২৪/০৯/২০২২
এখন সকাল ৬ টা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছেন এত সকালে রাস্তায় কেনো? সকাল ৬:৩৫-এর মেদিনীপুর-হাওড়া ডাউন ট্রেন ধরার জন্য, টোটো গাড়ীর অপেক্ষায়। আচ্ছা, ওই তো একটা টোটো আসছে।
কোথায় যাবেন?
স্টেশন।
উঠুন।
৭ মিনিটের মধ্যে স্টেশনে পৌঁছলাম। টিকিটের লাইনে একটু ভীড় ছিলো, কিন্তু টিকিট কেটেই ট্রেনে উঠলাম। সকালের ডাউন ট্রেন গুলোতে ভীড় কম হওয়ায়, নিজের পছন্দ মত একটা জানালার ধারের সিট পেয়ে গেলাম। ইয়ার ফোনটা কানে লাগিয়ে পুরনো হিন্দি গান শুনতে শুনতে চোখ-দুটি বুঝে থাকলাম। যখন ট্রেনটা ছাড়লো, শরৎ-এর শীতল হাওয়া গায়ে লেগে চোখটা খুলে গেলো।
আমার পাশে বসে ২৩-২৪ বছর বয়সী যুবক, এই ঠান্ডা মনোরম পরিবেশেও তর তর করে ঘামছে। ভাবলাম দৌড়ে ট্রেন ধরেছে বলে হয়তো ঘামছে।
কিন্তু না। আমি ভুল ছিলাম ২-৩ টে স্টেশন যাবার পরেও এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় সে ঘামতে থাকলো, সঙ্গে তার হাত-পা এমনকি পুরো শরীর কাঁপছে। বুঝলাম ছেলেটি মারাত্মক ভাবে চাপে আছে। অনেকক্ষণ দেখার পরে কথোপকথন শুরু করলাম।
কী হয়েছে ভাই?
কিছু না।
না, তুমি এত ঘামছ, হাত পাও কাঁপছে। তুমি খুব টেনশনে আছ। জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, জল খাবে?
হ্যাঁ দাদা, একটু জল দাও।
আমি জলের বোতল দিতেই সে ঢকঢক করে জল খেয়ে নিল। তারপর রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বোতলটা আমাকে দিয়ে বললো, ধন্যবাদ দাদা।
আমি আবার কথোপকথন শুরু করলাম, কোথায় যাবে?
কলকাতা।
তা, এত টেনশন কিসের ভাই?
কী বলবো দাদা! চাকরির যা বাজার, আর আমাদের মত বেকার ছেলেদের টেনশন ছাড়া কী হবে!
এরপর সে নিজে থেকেই বলতে শুরু করলো। আমি পড়াশোনায় খারাপ ছিলাম না। মাধ্যমিকে ৬৫০ এর ওপরে পেয়েছি। আমার স্পেস সাইন্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু আর্থিক অবস্থার জন্য সেটা আর হয়ে ওঠেনি। আমি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশে BA এবং MA করি, NET qualify করি। কিন্তু এই চাকরির বাজারে PhD করা বিলাসিতা মনে হলো। তাই ছেড়ে দিয়ে কম্পিটিটিভ এক্সামের প্রিপারেশন শুরু করলাম। দুটোতে ইন্টারভিউ পর্যন্ত গেছি, কিন্তু ফাইনাল সিলেকশন হয়নি। কেনো হয়নি সেটাও বুঝতে পেরেছিলাম, এখন তো সবাই জানতে পারছে। ওরা আমার কাছেও চেয়েছিল, দিতে পারিনি। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, দিলে চাকরি তো থাকতই না সঙ্গে সন্মানটাও যেত।
তবে দাদা জানো, সব থেকে frustrating কী? কাল একটা document attest করার জন্য BDO office-এ গিয়েছিলাম। ৩-৪ ঘণ্টা ধরে বসেছিলাম তাও attested করলো না। বসে থাকার সময় দেখলাম আমাদের ক্লাসের সব থেকে বাজে ছেলে, যে তার বাজে ব্যবহারের জন্য বেশিরভাগ দিন ক্লাসের বাইরে থাকতো, সে এসেই গট গট করে অনুমতি ছাড়াই BDO office-এ ঢুকে গেলো। কারণ সে এখন বড় নেতা। কলেজে এসে মাস্তানি করার সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি শুরু করে এবং খুব তাড়াতাড়ি সে একজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা হয়ে যায়। এখন কোনো সরকারি আমলার রুমে ঢুকতে তার কোনো অনুমতি লাগে না। আর তুমি ভাবো, আমরা এত পড়াশোনা করে কী করলাম? একটা attest করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। পড়াশোনার কি আদৌ কোনো মূল্য থাকছে? আমরা কাদেরকে বেশি প্রায়োরিটি দিচ্ছি? কাদেরকে আমরা সমাজের সম্মানীয় স্থানে বসাচ্ছি, এগুলো তো আমাদের দেখা উচিৎ।
দেখবে, সামনেই তো দুর্গা পুজো। উদ্বোধনগুলো এই লোকগুলোই করবে। আগে কিন্তু আমরা দেখেছি পাড়ার সব থেকে সন্মানীয় ব্যক্তি, যাকে সবাই সমীহ করে, ভালোবাসে সেই পুজো উদ্বোধন করতো। এখন তো সব কিছুতেই পলিটিকস। যাইহোক দাদা। অনেক বললাম। বেশি বললে আবার কেস খেয়ে যাবো।
ধন্যবাদ, বলেই সে সাঁতরাগাছি নেমে পড়লো। আমিও হাওড়া স্টেশনে গিয়ে অন্য একটি ট্রেন ধরে রওনা দিলাম।