বুধবারের পড়ন্ত বেলায় যূথিকা যখন আমার চেম্বারে ঢুকলো তখন তার বাঁ চোখ ঘিরে নিশ্ছিদ্র ব্যান্ডেজ। মাথার বাম দিক গামছায় মোড়া। অপর চোখে অতি যন্ত্রণার ক্লিষ্ট ছাপ। অভিব্যক্তি নিদারুণ। ‘প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছি স্যার। চার দিন হলো বাম চোখ ঘিরে অসম্ভব যন্ত্রণা। প্রথমে পাড়ার ডাক্তারের কথায় সাইনুসাইটিস হয়েছে ভেবে স্টিম ইনহেলেসান করলাম। প্যারাসিটামল খেলাম। কি এক খান যেন অ্যান্টিবায়োটিকও খেলাম খান কতেক। কমলো তো না। বরং কাল থেকে আবার জল ভরা ফোস্কার মত কি সব যেন বেরিয়েছে। চোখ থেকে সাদা সাদা পিঁচুটি কাটছে অনবরত।যন্ত্রণায় গত দুদিন চোখের পাতা এক করতে পারিনি স্যার। অবশেষে সেই পাড়ার ডাক্তারের কাছে আবার গেলাম।উনি দেখে শুনে বললেন কার্বাঙ্কল হয়েছে। তাই ফোঁড়া কয়েকটা ফাটিয়ে মলম আর গুচ্ছের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন উনি। কিন্তু গতরাত থেকে যন্ত্রণার সাথে ব্যথাও বেড়েছে বিস্তর। তার উপর ফোঁড়া ফাটলে তো পূঁজ বেরোয়। কিন্তু এ ফোঁড়া থেকে শুধুই জলের মত কি সব যেন বেরিয়ে এলো। তার উপর মুখের ঠিক বাম দিক দিয়েই বেরিয়েছে। উনি বললেন,আমি নাকি বাম দিকে পাশ ফিরে শুই। তাই ব্যাকটেরিয়াগুলো বাম দিকে বাসা বেঁধেছে। খুব ভয় পেয়ে তাই আপনার কাছে এসেছি স্যার। আমাকে বাঁচান।’
এতগুলো কথা একসাথে উগরে খানিক হালকা হলো বছর চব্বিশের যূথিকা।
ওর কথা শুনেই আন্দাজ করছিলাম কি হয়েছে। তাও নিশ্চিত হতে মুখঢাকা গামছা ধীরে ধীরে খুলে ফেললাম।চোখের ব্যান্ডেজ আলগা হতেই বীভৎস মুখটা চোখে পড়লো। মুখমন্ডলের বাম দিক ঘেঁষে চোখ ঘিরে অনেকগুলো জল ভরা ফোস্কা। কয়েকটি ফোস্কা মাথার বাম দিকের ত্বক জুড়ে বিস্তার ঘটিয়েছে। কয়েকটির ওপর জোর দিয়ে রস বের করায় জায়গাগুলো লাল হয়ে আছে। তার উপর আবার সাদা কি সব পাউডার আর চ্যাটচ্যাটে মলম লাগানোয় বীভৎসতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট শিউরে উঠলো।
যদিও এ বীভৎসতার উৎস আমি জানি। চিকিৎসক জীবনে এ রোগের চিকিৎসা করেছি বিস্তর। চিকিৎসা পরিভাষায় পোশাকি নাম “হারপিস জস্টার অপথ্যালমিকাস”। মূলত: হারপিস ভাইরাসের আক্রমণে নার্ভে বাসা বেঁধে শরীরের কোনো এক অর্ধাংশ জুড়ে এর প্রকাশ ঘটে। প্রথমে যন্ত্রণা। হালকা জ্বর। গা ম্যাজম্যাজ। তারপরেই জল ভরা ফোস্কার উপস্থিতি। সঠিক চিকিৎসা সঠিক সময়ে না হলে এই ফোস্কা গুলোর বিস্তৃতি ও সাথে অসম্ভব যন্ত্রণা।পরিশেষে নার্ভ ড্যামেজ। চোখ ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন অংশে বাসা বাঁধতে পারে এ রোগ। তখন তাকে শিংগলস বলি আমরা। সাধারণত এক দিকের ডার্মাটোমের উপরই এর বিস্তৃতি। যদিও জটিল ক্ষেত্রে একাধিক ডার্মাটোমে বিস্তার হতেও দেখেছি। ভয়ংকর এই রোগের প্রকাশ। দুর্বিষহ যন্ত্রণা আর বীভৎসতাযুক্ত এ রোগকে অনন্য না বলে উপায় নেই।
যূথিকাকে যদিও আশ্বস্ত করে বললাম, ভয় নেই। একদম ঠিক হয়ে যাবে। যে ওষুধগুলো লিখে দিচ্ছি নিয়ম করে খাও। একদম নির্মূল হয়ে যাবে। যূথিকা খানিক অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালেও ডান চোখের কোনে মৃদু আশ্বস্ত ভাব আমার চোখ এড়ালো না। খসখস করে ওষুধ লিখে বললাম ‘ওখানে কোনো কিছুই লাগানোর প্রয়োজন নেই। নরমাল স্যালাইন দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিচ্ছি। এ কয়েকদিন চোখে কালো সানগ্লাস লাগিও। মানাবে ভালোই।’ আমার এ স্বল্প হেঁয়ালীতেও যূথিকার মুখে এতটুকুও হাসি ফুটলো না। বরং খানিক অনুযোগের সুরে বললো – ‘এই মুখে আমাকে আর কে বিয়ে করবে?’ এই একটা কথা মনে হয় অনেকক্ষণ ধরেই ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।আমার হেঁয়ালীতে সে বাঁধ ভেঙে চোখের জলে সিক্ত হলো গাল দুটো। বাম চোখের জলের দিকে তাকিয়ে প্রেসক্রিপশন টেনে একখান চোখের ড্রপ আর চোখের মলম যোগ করে আপাতত বিদায় দিলাম তাকে।
পরের রোগী দেখার মাঝেই ফিরে এলো সে। ‘ডাক্তারবাবু, এই এক নম্বর ওষুধটা দিনে পাঁচ বার খেতে লিখেছেন। তাও আবার এত্ত বড় ট্যাবলেট। ডোজটা ঠিকঠাক লিখেছেন তো?’ ওর সন্দেহ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। খুব কম ওষুধেরই এই ডোজ হয়। আস্বাসের সুরে বললাম, ‘অ্যান্টিভাইরাল এ ওষুধের ডোজ এরকমই হয়। এ ওষুধ এভাবে না খেলেই নয়। পুরোপুরি সারতে চাইলে ডোজ কিন্তু মিস করা চলবে না।’
আমার কথায় খানিক নিশ্চিন্ত হয়ে নরমাল স্যালাইনে মুখ পরিষ্কার করতে আমার অ্যাসিসটেন্টের সাথে পাশের ঘরে গিয়ে বসলো যূথিকা।
ফিরে এলো নির্ধারিত সাত দিনের মাথায়। মুখে চওড়া হাসি। ‘একদম মিলিয়ে গেছে স্যার। মুখে কোনও দাগ আর অবশিষ্ট নেই। শুধু যন্ত্রণা কিছুটা এখনও রয়ে গেছে।’ আবারও আশ্বাস দিয়ে বললাম, ‘এ যন্ত্রনা পুরোপুরি লাঘব হতে মাস পার হয়ে যেতে পারে। এ যন্ত্রণার পোশাকি নাম “পোস্ট-হারপেটিক নিউরালজিয়া”। এর ওষুধও আগের বারেই লিখে রেখেছিলাম। ওটা চলবে মাস খানেক,আগের মতই। কিন্তু দিনে পাঁচ বেলা খাওয়ার ওষুধটা আর লাগবে না। এর পরে একজন চোখের চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চোখটা দেখিয়ে নিও।’ যদিও প্রাথমিক ভাবে চোখের মলমও দেওয়াই ছিলো।
আমার কথার উত্তর না দিয়ে খানিক ইতস্তত করে ব্যাগের ভেতর থেকে একখান ক্যাডবেরির প্যাকেট বের করে আমার টেবিলে রেখে বললো ‘আপনার মেয়ের জন্য নিয়ে এসেছি স্যার। না বলতে পারবেন না। সামনের মাসেই বিয়ে করে দূরদেশে চলে যাবো। তার আগে কিছুটা ঋনমুক্তির চেষ্টা বলতে পারেন।’ পাশ থেকে উঁকি দেওয়া বছর তিরিশের যুবক মুখ তুলে হাতজ করলো আমার উদ্দেশ্যে। আর না বলার উপায় নেই। ভালোবাসার সেতুবন্ধনে এ ক্যাডবেরি তারই স্মারক হিসেবে তুলে রাখলাম ড্রয়ারের ভেতর।