মাস খানেক আগের কথা। সপ্তাহ খানেকের ভোগান্তি নিয়ে চেম্বারে এসেছিলো বছর সাতেকের অনুপম। হাঁটু,গোড়ালি,কব্জিতে অসহ্য ব্যথা। চোখদুটি লাল। “এই কয়েকদিনে অনেক ওষুধ খেয়েছে ডাক্তারবাবু। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ভয় পেয়ে গ্রামীণ চিকিৎসকে আর ভরসা না করে আপনার কাছে নিয়ে এলাম।” মায়ের উদবিগ্ন মুখে কথাগুলো শুনে বাচ্চাটির ডান হাত খানি যেইই না নিজের হাতে নিয়েছি অমনি এক দমকে বাচ্চার হাত যেন লাফিয়ে উঠলো। সে ধাক্কায় আমার চশমা ধরণী ধারণ করতেই মায়ের বকুনিতে বাচ্চা কুঁকড়ে উঠলো। “ইচ্ছে করে করিনি মা। হাতটা নিজে নিজেই লাফিয়ে উঠলো”।
বাচ্চাটির মুখে কথাগুলো শুনে চমকে উঠলাম আমি। যেন অভীষ্টের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, এই ভাব নিয়ে প্রায় গোলগোল চোখ করে জিজ্ঞেস করলাম- “জ্বর এসেছিলো?”
“হ্যাঁ ডাক্তারবাবু। সপ্তাহখানেকের জ্বর।”
“কয়েকদিন আগে গলা ব্যথা হয়ে জ্বর এসেছিলো?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু। ঠিক বলেছেন। এই তো কয়েকদিন আগেই প্রচুর গলাব্যথা নিয়ে ধুম জ্বর এসেছিলো। গলার ভেতরটা যেন রক্ত জমে গেছিলো। খুব লাল হয়ে গেছিলো। সে যাত্রায় পাড়ার ডাক্তারকে দিয়ে কোনোমতে সেরেছিলো বইকি।”
এতক্ষণে বাচ্চার হাতের কবজি, হাঁটু, গোড়ালির জয়েন্ট সমস্ত কিছু পরীক্ষা করে নিয়েছি আমি। ফুলে আছে প্রায় সমস্ত জয়েন্টই। ইনফ্ল্যামেশানের সমস্ত চিহ্নই প্রকট। তার উপর ওই জয়েন্টের কাছাকাছি চামড়ার নিচে ছোটো ছোটো কি যেন তৈরি হয়েছে, যা কিনা এ রোগ ভোগান্তির আগে ছিল না।
বুঝতে আর বাকি রইলো না। অ্যাকিউট রিউমাটিক ফিভারের রোগী।
গলা ব্যথা হয়ে জ্বর। রক্ত বর্ণের গলা। অর্থাৎ কিনা বিটা হিমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাসের আক্রমণের সম্ভাবনা। তারপর মেজর জয়েন্টের ব্যথা। তার মানে পোষ্ট স্ট্রেপটোকক্কাল আর্থ্রাইটিস। বাচ্চার হাত হঠাৎ করেই অনিচ্ছাকৃত ভাবে লাফিয়ে ওঠা। তার মানে কি ‘সিডেনহাম’স কোরিয়া’?
একজন ক্লিনিসিয়ানের কাছে এ যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মত অবস্থা। কারণ সিডেনহাম’স কোরিয়া আজকালকার রিউমাটিক ফিভারে বেশ দুর্লভ। বাচ্চার দুই চোখের ল্যাটারাল সাইডের লাল ভাব। তাহলে কি রিউমাটিক কারণে উভেয়াইটিস? কৌতূহলে বাচ্চার পরনের জামার বোতামগুলো ঢিলে করতেই বগলের নিচে দেখতে পেলাম লাল রঙের চাকা দাগ। তবে কি এরাইথেমা মারজিনেটাম? আর বুঝতে বাকি রইলো না।
হ্যারিসনের বইয়ের পাতাগুলো মুহূর্তে ভেসে উঠলো চোখের সামনে। মডিফায়েড জোন্স ক্রাইটেরিয়ার মেজর সিম্পটমের মধ্যে চারখানা পেয়েছি আমি। আর্থ্রাইটিস, কোরিয়া, এরাইথেমা মারজিনেটাম, চামড়ার নিচের ছোটো ছোটো নডিউল। মাইনর ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে জ্বর তো আছেই। তাও উদবেগ চেপে রাখতে না পেরে এ.এস.ও. টাইটার, সি.আর.পি. রিপোর্ট করতে দিলাম।
বাচ্চার মা তখনও বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছেন, লাল দাগের এরাইথেমা মারজিনেটাম আসলে “দাদ”, উভেয়াইটিসের লাল দাগ আসলে জয় বাংলা। গলা ব্যথার জ্বর তো সবারই হয়, এ আর এমন আশ্চর্যের কি? আর চামড়ার নিচের নডিউল তো অনেকেরই থাকে। কোয়াকবাবুরা রিপোর্ট তো করিয়েইছেন। আবার রিপোর্টের খুব প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
কথা না বাড়িয়ে উনার হাতের রিপোর্টেই ই.এস.আর.-এর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। ই.এস.আর. ১০০। এর পর আর আমাকে পায় কে?
তূরীয় মেজাজে টেক্সট বুক ডায়াগনোসিসের সম্ভাব্য তৃপ্তির নেশায় চোখবুজেই রিপোর্টগুলো এক্ষুণি করে নিয়ে আসার আদেশই দিলাম একপ্রকার।
আবার টাকার খরচ। খানিক অসন্তোষ প্রকাশ করলেও আমার আত্মবিশ্বাসী একরোখা চোখে চোখ মেলানোর ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পেলেন না ভদ্রমহিলা।
ছেলেকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন মা। যাওয়ার পথে ছেলের যন্ত্রণাক্লিষ্ট হাঁটা, চোখ এড়ালো না আমার।
ঘন্টাখানেকের বিরতি। অন্যান্য রোগী দেখার মাঝেই রিপোর্ট এলো। এ.এস.ও. টাইটার ছ’ শো ছুঁয়েছে। সি.আর.পি. আটচল্লিশ। আমার রোগনির্ণয়ে সিলমোহর পড়লো।
বেঞ্জাথিন পেনিসিলিনের ইঞ্জেকশন দিতে হবে বলতেই কঁকিয়ে উঠলেন মা। চোখে জল এলো বাচ্চাটিরও।
বুঝিয়ে বললাম- না দিলে সমূহ বিপদ। হৃৎযন্ত্রের ভালভ্গুলো গোল পাকিয়ে গন্ডগোল বাধাবে তাতে। এমনকি মৃত্যুমুখী হওয়ারও আশঙ্কা।
অবশেষে বিনা গোলযোগেই অত্ত মোটা নিডলে ইঞ্জেকশন পর্ব সম্পন্ন হলো। বাকি অত্যাবশ্যক ওষুধপত্র খসখস করে লিখে দেবার পর আবার তিনহপ্তা পর ইঞ্জেকশন নিতে হবে শুনে উৎকর্ণ হলেন বাচ্চার বাবাও।
অ্যাকিউট রিউমাটিক ফিভার। গ্রুপ এ বিটা হিমোলাইটিক স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া জনিত গলাব্যথা, জ্বর। সেসময়ের রোগ নির্ণয়ের অসম্পূর্ণতা থেকে অপরিপূর্ণ চিকিৎসার কারণে পরবর্তী গাঁটে ব্যথা, অনিচ্ছাকৃত হঠাৎ দমকা হাত, পায়ের সঞ্চালন (কোরিয়া), উভেয়াইটিস, চামড়ার নিচের নডিউল, চাকাচাকা লাল দাগের সৃষ্টি। আরও অবহেলায় হার্টের ভালভ্ নষ্ট হয়ে সমূহ বিপদের আশঙ্কা। এছাড়াও গাঁটের রোগের বাড়বাড়ন্ত হয়ে চলৎশক্তিরহিত হবার সম্ভাবনা তো থাকছেই।
ভদ্রলোক ভ্রূক্ষেপহীন কথাগুলো শুনে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
ফিরে এলেন ঠিক এক হপ্তা পর। ছেলে এখন অনেকটাই সুস্থ। আমার চিকিৎসা নেবার পর ছেলেকে নিয়ে গেছিলেন ভুবনেশ্বর এইমস্ হাসপাতালে। ওঁদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে বিশ্বাস বেড়েছে। তিন হপ্তা পরপর ইঞ্জেকশন নিতেও এখন রাজি। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে নিজ হাতে চাষ করা একগোছা চন্দ্রমল্লিকা বাড়িয়ে ধরলেন আমার পরিতৃপ্ত চাহনির দিকে।