আমার বন্ধু তালিকায় থাকা প্রায় সবাই, শুনেছেন এবং বেশিরভাগ জনই মনে করেন মুসলিম মানেই মিনিমাম ৪ জন স্ত্রী ও ষোলটি সন্তান! দু একটা ব্যতিক্রম থাকতে পারে কিন্তু, মোদ্দা কথা এই!
ছোটবেলা থেকে আমি এই কথা শুনে আসছি। আপনিও আপনার পরিবারের শুনে আসছেন। পাড়ার মোড়ের আড্ডায় কিংবা সিনেমার দৃশ্যে আপনি আখছার এই নিয়ে কথা শুনেছেন দেখেছেন।
আর বিগত ১০ বছরে ফেক ছবি ও তথ্য ভরা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের দৌলতে এই কথা তো প্রতিষ্ঠিত করা হয়েই গেছে। তার সাথে এই আমাদের ভারতের বুকে কি ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে চলেছে তারও নানা রকমের ট্রেলার আপনাদের দেখানো হয়ে গেছে।
শুধু আপনাকে নয় আপনার পাড়ার ছোট্ট যে ছেলে বা মেয়েটি, যে স্কুলে যায়, যার হাতে একটা ফোন তারও মথায় গুঁজে দেওয়া গেছে এই তথ্য।
তো এই বিষয়টা যাচাই করার আমার একটি সুযোগ হয়।এবং সামান্য একটি প্রশ্ন কিভাবে এই বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবনা চিন্তাকে জানা বোঝাকে ওলট-পালট করে দিতে পারে তা আপনাদের জানাই।
বছর দেড়েক আগে আমার গ্রামের কয়েকটি গ্রাম পরে বেলিয়াড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে SAS নামের একটি পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব পড়ে আমার এবং আমার সহকর্মী Somen এর।
কোনোও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পেলে সেটাকে যতদূর সম্ভব সদ ব্যাবহার করার চেষ্টা আমরা করে থাকি। একজন শিক্ষক ও বিজ্ঞান কর্মী হিসেবে দায়বদ্ধতা থেকেই এই কাজ করার চেষ্টা করি।
“আপনার স্কুলে যখন যাচ্ছি তখন ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে জীবনদায়ী কৌশল সিপিআর এর উপর একটি আলোচনা করলে কেমন হয় ?” জানতে চাওয়ায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সানন্দে রাজি হন!
এবং তার থেকেও বড়ো কথা , তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্য বইয়ে এই বিষয়টির উল্লেখ আছে। অর্থাৎ জলে ডুবে গেলে একজন মানুষের কিভাবে হৃদ শ্বাস পুনরুজ্জীবন সম্ভব, তার উল্লেখ পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর বই আছে।
যা আমি নিশ্চিত, আমার বহু বন্ধুবান্ধব জানার সুযোগ পাননি। যদিও এই যে পরীক্ষা নিতে গিয়ে এরকম একটা অনুষ্ঠান করা তাই নিয়ে তির্যক মন্তব্যও আমাদের পাওনা হয়।
যাই হোক , আসি মূল প্রসঙ্গে,
সঠিক সময়ে মেনিকিন সহ স্কুলে পৌঁছে পরীক্ষা নিতে গিয়ে দেখি, তৃতীয় শ্রেণীর ৪২ জনের মতো ছাত্রছাত্রী উপস্থিত, যাদের প্রায় ১০০% মুসলিম।
সব কিছু নিয়ম কানুন মেনে পরীক্ষা টরীক্ষা হওয়ার পর খাতা জমা নেওয়ার পর হঠাৎ মাথার মধ্যে একটা ভাবনা আসে !
আচ্ছা শিশু গুলোকে জিজ্ঞেস করে দেখিতো ওরা ক ভাই বোন ?!
উত্তর শুনে আমারও অবচেতন মনে থাকা ভাবনা একেবারে উলটপালট হয়ে যায়।
প্রায় ৩৫ শতাংশ ছাত্র ছাত্রী বলে তারা তাদের বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান!
প্রায় ৪৫ শতাংশ বলে তারা দুই ভাই বোন !
এবং ৪২ জনের মধ্যে মাত্র একজন জানায় তারা চার ভাই বোন !!
প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে পারি বিদ্যালয়ে প্রায় ২৫০ জন ছাত্রছাত্রী পড়ে, যাদের প্রায় ১২০ জন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান !
এবং বাকি প্রায় ১২০ জন দুই ভাই বোন !
আমার সাথে সোমেনও অবাক!!
এবং এই বিষয়টা নিয়ে যখন বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সাথে কথা বলি তিনি জানান – এই বিদ্যালয়ে আসার আগে আমাদেরও এই একই ধারণা ছিল। এখানে এসে আমাদের ধারণা পুরো পাল্টে গেছে। আজ যখন কোথাও শুনি কথা প্রসঙ্গে কেউ বলেন যে, মুসলিম মানেই তাদের অনেকগুলি করে সন্তান-সন্ততি তখন তাদের বলি যে একবার আমার স্কুলে ঘুরে দেখে আসবেন !
তাহলে দেখুন আমার একটিমাত্র প্রশ্ন কেমন আমার জানা বোঝাকে ওলট পালট করে দিল!
আজ যখন কোন বন্ধুর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি, তার মনে এক অদ্ভুত আশঙ্কা! তার আশঙ্কা – যে হারে মুসলিম জনসংখ্যা এদেশে বাড়ছে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই নাকি মুসলিমে গোটা দেশ ছেয়ে যাবে!” তখন মনে পড়ে বাচ্চাদের জোর করে খাওয়ানোর জন্য বড়দের মিথ্যা একানড়ে কিংবা ব্রহ্মদত্তির গল্পের কথা! কিংবা একটা বাড়ী কে ভেঙে ফ্ল্যাট বানাবার আগে তাকে ভুতুড়ে বাড়ী ঘোষণার কথা!
অথচ এই মিথ্যের ফানুস আপনার একটা প্রশ্নই ফুটো হয়ে যেতে পারে!
তাই, একটি অনুরোধ আপনার আশেপাশের ছাত্রছাত্রী মুসলিম জানতে, পারলে একটু জিজ্ঞেস করুন না
“কিছু যদি মনে না কর, একটা প্রশ্ন করব তোমায়?”
– “হ্যাঁ বলুন?”
– “তোমরা ক ভাই বোন ?”
এইখানে অনেকেই বলে বসবেন, ছাত্র-ছাত্রী কেন? যেকোনো বয়সের লোকজন নয় কেন? সোজা উত্তর – ঘটনা ক্রমে আপনি যদি আপনার কাছে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি নামের কাউকে পেয়ে যান, তখন হঠাৎ যদি এই প্রশ্ন করে বসেন, উত্তরে উনিই জানাবেন – আজ্ঞে আমি তৃতীয় সন্তান ও আমরা মোট ছয় ভাই বোন! ফলে বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা ঠিক শুরুতেই কেমন ঘেঁটে যাবে, তাই না ?
আর যাঁরা বলবেন – মুসলিম ছাত্র ছাত্রীই কেন? তাঁদের বলি, আপনি যাকে খুশি করতে পারেন, এবার মুসলিমদের সাথে মিলিয়ে নেবেন!
এইভাবে প্রশ্ন করতে শুরু করলেই কিছুদিনের মধ্যেই দেখবেন – আপনার বুকের মধ্যে জমে থাকা ভয়ের পাহাড়টা চুরমুর করে ভেঙ্গে গলে গিয়ে মনটাকে হালকা করে তুলবে। আপনি আরো বেশি বেশি শ্বাস নিতে পারবেন।
আপনার এতদিনের লালিত ধারণা গুলোই অন্য রকম হয়ে উঠবে! ওই মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে আপনি আপনার সহ নাগরিককে খুঁজে পাবেন!এবং এক লহমায় চিনে যাবেন, কারা আপনাকে কীজন্য ওই ভয়টা দেখাতে চেয়েছিল?
আবার বলি, কাজটা খুবই সোজা! শুধু একটা প্রশ্ন করা – “তোমরা কয় ভাই বোন গো? কে কে আছেন তোমার পরিবারে?” ব্যস্ আর কিছু না!
সব শেষে আমার , ফেসবুক বন্ধুদের কাছে অনুরোধ, আপনার কাছে এমন তথ্য আছে ? আপনার স্কুল মুসলিম অধ্যুষিত ? সেই স্কুলে কয়জন ছাত্র ছাত্রী ? ও তারা মূলত: কয় ভাই বোন? একটু অথেনটিক তথ্য কমেন্টে লিখুন না! প্লিজ
আসুন না, আমরা সহনাগরিকদের প্রতি ঘৃণা ও সন্দেহের কুয়াশাকে সত্যের উজ্জ্বল আলো দিয়ে গলিয়ে ফেলি!
আজ যখন, এই সব সত্য যাদের ছড়ানোর কথা ছিল, তারাই মিথ্যের বেসাতি খুলে বসেছে, তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষকেই তো দায়িত্ব নিতে হবে সত্যের পথ রেখা টানার!