১.
বহুদিন ধরে ওরা ছুটে গেছে। ক্লান্তিহীন, বিরামহীন। এক হাতে লন্ঠন, উল্টো হাতে বল্লম, তাতে ঘুঙুর বাঁধা। খাঁকি পোষাক। পৃথিবীর খবরের বোঝা, টাকার বোঝা ওরা ঠিক পৌঁছে দিয়েছে যথাস্থানে। সময়ের একচুল দেরি হলেই ওভারসীয়ার বসে আছেন জরিমানা করার জন্য। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে চাকরিটাও চলে যেতে পারে। তাই দস্যুর হাতে লুটপাট হওয়ার থেকেও ওদের বেশি ভয় পুবদিক লাল হয়ে এলে। ওরা ছুটে গেছে জোরে.. আরও জোরে..
ওদের যাত্রাপথের দুপাশে বদলে গেছে শাসক, বদলে গেছে সমাজ। ওদের ছোটা থামে নি..
“এমনি করেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে’
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে
অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।”
২.
করোনা বিধ্বস্ত ভারতবর্ষ হাঁটছে। না, না আঁতকে ওঠার কিছু নেই। সামান্য ক’টা দিন আনি, দিন খাই শ্রমিক। ওদের আবার জীবনের দাম!! খুব স্বাভাবিক ভাবেই এত অকিঞ্চিৎকর একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে শাসকের ভারী বয়েই গেছে। ওরা কীভাবে বাড়ি ফিরবে সেটা একটা বলার মতো বিষয় হ’ল?
গাড়ি নেই। ওরা হাঁটছে। ঘন্টার পর ঘন্টা। দিনের পর দিন। অভুক্ত, অর্ধভুক্ত। ওরা ধুঁকছে, পা ফেটে যাচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণায়। বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে থাকলে মালিক খেতে দেবে না। তাই ওরা হাঁটছে। মাইলের পর মাইল..
তারপর? ভাবুন দেখি, কী নোংরা লোকগুলো সব গাদাগাদি করে কতো দূর থেকে কী না কীসব বয়ে এনেছে.. তাই আমরা তাদের বসিয়ে রেখে গোটা গায়ে স্প্রে করেছি রাসায়নিক। এগুলোকে জীবাণুমুক্ত না করে ভেতরে আনা যায়? আপনিই বলুন?
কী বলছেন? এইভাবে রাসায়নিক স্প্রে করলে মুখে-চোখে ঢুকে ক্ষতি হ’তে পারে? দূর মশাই, রাখুন আপনার তত্ত্বকথা। দেশে করোনার জন্য এগুলোই দায়ী। আবার কী বললেন? আমলাপুত্র, নিজামুদ্দিনের জমায়েত? ওফফ!! আপনি না মশাই বড্ড এঁড়ে তক্কো করেন..
৩.
বড় রাস্তার পাশের জমায়েতগুলো পুলিশের ভয়ে পাড়ায় ভেতরে নেমে এসেছে। বেশ একটা ছুটি ছুটি আমেজ..
“তিন হপ্তা!! মুখের কথা? পুরো মস্তি লুটে নিতে হবে। চ্চলো শালা, চিয়ার্স!! বাড়িতে গ্যাঁট হয়ে কতক্ষণ বসে থাকা যায় বল দেখি? আড্ডা মারবি, তাস পিটবি, এক জায়গায় গোল হয়ে বসে গুলতানি মারবি.. সব করবি। শুধু একটু লুকিয়ে করবি। করোনা-ফরোনার জন্য হাসপাতাল আছে। আমাদের কী?”
৪.
তারাশঙ্করের ডাকহরকরা কোনোদিন কয়েক টাকার বেশি চোখে দেখেনি। সেই তার নামেই নাকি সাড়ে-পাঁচশো টাকার মানি-অর্ডার এসেছে !! সবাই বলছে নাকি আফ্রিকা থেকে এসেছে। তবে কি তার হারিয়ে যাওয়া ছেলে আফ্রিকায় গিয়ে চাকরি পেয়েছে? তারপর বাপের জন্য টাকা পাঠিয়েছে? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে জীবনে প্রথমবার চিঠির বোঝা নিয়ে পোস্ট-অফিসে ফিরতে তার দেরি হয়ে যায়। বোঝার মধ্যেই টাকা ভর্তি খামটাও আছে।
খাম কাটা হয়। তার কথাই ঠিক। হারিয়ে যাওয়া ছেলে-ই আফ্রিকা থেকে টাকা পাঠিয়েছে। তবে.. সরাসরি নয়। কাজ করতে করতে ওখানেই মারা গেছে সে। আফ্রিকার জাহাজ কোম্পানি তার সঞ্চিত অর্থ পাঠিয়ে দিয়েছে বাবার কাছে..