সুধী,
ডাক্তার পেটানো নিয়ে ঘরোয়া আড্ডায় বা ফেসবুকের আড্ডায় কিছু বলতে গেলেই যেটা শুনে আসছি সেই আলোচনার বেশির ভাগটাই এত অযৌক্তিক যে বেশির ভাগ সময় খুব বিরক্তিকর লাগে। যেমন ধরুন আলোচনার মধ্যেই একদল সমালোচক তেড়ে তেড়ে বলতে শুরু করেন, “এই যে আপনারা অমুক খারাপ কাজ করেন, এই যে আপনাদের অমুক দোষ, আমাদের সাথে এত খারাপ ব্যবহার করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কেমন যেন হতভম্ব হয়ে যাই এই “আমরা/আপনারা” বাইনারী শুনলে।
সাদামাটা ভাবে এটা বুঝি যে আমরা মানে তাবৎ চিকিৎসক কুল আর আপনারা মানে সেই দল যাঁরা চিকিৎসক নন – ডাক্তার বনাম রোগী/রুগীর বাড়ির লোক। আমার মনে প্রশ্ন জাগে এই যে আমি লোকটা ঠিক কোন দলে – ওই “আমরা”দের দলে না কি “আপনাদের” দলে। একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে এই বাইনারীটা কত ফলস, মিথ্যে, ঢপ-এর বাইনারী।
আমার কথাই ধরুন, আমার নিজের ও নিজের কাকা-জেঠা, পিসি-মাসী, মামা ইত্যাদি ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজন মিলে জনা চল্লিশ লোকের পরিবারের মধ্যে আমি একাই ডাক্তার। এই চল্লিশ জনের কেউ অসুস্থ হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের বিদ্যে বুদ্ধিতে কুলোয় না, তাদের চিকিৎসা করার জন্য অন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। শুধু তাই নয়, বহু ক্ষেত্রেই ওই চিকিৎসক আমার অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত। অর্থাৎ অহরহ আমাকে দলবদল করতে হয়, ওই ডাক্তারের দল থেকে হয়ে যাই পেশেন্ট পার্টির দল। শুধু আমি নই, এটা আমার ক্ষেত্রে ইউনিক নয়, সমস্ত ডাক্তার বন্ধুদের ক্ষেত্রেই এই ঘটনা ঘটে।
তাই আমাকে বা আমাদের ওই নির্দিষ্ট একটি দলে দাগিয়ে দিয়ে আলোচনাটা শুরু করলে সেটা শুরু থেকেই অর্থহীন হয়ে পড়ে। সুধী পাঠক/পাঠিকা এটুকু ভরসা আমাদের ওপর রাখতে হবে যে আমাদের ও পেশেন্ট বা পেশেন্ট পার্টি হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আপনাদের মতই এবং সেই অভিজ্ঞতাটা ভালো-মন্দ মিশিয়েই, ঠিক আপনার যেমন। এটুকু পড়ে আপনার যদি ভরসা জন্মায় যে চিকিৎসক-নিগ্রহ এই লেখাটা নেহাৎ ই এক পেশে হবে না, তবেই বাকি লেখাটা পড়ার জন্য অনুরোধ করবো নচেৎ বন্ধ করে অন্য লেখায় চলে যেতে পারেন অনায়াসে।
ডাক্তাররা মার খায় কেন এই প্রশ্নের উত্তরে যে যুক্তিটা সবচেয়ে বেশি খাড়া করা হয় সেটা একই সাথে হাস্যকর রকমের সরল ও বেদনাদায়ক। ডাক্তাররা মার খায় তার কারণ না কি ভাক্তাররা ভুল করে – রোগীর চিকিৎসায় ভুল করে।
প্রথম কথা সত্যি সত্যি ভুল করে মার খাওয়ায় পাশাপাশি অন্তত হাজার খানেক উদাহরণ দেয়া যায় যেখানে ডাক্তার কোনো ভুল না করেও মার খেয়েছেন। একজন ডাক্তার ভুল করেছেন এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন রোগীর বাড়ির লোক যাঁরা ওই বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, অপেশাদার এবং শুধু তাই নয়, তাঁরা ওই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন খুব ভেবে চিন্তে বিচার বিশ্লেষণ করে তাও নয়, নিচ্ছেন তাৎক্ষণিক উত্তেজনার বশে, নিমেষের মধ্যে। এ যদি হাস্যকর না হয় তবে হাস্যকর আর কি হতে পারে।
দ্বিতীয়ত ভুল হলেই মারধোর এই যুক্তিটাও ধোপে টিকছে না। সব পেশার মানুষই কম বেশি ভুল করেন, তাঁরা কি সবাই মার খান ? আসল কারণ সেটা নয়।
ডাক্তারদের কাজের ভুল ধরা প্রসঙ্গে আনপড় অশিক্ষিত পাবলিকের ঘাড়ে দোষ দিয়ে থেমে গেলেই চলবে না। শিক্ষিত পড়ালেখা জানা মানুষজনই বা কি করছেন? সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ আছে যে ভারতীয় দন্ড বিধির 304A ধারা কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার আগে মেডিক্যাল এক্সপার্ট অপিনিয়ন নিতে হবে কারণ চিকিৎসা করতে গিয়ে মেরে ফেলা ডাক্তার আর বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মানুষ চাপা দেওয়া ড্রাইভারের মধ্যে তফাৎ আছে।
এই নির্দেশ সার্কুলারের আকারে সব থানায় পাঠিয়ে দেয়ার পরেও থানার অতি বিজ্ঞ মেজবাবু অনায়াসে ৩০৪A IPC তে ডাক্তারকে বুক করছেন কোনো এক্সপার্ট অপিনিয়ন ছাড়াই। নিজেই নিজেকে মস্ত এক্সপার্ট ভাবছেন আর ডাক্তার ও ড্রাইভারকে একাকার করে ফেলছেন।
অনেকে যুক্তি সাজান যে চিকিৎসা নিতে গিয়ে চূড়ান্ত অব্যবস্থা, হয়রানির শিকার হতে হতে হতাশাগ্রস্ত জনগণ মাঝেমধ্যে অধৈর্য্য হয়ে পরে হাসপাতাল ভাঙচুর করেন আর তার সাথে একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি জাতীয় চৈত্র সেলের কায়দায় ওই ভাঙচুরের পাশাপাশি একটু চিকিৎসক/ চিকিৎসা কর্মীদের পিটিয়ে থাকেন। আরে, পাবলিকতো তার ছেলেমেয়েকে উচ্চ মাধ্যমিকের পর কলেজে ভর্তি করা নিয়েও ফ্রাস্টেটেড, সেই অভিভাবকদের ক’জন ছাত্র ইউনিয়নের নেতার গায়ে হাত দিয়েছে ? থানার ডায়েরি নিয়েও তো হয়রানি হয় পাবলিকের। থানার কতজন বড় বাবু, মেজ বাবুর গায়ে হাত পরে? পাবলিককে আসলে আমরা যতটা নির্বোধ মনে করি, ততটা নির্বোধ নয়, সেয়ানা পাবলিক জানে যে কার কার গায়ে হাত দিয়ে পার পাওয়া যায়, আর কোথায় পার পাওয়া যায় না।
শুধু হতাশার যুক্তি নয়, আরেকটা যুক্তিও প্রায়ই শুনতে পাই, প্রিয়জনের বিয়োগান্তক পরিণতির পরে না কি মাথার ঠিক ছিল না পেশেন্ট পার্টির। তাই সেই হতাশাগ্রস্ত, বেদনাবিধুর পাবলিক নিজের আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে “দোষী” বা “নির্দোষ” ডাক্তারকে ক্যালাবে। ইনস্ট্যান্ট কফির মতো ইনস্ট্যান্ট মব জাসিস্ট। পাবলিক নিজেই ঠিক করবে কোন ডাক্তার দোষী, কে দোষী নয়, তার পরে শাস্তি দেয়ার ভারটাও নিজের হাতে তুলে নেবে, ঠিক করবে কোন ডাক্তারকে মেরে তার মাথার খুলিতে একটু ছোট্ট করে টোল ফেলে দেবে আর কোন ডাক্তারকে ছোট্ট ধাক্কা দিয়ে ডাক্তারের কাঁধের হাড় সরিয়ে দেবে।
সহায় সম্বলহীন অরক্ষিত চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মীদের যারা পেটালো তাদের না হয় মাথার ঠিক ছিল না ধরে নিলাম। কিন্তু ওই ঘটনার সাথে যারা সরাসরি যুক্ত নন, তাঁদের মাথাও কি ঠিক থাকে না ? তাঁরাই তো বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় ওই ক্রিমিনাল কাজের সমালোচনার পরিবর্তে মব জাস্টিসকে বাহবা দেন, নিগ্রহকারীদের পারলে হিরো বানিয়ে দেন। এঁদেরই একটা অংশ এই পোস্টে এসে ঠাণ্ডা মাথায় নানান যুক্তি সাজিয়ে ওই মব জাস্টিসকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করবেন।
চিকিৎসায় গাফিলতি বা অবহেলার অভিযোগ এই মব জাস্টিস সমর্থকদের একটা মস্ত যুক্তি। একে হাতিয়ার করে এঁরা নৈতিক সমর্থন অবধি জোগাড় করে ফেলেন। বহু বিবেচক মানুষকে এই যুক্তির স্রোতে ভেসে যেতে দেখেছি। তাঁদের মনোভাব টা এমন, “যাই বলুন ডাক্তার বাবু, তরতাজা ছেলেটা/ প্রসূতি মাটা মরে গেল, এটা মেনে নেওয়া যায় ?” সত্যিই তো আমার সেই প্রিয় পাঠক পাঠিকাদের মধ্যে এমন মনোভাব তো বিরল নয়। তাই গাফিলতির প্রশ্নটা পাশ কাটিয়ে এই আলোচনাটা সম্পূর্ণ হতে পারে না।
আমরা সকলেই জানি যে “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে” এসব কবিতার বইতে পড়তেই ভালো লাগে, বাস্তব জীবনে প্রিয়জনের বিচ্ছেদ আমরা কেউই মন থেকে মেনে নিতে পারি না সেটা যতই যুক্তিহীন হোক। ইন্ডিভিজুয়াল তো বটেই এমন কি এই যুক্তিহীনতা মব সাইকোলজিরও অংশ। বারংবার একটা বলে যাওয়া দরকার যে ডাক্তার একজন পেশাদার মানুষ, ভগবান নন, ভূতও নন।
মুশকিলটা অন্যখানে। অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উদাহরণটাই নেয়া যাক। বুকের ব্যথা নিয়ে আসা একটি তরুণকে এক তরুণ ডাক্তার নিজের বাড়িতে না দেখে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলায় মারধর খায়। উত্তেজিত মবের সিদ্ধান্ত যে এটা গাফিলতি। ডাক্তারবাবু একটা ইনজেকশন ইত্যাদি দিয়ে দিলে রুগী বেঁচে যেত।
গোলমাল এখানেই যে, জনতার দাবি মেনে বিনা উপকরণে, কোনো টেস্ট ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে ওই ডাক্তার যদি তার বাড়িতেই রুগীকে দেখতো ও ইনজেকশন দিত আর তার পরে রুগী মারা যেত, যার সম্ভাবনা প্রবল, তখন ওই নির্বোধ রক্তপিপাসু মব বলতো যে “ডাক্তার ভুল ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলেছে ওর মুন্ডু চাই।”
না পাশ করা চিকিৎসক বা অন্যান্য সিস্টেমের চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা করিয়ে একিউট পেশেন্টের মূল্যবান সময় নষ্ট করে মরণাপন্ন পেশেন্টকে শেষ মুহূর্তে নিয়ে এসেছে আর শকে চলে যাওয়া সেই রুগীকে লাইফ সেভিং নির্দোষ ডেকাড্রন ইনজেকশন দেয়ার পরে “রোগী ভুল ইনজেক্নে মারা গেল” বলে ডাক্তার নার্স পেটানোর ঘটনা অহরহ ঘটছে। ট্রিটমেন্ট করলেও দোষ, না করলেও দোষ। মিডিয়ার একটা অংশও এই সব ঘটনায় নির্বোধের মতো চমকপ্রদ হেড লাইন তৈরি করে মবের এই জিঘাংসা প্রবৃত্তি উস্কে দিচ্ছে দিনের পর দিন, ভায়োলেন্স এনাবলার, মব জাস্টিস এনেবলার।
মব ও মিডিয়ার এই উন্মত্ত আচরণের বাইরেও কিছু মানুষ আছেন। আমি মনে করি আমার পাঠক পাঠিকাদের মধ্যে অধিকাংশই তাই। তাঁদের এক অংশকেও কিন্তু যুক্তি সাজাতে দেখেছি এই চিকিৎসক নিগ্রহের বিষয়ে। তাঁরা বলতে চান যে হেলথ সিস্টেমের একটা মস্ত ফাঁকের জায়গা হল সুবিচার পাওয়া। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগের সুবিচার পাওয়াটা কঠিন থেকে কঠিনতর। এই জন্যই ওই ইনস্ট্যান্ট মব জাস্টিস। এই যুক্তি সাজানো মানুষজন একটু ভাবলেই বুঝতে পারতেন যে সুবিচার পাওয়ার ন্যায্য আইনি পথের এর অসম্পূর্ণতা, দীর্ঘসূত্রিতা কেবল স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ক্ষেত্রে নয়, এটা আমাদের সিভিল ও ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের অন্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জাস্টিস পেতে দেরি হচ্ছে দেখে রেপ বা মার্ডার ভিকটিমের বাড়ির লোক যদি অভিযুক্তকে নিজেরাই প্রিজন ভ্যান থেকে টেনে নামিয়ে খুন করতে শুরু করে তাহলে সভ্যতা বলে কিছু থাকবে না।
মব ও মিডিয়া ফ্রেঞ্জির সপক্ষে অনেকেই যুক্তি সাজান যে চিকিৎসকদের একাংশ অসদুপায়ে অপরিমিত অর্থ উপার্জন করেন বলে পাবলিকের মনে রাগ জমে থাকে এবং সময়ে সময়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ প্রসঙ্গে দুটি বিষয় থাকে বলার মতো। এটা ঠিকই যে চিকিৎসা দিনে দিনে আরো ব্যয় বহুল হচ্ছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে এর গোটাটাই রোগীর বাড়ির লোকের পকেট থেকে যাচ্ছে বলে তার ক্ষোভ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এটাও ভেবে দেখতে হবে যে ওই ব্যয়ের কতটা অংশ ডাক্তারের সরাসরি আয় আর কতটা বেসরকারি সংস্থার মালিকদের। দ্বিতীয়ত যেটা বলার সেটা হল এই যে, সরকারি ব্যবস্থা যেখানে এই অর্থ ব্যয়ের প্রশ্নটা আদৌ প্রবল নয় সেখানেই কিন্তু তুলনামূলকভাবে বেশি নিগ্রহ, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। তাই এই রাগিত জনতার থিওরিটা খুব একটা শক্তপোক্ত নয়।
রইল পড়ে অসদুপায়ে রোজগার। কিছু চিকিৎসক যে অসৎ পথে বা অনৈতিক ভাবে রোজগার করেন এটা মেনে নিতে কারুর দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়। সব পেশাতেই কিছু ব্ল্যাকশিপ থাকেন। কিন্তু ডাক্তার পেটানোর স্বপক্ষে সেটা কোনো যুক্তি নয়। কারণ উন্মত্ত মবের হাতে আক্রান্ত ডাক্তাররা সবাই ওই ব্ল্যাক শিপ এমন উদ্ভট দাবি কেউ করবে না। আর ওই ভাবে রোজগার করে বলেই নিগ্রহ করা হচ্ছে এমনটা চালু থাকলে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের একাংশ তো বহু আগেই নিগৃহীত হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যেতেন। ভ্রষ্ট মন্ত্রীশান্ত্রীদের ক’জনের ক্ষেত্রে এই মব জাস্টিসের প্রয়োগ দেখেছি আমরা ?
আসলে ডাক্তাররা সফট টার্গেট। নামমাত্র সুরক্ষার বেড়াজালে বা বিনা সুরক্ষায় কাজ করে চলা ডাক্তাররা “ভালনারেবল”। মব জানে যে ডাক্তারদের কেলাতে আসলে নিরাপত্তা রক্ষীদের রুলের বা বন্দুকের বাটের গুঁতো খেতে হবে না। অতএব বন্ধুগণ, নিশ্চিতে মনের সুখে ডাক্তার পেটাও, পিটিয়ে হাতের সুখ করে নাও। শুধু তাই নয়, ওই বেসিক্যালি ভীতু ও সেয়ানা মব এটাও জানে যে পেটানোর পরেও নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার পরেও কিস্যু হবে না, কোনো শাস্তি পেতে হবে না, মামা কাকা ধরে দিব্যি পার পাওয়া যাবে। চাইকি উঠতি দাদা হিসেবে নিজের বায়োডাটা বা সিভি-তে গর্বের সাথে উল্লেখ্য করা যাবে যে ক্রিমিনাল জগতে আমার হাতে খড়ি ডাক্তার পিটিয়ে।
প্রিয় পাঠক পাঠিকা, এত দীর্ঘ ধানাই পানাইয়ের পরে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে মোদ্দা কথা কি। ডাক্তার পেটানোর মূলে হল সেই মনোভাব যে ডাক্তার পিটিয়ে পার পাওয়া যাবে, কোনো ডেটারেন্ট নেই। সভ্য সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল আধুনিক ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের সবল উপস্থিতি। সমাজে অন্যায় ঘটবেই। তার বিচার পেতে কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নেবে না, মব জাস্টিসের কোনো জায়গা নেই, নিজেই অভিযোগকারী, নিজেই উকিল, নিজেই বিচারক আর নিজেই ফাঁসিতে ঝোলানোর এক্সপার্ট সাজা যাবে না। আইন ভঙ্গকারী, সে যেই হোক, পুলিশ প্রশাসন তাকে ধরবে, আইনের পথে সাজা দেবে।
অনেকে বলেন যে হেলথ সিস্টেমের ঘাটতি দুর্বলতার কারণে ডাক্তার পেটানো হয়। এ প্রসঙ্গে দুটো কথা বলার। প্রথমত আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে হেলথ সিস্টেমে কিছু ঘাটতি আছে সেটা মেনে নেওয়া দরকার। কিন্তু প্রশ্ন হল, এর জন্য চিকিৎসক বা চিকিৎসা কর্মীরা কতখানি দায়ী। তাঁরা কেউ নীতি-নির্ধারক নন, তাঁদের দু’একজন বড় জোর উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন এই মাত্র। যাঁরা নীতি-নির্ধারক তাঁরা অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব ঠিক করেন হেলথ সিস্টেম কি ভাবে চলবে, কত টাকা তার বাজেট বরাদ্দ হবে। আমার পাঠক পাঠিকারা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মী ছাড়া, কটা রাজনৈতিক দল কে কবে কোথায় সোচ্চার হতে দেখেছেন স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানোর দাবিতে ? চিকিৎসক বা চিকিৎসা কর্মী ছাড়া, ক’জন রাজনৈতিক কর্মীকে বা অন্য পেশার মানুষজনকে দেখেছেন, ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ স্লোগান নিয়ে রাজপথে মিছিল করতে ?
আর এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় কথা যেটা বলার সেটা হল এই যে, পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট হেলথ সিস্টেমে কিছু ফাঁক থাকে। UK-র NHS যা পৃথিবীর অন্যতম সেরা সিস্টেম তাতেও রুগীকে নানান চিকিৎসার জন্য অনেক অপেক্ষা করতে হয়। সে জন্য ধৈর্য্য হারিয়েও দেশের লোক ডাক্তার পেটায় না। তাই হেলথ সিস্টেমের ঘাটতিটা ই চিকিৎসক নিগ্রহের মূল কারণ নয়। ঘাটতি অন্য খানে। ঘাটতি ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমে, ঘাটতি পুলিশ প্রশাসনের মানসিকতায়, ঘাটতি নীতি নির্ধারকদের মানসিকতায়। তারা তাদের ঘাটতি ঢাকতে চিকিৎসকদের বলির পাঁঠা করছে, স্কেপগোট।
এখন সমস্যা একটাই। পাঁঠার মতো নিরীহ নির্বোধ প্রাণীও যখন টের পায় যে তার বলি হতে চলেছে, সে ম্যা ম্যা ডাক ছেড়ে একটা নিষ্ফল প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে। আমরা ডাক্তাররা পাঁঠার চেয়ে খুব বেশি নিরীহ নির্বোধ নই। তাই আমরাও ডাক ছাড়ছি। এই প্রতিবাদের ডাকে প্রিয় পাঠক পাঠিকা আপনাকেও সামিল হতে হবে। না, এ দাবি কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্কের জোরে জানাচ্ছি না। আপনি আমায় কত’টা ভালোবাসেন বা শ্রদ্ধা করেন সেই জোরের জায়গা থেকে জানাচ্ছি না।
আমার বা আমাদের কথা ভেবে নয়, নিজেদের কথা ভেবে এই প্রতিবাদের মঞ্চে সামিল হন। ইনস্ট্যান্ট মব জাস্টিস একটা নেহাৎই অসভ্য বর্বর প্রথা। কোনো ধরনের কুযুক্তি হাজির করে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ডাক্তার নিগ্রহ সমর্থন করবেন না প্লিজ। ওই অসভ্য বর্বর প্রথাকে নৈতিক সমর্থন দিলে দেখবেন একদিন সে আপনারই কোনো প্রিয়জনকে গ্রাস করে ফেলেছে, বলি দিয়ে দিয়েছে। কোভিড আমাদের অনেক ক্ষতি করে দিয়ে গেছে। সব চেয়ে বড় ক্ষতি করেছে হেলথ সেক্টরে। আমরা বহু নবীন ও প্রবীণ চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মীদের হারিয়েছি চিরকালের মতো। ওই সময়টা অদ্ভুত ভাবে নিগ্রহের ঘটনা গুলো কমে প্রায় শূন্য হয়ে এসেছিল। কোভিড কমার সাথে সাথে ইতিউতি নিগ্রহের ঘটনা বাড়তে শুরু করেছে। এটা সেই প্রাচীন প্রবাদ বাক্যই মনে করিয়ে দিচ্ছে, “কাজের বেলায় কাজি আর কাজ ফুরোলেই পাজি”।
কিন্তু সত্যিই ভেবে বলুন তো ডাক্তারের কাজ কি ফুরিয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে তাদের প্রয়োজনীয়তা ? বিজ্ঞান যতই উন্নতি করে থাকুক, এখনো মানুষই মানুষের চিকিৎসা করছে, রোবট নয়, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নয়। অতএব মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, হেলথ সিস্টেমকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মীদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় বা মিডিয়ার আখ্যানে চিকিৎসকদের গণশত্রু বানিয়ে সস্তায় কিছু বাহবা পাওয়া যাবে সমস্যার সমাধান হবে না। বাংলার ডাক্তাররা কতটা খারাপ আর চেন্নাইয়ের ডাক্তার এরা কতটা ভালো সেই নিয়ে চমকপ্রদ গালগল্প করেও সমাধান হবে না। বাংলার অধিকাংশ মানুষদের চিকিৎসা বাংলাতেই করতে হয়। সমস্যার সমাধান একটাই। সমাধান খুঁজে বের করতে কোনো সমাজতাত্বিক গবেষণার প্রয়োজন নেই। মাস সাইকোলজির প্রথম পাতাতেই লেখা থাকে বিভিন্ন ধরনের ভিড়ের চরিত্র – ক্রাউড, মব, মাস। এই মব কিন্তু বেসিক্যালি ভীতু হয়।
আইন যদি আইনের পথে চলে, নিগ্রহের ঘটনায় অভিযুক্তদের যদি চটপট গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের ফাস্ট ট্র্যাক বিচার করে দোষীদের কঠোরতম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়, তাহলেই ওগুলো ডেটারেন্ট হিসেবে কাজ করবে, নিগ্রহের ঘটনা কমে আসবে। সমাজের সকল স্তরে একটা বার্তা পৌঁছে দেওয়া দরকার। এ কাজ একা সম্ভব নয়,। প্রিয় পাঠক পাঠিকা, এগিয়ে আসুন, সবাই মিলে দলমত নির্বিশেষে বার্তা পৌঁছে দেওয়া যাক যে ডাক্তার পিটিয়ে পার পাওয়া যাবে না। পিরিয়ড।
ভালো থাকবেন, ভালো রাখবেন। এতটা সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
ইতি আপনাদের ডাক্তারবাবু