তখন ভরা ভর্তি দুপুর। খটখটে সূর্য আকাশ জুড়ে চমকাচ্ছে। আমাদের দীর্ঘনাসা ইন্দ্রলুপ্তযুক্ত আধবুড়ো ডাক্তার ছাতপাখার তলায় টেবিলে মাথা রেখে ঝিমুচ্ছেন। ওঁর সুন্দরী পিসিমা কানে যন্ত্র গুঁজে গানে মগ্না। এমন সময়ে পাংশুমুখে হতদরিদ্র একটি পরিবারের তিন জন এসে দুয়ারে উপস্থিত। এঁদের মধ্যে একজন মধ্যবর্তী যিনি কৃশদেহী, তিনি ঘর্মাক্ত কলেবর, চোখ শিবনেত্র হয়ে আছে। বাকি দু’জন কোনোক্রমে রোগীকে নিয়ে হাতুড়ে ডাক্তারের ঘরে শুইয়ে দিলেন।
“ভয়ানক শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, শরীল অসাড় হৈয়ে যাচ্ছে ছার…।”
কপাল ও ঘাড়ের ঘাম নোংরা গামছায় মুছতে মুছতে বাকি দু’জনের বেশি বয়স্কজন যিনি তিনি বললেন – “পেরায় দিনই – দিনে রেতে ঝ্যাখন ত্যাখন এরম হয় – চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায় – কত ডাক্তার, কত বদ্যি, ওঝা-গুনিন – সব কৈরেছি, শ্যাষে হুই দশতলা হাসপাতালে ভর্তি রেখেছিনু, দু’ বিঘাখানেক জমি আছিল, বিক্রি করে হাসপাতালের ত্থেকি ছাড়িয়ে এনেছি…।”
কমবয়স জন মাথা নিচু করে বলে, “সব রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করায়ে নিছে ছার, শ্যাষে বলল হার্টের ভিত্রে তার ঢুকায়ে কী য্যান করবে, তাই সই দিয়ে নিয়ে আইছি, এ বার আপ্নেই ভরসা।”
ডাক্তারের মনে হল ছেলেটা বলল, এখন এলাহি (আল্লাই) ভরসা। বুড়ো হাতুড়ে বড়ো সংকুচিত হলেন। কতটুকুই বা ওঁর ক্ষমতা? ওঁর নিজের মা-বাবা তো ওঁর অধীনে ভর্তি থেকেই মারা গিয়েছেন। ওঁর ক্ষমতায় কুলোলে তো মরতেই দিতেন না।
একটুক্ষণ দু’চোখ বন্ধ করে তার পর আবার দরিদ্র পরিবারটির দিকে তাকালেন। রোগী দেখার বিছানায় শায়িত রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাসের হার মিনিটে চোদ্দো। কপালভর্তি বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখে অসম্ভব ভয়ের ভাব। হাতুড়ে ডাক্তার ওঁর হাতটা আলতো করে ধরলেন। নাড়ি চুয়াত্তর। হাতুড়ে নিজের রংচটা পায়াভাঙা চেয়ারে আসীন হলেন। যখন উনি স্বাধীনভাবে চিকিৎসাব্যবসা আরম্ভ করেন তখন ওঁর দক্ষিণা ছিলো দশ টাকা – আজ বহু বছর পর বহু গুণ বেড়েছে – তার কিছু তো প্রতিদান ওঁকে দিতেই হবে।
উনি রোগীর দিকে তাকালেন। বহু বদ্যি ঘুরে ঘুরে চিকিৎসায় বিশ্বাস তলানিতে। এখন প্রয়োজন র্যাপিড ফায়ার রাউন্ড। হাতুড়েকে রোগীর অসুবিধাগুলো বলে দিতে হবে – যাতে বেচারা বোঝেন যে এই বুড়ো ওঁর রোগটা ধরতে পেরেছেন।
হাতুড়ে অর্ধ-নীমিলিত নয়নে বলেন, “আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব। ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’-এ উত্তর দেবেন, ঠিক আছে?” রোগী চোখে চোখে সম্মতিসূচক উত্তর দিলেন।
“আপনার যখন কষ্ট আরম্ভ হয় তখন বুক ধড়ফড় করে?”
“হাত পা অসাড় হয়ে আসে?”
“গোটা শরীর ঘেমে যায়?”
“মনে হয় এক্ষুনি মরে যাবেন?”
“ঘরের ভেতরে থাকতে ভয় হয়?”
“তখন দম আটকে আসে?”
“হঠাৎ করে কখনও ঘুমের মধ্যেও এ রকম হয়?”
রোগীর বাড়ির লোক হড়বড়িয়ে ওঠে, “ও ডাক্তারবাবু, এরমটা তো বহু দিন হৈছে গো – মাঝরেতে সে কী ক্যাঁচাল – অক্সিজেন দ্দেয়েও কমে না… সেই সালাডা রাত সেই ঠায় হাসপাতালের গাছতলায় – বাড়ির মানুষটার বড় কষ্ট গো – দ্যাহো না যদি একটু সারায়ে দিতি পারো… যা চাও তাই দেবোই গো।”
হাতুড়ে খসখস করে একটা পাতায় কী যেন লেখেন – “যান, এটা একপাতা নিয়ে এসে একটা জিভের তলায় দিয়ে দিন – আমি আধঘণ্টাটাক পরে দেখব” – বলে গটগটিয়ে ওঁর পরম বন্ধু হাবুল সাহার পানের দোকানে গিয়ে মনোজকে দু’টো চা বলেন। সেই মাত্র তখন হাবুলবাবুকে শীতল পানীয়ের কোম্পানি থেকে একটা মস্ত ফ্রিজ দিয়ে গিয়েছে। হাবুলবাবুর ছোট্ট দোকানে সেটা বসাতে গিয়ে বেচারার টাকে ঘাম জমেছে। দু’জনে এক কাপ করে চা পান করে হাতুড়ে উদ্গার তুলতে তুলতে খুপরিতে ফেরেন। শীর্ণকায় ছিন্নপোশাক বয়স্ক রোগী তখন অন্তত সত্তর ভাগ সুস্থ।
হাতুড়ে একটা মজারু হাসি হাসেন – “কী মশয়, কেমন বোধ করছেন?”
রোগীর ঠোঁট-চিবুক বেয়ে হাসি গড়িয়ে পড়তে থাকে, “হ্যাঁ অনেকটা ভালো… কিন্তু বড্ড মাথায় যন্তন্না – ঠিক ব্যথা নয় যন্তন্না।”
হাতুড়ে রোগীর প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে একটা সাদা কৌটো (সর্বিট্রেট জাতীয় ওষুধের) বার করে বলেন, “এটা খেয়েছেন তো? এই ওষুধে কখনও কখনও মাথাব্যথা হয় – তাতে কোনো ক্ষেতি নেই – সেরে গেলে কমে যাবে।”
হাতুড়ের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে যাওয়ার সময় রোগীপার্টির বাচ্চা ছেলেটা প্রশ্ন করে, “আচ্ছা এই রোগটা কী ডাক্তারবাবু?”
হাতুড়ে চমৎকার গাম্ভীর্য নিয়ে বলেন, “লেখা আছে… তবু বলি এটার নাম প্যানিক অ্যাটাক – দুশ্চিন্তা, হতাশা থেকে এই রোগটা হয় – এই রকম হয়তো আর হবে না – তবে হলে ওই পাতা থেকে একটা বড়ি জিভের তলায় দিয়ে দেবেন, তার পর ভালো নার্ভের ডাক্তার মানে নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়ে নেবেন।”
রোগীপার্টির বয়স্কজন জিজ্ঞেস করেন, “হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, এই পিকনিক অ্যাটাক এটা …মানে ওই বড়ো হাসপাতালের ডাক্তাররা জানেন না?”
হাতুড়ে অন্যমনস্ক ভাবে সুন্দরী রিসেপশনিস্টকে হাঁক পাড়েন, “অ পিসিমা আয় রে, এ বার ঝাঁপ বন্ধ করি।”
Abaar “Panic Attack ” ???