখানো হয়। কিন্তু কখনওই শেখানো হয়না কিভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা এর কাজকর্ম চালায়। কিংবা কখনওই শেখানো হয়না নব্য-উদারবাদী অর্থনীতি সাব-সাহারার দেশগুলোতে কেন কিছুই করেনি – এখানকার মানুষদের জীবনের মান এবং স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য। কিংবা কখনওই শেখানো হয়না যে লাগাতার হিংস্র যুদ্ধ স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কি পরিমাণে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফলাফল আনে – বিশেষ করে নারী এবং শিশুদের ক্ষেত্রে কিভাবে ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যায়।”
লেখকের সিদ্ধান্ত – যদি এসমস্ত বিষয়গুলো মেডিক্যাল শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাহলে ছাত্রছাত্রীরা সম্যকভাবে বুঝতে শিখবে “the complexities of health care, not only within the biologic context but also in light of underlying political and economic principles.” ফলে “understanding the methods of governance and funding of the World Bank, the International Monetary Fund, and the World Health Organization would cast light on the reasons why so many low-income countries rely on unilateral aid” – এ বিষয়গুলো ভবিষ্যৎ চিকিৎসকদের চৈতন্যে আসবে।
প্রায় ২ বছর ধরে চলা কোভিড অতিমারির পরেও আন্তর্জাতিক জগতে দানবীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মুনাফায় ঘাটতি পড়েনি। আমি কয়েকটি কোম্পানির হিসেব দিচ্ছি –
Johnson & Johnson 2020 revenue: $82.6 billion 2019 revenue: $82.1 billion,
Novartis 2020 revenue: $48.66 billion 2019 revenue: $47.45 billion,
Merck 2020 revenue: $48.00 billion 2019 revenue: $46.84 billion,
AbbVie 2020 revenue: $45.80 billion 2019 revenue: $33.27 billion,
GlaxoSmithKline 2020 revenue: £34.10 billion ($43.77 billion) 2019 revenue: £33.75 billion ($43.32 billion),
Bristol Myers Squibb 2019 revenue: $26.15 billion 2020 revenue: $42.52 billion,
AstraZeneca 2020 revenue: $26.62 billion 2019 revenue: $24.38 billion,
Amgen 2020 revenue: $25.42 billion 2019 revenue: $23.36 billion,
Eli Lilly 2020 revenue: $24.54 billion 2019 revenue: $22.32 billion
দেখা যাচ্ছে প্রায় সবকটি অতিবৃহৎ বহুজাতিকের মুনাফা ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি বা বেশি। এদের ভারতীয় শাখাগুলোও এ সুবিধে ভোগ করার অবারিত দ্বার পাচ্ছে। কারণ ভারতের অর্থনীতি পূর্ণত মুক্ত বাজারের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। মুক্ত বাজারের হাটে কেনাবেচা চলছে। গুণাগার দেবে আমজনতা, যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই সময়কালে। এবং সবক্ষেত্রে বাজারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই চলেছে। যদিও মানসিক জগতে একে সইয়ে নেবার এক বিপজ্জনক ঐতিহাসিক অবস্থা জন্ম নিয়েছে। একধরনের সামগ্রিক সামাজিক চৈতন্যের বিবশতা (numbing of our collective consciousness) সর্বব্যাপী চেহারা নিয়েছে। আমাদের সামাজিক মানসিকতাকে (social psyche) গড়েপিটে নিচ্ছে। আমরা ক্রমবর্ধমান পথে রাষ্ট্রানুগত্যকে আমাদের আইডেনটিটির মধ্যে প্রবেশ করতে অনুঘটক হিসেবে নিজেরাই ভূমিকা পালন করছি। কোভিড পরবর্তী সময়ে এটা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
করোনা অতিমারি-অতিক্রান্ত সময় সম্ভবত আমাদের দেশের এবং বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার গোড়া ধরে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতে চলছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ধারণা সম্ভবত একটি emblem বা স্মারক ছাড়া আর কিছু থাকবেনা। এ মারাত্মক সময়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা মানুষের দৃষ্টিপথ (visibility), শ্রুতি (discernibility) এবং ভাবনার ক্ষেত্রপথের একেবারে বাইরে চলে যাচ্ছে। অতি উচ্চ মুল্যের আইসিইউ পরিষেবা, উচ্চচাপের অক্সিজেনের ব্যবস্থা, ECMO ইত্যাদি জন মানসিকতায় ক্রমশ গ্রাহ্য হয়ে উঠছে, মান্যতা পাচ্ছে। সমগ্র বিষয়টি নিতান্ত হাই-টেক এবং কর্পোরেট পুঁজি নির্ভর হতে যাচ্ছে। আক্রান্ত, নিরুপায় এবং বিভ্রান্ত মানুষের কাছে দামী হাসপাতালের কয়েক লক্ষ টাকার বিল এবং একইসাথে ভেন্টিলেটর ECMO ICU এগুলো খুব গ্রহণযোগ্য শব্দ হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার, ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও নামী হাসপাতাল এবং দামী টেকনোলজি ভালো চিকিৎসার সমার্থক হয়ে উঠছে। এবং লক্ষ্যণীয় হল কর্পোরেট পুঁজি শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র এটাই চায়। অতিরাষ্ট্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের নতুন চাহিদা এবং স্মৃতি প্রতিনিয়ত নির্মাণ করে চলে – সে রামমন্দির নিয়েই হোক বা হাই-টেক পাঁচতারা কর্পোরেট চিকিৎসাই হোক।
জার্নাল অফ আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এ (৩ মার্চ, ২০২০) একটি পেপার প্রকাশিত হয়েছিল “Profitability of Large Pharmaceutical Companies Compared With Other Large Public Companies”। এ পেপারে বিভিন্ন পরিসংখ্যানগত তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত হিসেবে জানানো হয়েছিল – “২০০০ থেকে ২০১৮-র মধ্যে ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানিগুলোর লাভ অন্যান্য বৃহৎ, পাবলিক কোম্পানির চেয়ে লক্ষ্যণীয়ভাবে বেশি ছিল”। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত GoodRx Health ম্যাগাজিনে আমেরিকার কথা বলা হয়েছে (জানুয়ারি ৬, ২০২২) – “Every year, manufacturers tend to raise the prices of their medications in January and July. Last January, 832 drugs increased in price by an average of 4.6%.”
১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে রোনাল্ড রেগানের নির্বাচন বোধ করি “big pharma”-দের উত্থানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এসময়ে কেবলমাত্র রাষ্ট্রনীতিতে নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রবলভাবে pro-business shift হল। ১৯৮০-তেই রচিত হল বি/কু-খ্যাত Bayh-Dole Act (Pub. L. 96-517, December 12, 1980)। ইন্ডিয়ানার ডেমোক্র্যাট সেনেটর বার্চ বে এবং কানসাসের রিপাব্লিকান সেনেটর রবার্ট ডোলের যৌথ উদ্যোগে জন্ম নিল এ আইন। পুঁজির অবাধ বিচরণের জন্য যা ডেমোক্র্যাট তাই রিপাবলিকান – আমে দুধে মিশে যায় অভ্রান্তভাবে। টেকনোলজি ট্রান্সফারের নামে – “Bayh-Dole enabled universities and small businesses to patent discoveries emanating from research sponsored by the National Institutes of Health (NIH), the major distributor of tax dollars for medical research, and then to grant exclusive licenses to drug companies.” (Marcia Angell, The Truth about the Drug Companies: How They Deceive Us and What to Do about It, 2004, p. 7)
PLoS-এ ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত সম্পাদকীয় “নিউক্লিয়ার ওয়েপনস অ্যান্ড নেগলেক্টেড ডিজিজেসঃ দ্য টেন থাউস্যান্ড-টু-ওয়ান গ্যাপ”-এ বলা হয়েছিল – “১১টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের পারমাণবিক অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা খরচ হয় তার ১/১০,০০০ ভাগেরও কম খরচে অবহেলিত রোগগুলোকে নির্মূল করা ও বিশ্বের উত্তেজনা কমিয়ে শান্তি রক্ষা করা সম্ভব।”
আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে, ১৯৭৮ সালে অতিবৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি Merck-এর তদানীন্তন প্রধান কর্মকর্তা Henry Gadsden বিখ্যাত Fortune পত্রিকার প্রতিনিধি W. Robertson-কে জানিয়েছিলেন (Fortune, March, 1976) – “I want us to be like Wrigley’s and sell to everyone.”
তুলনাটি বড়ো কৌতুকপ্রদ। Wrigley কোম্পানি, আমাদের অনেকেরই জানা, আমেরিকার একটি বিখ্যাত বাবল গাম প্রস্তুতকারক কোম্পানি। Gadsden-এর আক্ষেপ হল যে বাবল গাম-এর মতো ওষুধকেও সবার কাছে বিক্রী করতে পারলেন না! অতঃ কিম্? এরপরে শুরু হল সুকৌশলী এবং প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে রোগ বা অসুখ বিক্রী করার নিরন্তর, ধারাবাহিক ও হিংস্র একটি উপাখ্যান লেখার ইতিহাস। সে ইতিহাসের সানুপুঙ্খ বিবরণ ধরা আছে Ray Moynihan এবং Alan Cassels-এর লেখা Selling Sickness: How Drug Companies Are Turning Us All Into Patients (Allen Unwin, 2008) পুস্তকে। আগ্রহী পাঠকেরা নিশ্চয়ই বইটি দেখবেন।
অধুনা একটি অতি জনপ্রিয় চালু বিষয় হল “whole body check-up”। যে বিশাল সংখ্যক রোগী প্রধানত দক্ষিণ ভারতে পাড়ি জমান চিকিৎসার জন্য তাদের জন্য অ্যাপোলো হাসপাতাল বোধহয় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক এরকম একটি প্যাকেজ চালু করে। রোগীদের চিন্তায়, মননে এবং বোধে ধীরে ধীরে সংক্রামিত হতে থাকে একবার whole body check-up করে ফেলতে পারলে রোগ নিয়ে আর দুর্ভাবনার বিশেষ কিছু থাকে না। একটু নজর করলে বুঝবো মানুষের স্বাভাবিক সুস্থতার মাঝে একটি “পরিহার্য বিপন্নতা” বোধের জন্ম হচ্ছে, মানুষ নির্ভর করতে শুরু করছে আরো বেশী বেশী পরিমানে মেডিসিনের জগতের ওপরে, যাকে আমরা বলছি medicalization of life। এ প্রসঙ্গে British Medical Journal-এ (9 June 2014) প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয় এবং আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা পত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে। সম্পাদকীয়-র শিরোনাম – “General health checks don’t work: It’s time to let them go”। এতে বলা হয়েছিল – “People who accept an invitation to a health check tend to have higher socioeconomic status, lower cardiovascular risks, less cardiovascular morbidity, and lower mortality than others.” অর্থাৎ সচরাচর যারা এ ধরণের চেক-আপ করাতে যান তারা অর্থনৈ্তিকভাবে সুস্থিত অবস্থায় থাকার ফলে বিশেষ কিছু শারীরিক সমস্যার সম্ভাবনা সাধারণভাবে কম। Danish Inter99 Trial-এর একটি বড়ো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালের এক-ই সংখ্যায়। ১৯৯৯-২০০৪ পর্যন্ত ৩০-৬০ বছর বয়সী ৫৯,৬১৬ জন মানুষের ওপরে এ সমীক্ষা করা হয়েছিলো। সমীক্ষার সিদ্ধান্ত – “A community based, individually tailored intervention programme with screening for risk of ischaemic heart disease and repeated lifestyle intervention over five years had no effect on ischaemic heart disease, stroke, or mortality at the population level after 10 years.”
আজ থেকে ২১ বছর আগে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ২৪শে জুন, ২০০১ সংখ্যায় মার্গারেট ট্যালবট একটি প্রবন্ধ লেখেন – “The Shyness Syndrome”। এ প্রবন্ধে তিনি দেখান ডেভিড বেকহ্যাম, স্পাইস গার্ল বা রিকি উইলিয়ামস-এর মতো সেলিব্রিটিরা ওষুধ কোম্পানির টাকায় মিডিয়ার সামনে কেমন করে নতুন ধরণের social phobia-র শিকার হচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন। একটি নতুন anti-depressant ওষুধ তৈরি হচ্ছে social phobia-র জন্য।
যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য মানুষের ভিন্নতার জন্ম দেয়, সেরকম একটি বৈশিষ্ট্য স্বল্পবাক বা লাজুক চরিত্র যদি medicalized হয়ে যায় তাহলে মানুষের এসমস্ত স্বাভাবিক ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যও ওষুধের এবং চিকিৎসার আওতার মধ্যে চলে আসবে। এদের জন্য নতুন ওষুধ তৈরি হবে। এমনকি কখনো কখনো আগে ওষুধ তৈরি হয়, পরে লাগসই রোগের নামকরণ হয়। এরকম একটি ওষুধের উদাহরণ হচ্ছে praxil (paroxetin)। গার্ডিয়ান পত্রিকায় (৩০ জুলাই, ২০০২) প্রকাশিত এই রিপোর্টিংয়ে (“First, you market the disease… then you push the pills to treat it”) বলা হয়েছিল – “The modus operandi of GlaxoSmithKline – marketing a disease rather than selling a drug – is typical of the post-Prozac era … The strategy has enabled the pharmaceutical industry to squeeze millions in additional revenue from the blockbuster drugs known as selective serotonin reuptake inhibitors (SSRIs), a family of pharmaceuticals that includes Paxil, Prozac, Zoloft, Celexa, and Luvox. Originally approved solely as antidepressants, the SSRIs are now prescribed for a wide array of previously obscure afflictions – Gad, social anxiety disorder, premenstrual dysphoric disorder, and so on.”
পরিণতিতে, কয়েক মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হবে। ক্রিস্টোফার লেন মন্তব্য করছেন – Treat someone for shyness, and the insurance companies will laugh at you. Treat someone with social phobia, with its DSM seal of approval as disorder 300-23, and the bill will be paid. (Christopher Lane, Shyness: How Normal Behavior Became a Sickness, Yale University Press, 2008)
ট্যালবট আশঙ্কা বোধ করেন এমন কোন দিন হয়তো আসবে যখন পৃথিবীতে মৃদুভাষী, স্বল্পবাক বা স্বভাব ভীরু বলে কিছু থাকবে না – “Maybe in another generation or so, we’ll find ourselves sorely missing the meek and the mild, the stoic and the taciturn among us. Is somebody out there inventing the drug to treat excessive perkiness?” এ আশঙ্কার বাস্তব ভিত্তিতে আছে অর্থনৈতিক মুনাফা। আমেরিকাতে ওষুধ কোম্পনিগুলো বছরে (এ হিসেব ২০০৪ সালের এবং এখন বহুল পরিমাণে বেড়েছে) ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করে “on promoting their products.” (Lancet, “Dealing in drugs”, November 6, 2004, pp. 1655-56) অন্য আরেকটি প্রসঙ্গে গবেষকেরা দেখিয়েছেন, কিভাবে মহিলাদের কিছু স্বাভাবিক স্বভাবকে একটি বিশেষ রোগের নামে নামাঙ্কিত করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করা হয়। (Ray Moynihan and Barbara Mintzes, Sex, Lies, and Pharmaceuticals: How Drug Companies Plan to Profit from Female Sexual Dysfunction, Allen & Unwin, 2010).
এরকম একটি চিন্তা, মত ও ভাবনা উৎপাদনের সামাজিক পরিবেশ, ডিজিটাল দুনিয়া, সংবাদমাধ্যম এবং পারস্পরিক আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে আমাদের সময় অতিবাহিত হচ্ছে। ফলে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিও আমাদের কতটা নাড়া দেবে সেটা চিন্তাসাপেক্ষ।
এখানে কোথাও একটা আমাদের অবস্থান গ্রহণ করা নিতান্ত আবশ্যক, গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্যকে সুখ কেনার প্রধান উপায় হিসেবে ব্যবহার করার প্রক্রিয়াটিকে আমাদের এবার থামানো দরকার – বিশেষ করে আমরা যারা চিকিৎসক। সমগ্র পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তকে সমসত্ব medical consumer করে তোলার মুখোমুখি হয়ে অসমসত্ব অঞ্চল (heterogeneous space) গড়ে তোলার লড়াই তো চালিয়ে যেতেই হবে।
জয়ন্তদাদা
জানি না কোন অলৌকিক কারণে আমার লেখার ক্ষমতা অন্তর্হিত হয়েছে।
তবু বলি, মোট ষাঠ জনের বেশী এই দীর্ঘ প্রবন্ধ পড়বে না।জাস্ট ভেবে নেবে, আমি তো ভালো আছি,এসব জানার দরকার নেই।আমার মেডিক্লেইম আছে, আছে স্বাস্থ্য সাথী, সঙ্গে আসছে আয়ুষ্মান ভারত, আমি কেয়ার করি না।
আপনি লিখতে পারেন।
ইয়েমেনের ভৌগোলিক অবস্থান(কেউ জানে না এটা জাপানের কাছে না তাইওয়ানের কাছে), ঐতিহাসিক কারণ এবং শিশুমৃত্যুর ছবি দিয়ে লিখুন।পোলিও টীকা ও তার অভাবে কি হচ্ছে ইয়েমেনে, লিখুন।
নাইজেরিয়ার অপুষ্টি নিয়ে লিখুন।সাব সাহারার মৃত্যু নিয়ে লিখুন।পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ নিয়ে লিখুন।
তবে এরকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে নয়, এক একটা দেশ ধরুন আর খতম করুন(শেষের দিকে দেখবেন, ভারত থেকে নাইজেরিয়া,সবার একই অবস্থা)
আমাদের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হতে কতটা দেরি, সেটা নিয়ে লিখুন।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নিয়ে কেউ(এমনকি ডাক্তাররাও উৎসাহী নয়) জানতে চায় না।পরমাণু পরিবারে আমার টাকাই আমার স্বাস্থ্য, এটাই সবার বিশ্বাস।
যদি অতিরিক্ত বলে থাকি, মার্জনা করবেন।
ভালো থাকুন।
প্রণতঃ
দীপঙ্কর।
দীর্ঘ প্রবন্ধ (প্রায় বইয়ের আকারে), কযেকটি বিষয় অনুল্লিখিত থেকে গেছে। লেখাটার দুর্বলতা বিলেত আমেরিকা ভারতের health system এর বাইরে একটা বিশ্ব আছে, সেগুলোের আলোচনা এখানে ঠিকমত ধরা পড়েনি। দু-তিনটে পয়েন্ট লিখছি |
প্রথমত, ব্যক্তিস্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্য কখনোই এক বিষয় নয়, চিকিতসকদের পড়ানোর সময় জনস্বাস্থ্য পড়ানো হয়না, পড়ানো হয় preventive medicine, সম্পরকিত, কিনতু এক বিষয় নয়। জনস্বাস্থ্যের সিলেবাস অন্য রকমের সিলেবাস, তাকে চিকিৎসা শাস্ত্রের সিলেবাসে না রেখে আলাদা করে বিশেষজ্ঞ “তৈরী” করা যেতে পারে। সেখানে ডাকতাররা আসতে পারেন, বিলেত আমেরিকা ভারতের বাইরে অনেক দেশেই public health medicine আলাদা একটি speciality হিসেবে বিবেচিত হয় | এখন সেই বিষয়টির বিস্তারে সমাজ এবং তার নিয়ন্ত্রক সরকারের এবং বাজারের একটা ভূমিকা রয়েছে, যেটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যের অধিকার বলে কিছু হয় না, যেটা হয়, সেটা মূলত মানুষের স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবার/নাগাল পাবার/অর্জনের অধিকার। চিকিৎসাকে নিজের নাগালে নিয়ে আসার অধিকার, এবং এই জায়গাটিতে সমাজ এবং সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সরকার যদি মনে করেন যে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল তৈরী করে মূলত বেসরকারী হাতে চিকিৎসার দায়িত্ব তুলে দিয়ে দায়মুক্ত হবেন এবং মুনাফা লুটবেন (যেটি ভারতে হচ্ছে), এতে করে মুশকিল হচ্ছে যে অসুখগুলো (হাঁপানি, রক্তচাপ, মধুমেহ ) কম খরচে outdoor এ চিকিৎসা করে নিয়ন্ত্রণ করা যেত, সেইগুলো অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় মানুষকে বাধ্য করবে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করাতে, যার জন্য ঝাঁ চকচকে টেকনোলজি নির্ভর হাসপাতালের রমরমা বাড়ছ। আবার এই একই অসুখগুলো দেখবেন অন্যান্য বাজারী অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট (soft drinks, খেলাধুলো করার জায়গার অভাব, পরিবেশ দূষণ, processed food marketing) | এখন যেখানে সেই ধরণের অসুখে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করার ব্যাপারটা প্রবল (যেমন ভারতে), সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার অধিকার বা চূড়ান্ত অসাম্য বিরাজমান। এখন এর বিধান কে করবে? সরকার? সমাজ? সমাজ সরকারকে বাধ্য করবে? সরকার যদি ambulatory care sensitive hospitalisation কে নিয়মিত audit ইত্যাদি করে নিয়ন্ত্রণ করতেন, তাহলে দেখতেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল হকিকৎ অন্য রকমের হত। এখন কোনটায় বেসরকারী বাণিজ্যের এবং সেই সূত্রে সরকারী আমলাদের পকেট ভর্তির সুযোগ বেশী, সেইটে ভেবে দেখুন।
তৃতীয়ত, স্বাস্থ্য এবং “সুখের” একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, সেটা অস্বীকার করা চলে না। এখন বাণিজ্যিক এবং বিপণন প্রতিষ্ঠান তাকে যেভাবে দেখায়, সেইটা গোলমেলে। একটা সামাজিক সুস্থতা না এলে কেবল medical model অনুসরণ করে খুব একটা লাভ হবে না। না হবে স্বাস্থ্য, না পাবেন সুখ। সেইটে নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
আপনার সান্নিধ্যে অনেক অজানা তথ্য জানছি , অসংখ্য ধনযবাদ স্যর
বেশ কিছু নতুন তথ্য পেলাম। সমৃদ্ধ হলাম। প্রণাম নেবেন।