অনুবাদ গল্প
সে অনেক, অনেককাল আগের কথা। পৃথিবীর উত্তরতম প্রান্ত ছুঁয়ে যে বেরিং সাগর রয়েছে, সেই সাগরের তীর ঘেঁষা উত্তরপূর্ব সাইবেরিয়া অঞ্চলে, চাকচি নামের এক উপজাতি বাস করত। চাকচিদের এক মাঝবয়সী পুরুষ তার কিশোরী মেয়েটিকে নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে জীবন কাটাত বরফে ঢাকা শীতার্ত তুন্দ্রা প্রান্তরে।
কাজেকর্মে সেই মেয়ে ছিল তার বাপের একমাত্র সহায়। গরমকালে মেয়েটি তাদের পোষা হরিণের পালকে গাঁয়ের তাঁবু থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে চরিয়ে আসত। আর কষে শীত পড়লে, সে হরিণদের চরাতে নিয়ে চলে যেত আরো দূরে — ক্বচিৎ কখনো তার ভারবাহী হরিণসর্দারের স্লেজগাড়িতে চড়ে গাঁয়ে ফিরত, খাবার দাবার নেওয়ার জন্য।
এমনই এক শীতের রাতে যখন সে মেয়ে ফিরছিল তার তাঁবুতে, তার সারথি হরিণসর্দার হঠাৎ মাথাটি তুলে আকাশের দিকে চাইল।
“দ্যাখো দ্যাখো মেয়ে, ওপরপানে চেয়ে দ্যাখো”— চিৎকার করে বলল সে ডেকে।
মেয়ে তখন উপরে তাকিয়ে দেখল, চাঁদের রাজা তাঁর জোড়া বল্গাহরিণের গাড়িতে চেপে সোজা আকাশ থেকে মাটির দিকে নেমে আসছেন।
“কোথায় যাচ্ছেন উনি? আর কেনই বা?” — নিজের মনেই প্রশ্ন করে মেয়ে।
সর্দারহরিণ একটা শ্বাস ফেলে বলে ওঠে — “তাও বুঝতে পারছ না? তোমাকে তুলে নিয়ে যেতে আসছেন চাঁদের রাজা”।
মেয়ে ভয় পেয়ে গেল। “কি করব সর্দার? সত্যি সত্যিই যদি আমায় নিয়ে চলে যায়?”
কোনো জবাব না দিয়ে হরিণসর্দার তার খুর দিয়ে ত্বরিতগতিতে বরফের চাদর খুঁড়তে আরম্ভ করে দিল। আর দেখতে দেখতে একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলল সেই ধুধু প্রান্তরে।
“জলদি এসো, এই গর্তে ঢুকে লুকিয়ে পড়ো তুমি” — বলল সে মেয়েটিকে।
মেয়ে তো চটপট ঢুকে পড়ল সেই গর্তের ভিতরে আর হরিণসর্দার বরফের চাবড়া দিয়ে ঢেকে দিল তার লুকোনোর জায়গা।
চাঁদের রাজা আকাশ থেকে এসে তাঁর বল্গাহরিণে টানা গাড়ি থামিয়ে, নেমে পড়লেন সেই বরফের প্রান্তরে। খুঁজে ফিরতে লাগলেন সে মেয়েটিকে, কিন্তু পেলেন না। হাঁটতে হাঁটতে সেই বরফের ঢিবির কাছে এসে পৌঁছলেন তিনি, যার নিচের গর্তে লুকিয়ে আছে সেই মেয়ে — কিন্তু রাজা কিছুই আন্দাজ করতে পারলেন না।
“আশ্চর্য তো! গেল কোথায় মেয়েটা? কিছুতেই খোঁজ পাচ্ছি না তার!” আপনমনেই বিড়বিড় করেন তিনি — “রোসো! এখন ফিরে যাই, পরে ঠিক একসময় এসে ওকে খুঁজে পেয়ে তুলে নিয়ে যাব!”
এই বলে তিনি ফের তাঁর জোড়া হরিণের স্লেজগাড়িতে উঠে আকাশে মিলিয়ে গেলেন।
এদিকে হরিণসর্দার তক্ষুণি বরফ খুঁড়ে মেয়েটিকে বার করে আনল। মেয়ে বলল — “তাড়াতাড়ি আমাকে তাঁবুতে ফিরিয়ে নিয়ে চলো, কে জানে আবার কখন চাঁদরাজা এসে পড়বে। বার বার তো আমি লুকোতে পারব না, ধরা পড়ে যাব ঠিক”।
ভারবাহী হরিণসর্দার তাকে বিদ্যুৎগতিতে ফিরিয়ে নিয়ে চলল গাঁয়ে। সেখানে পৌঁছে মেয়ে দৌড়ে তার বাপের তাঁবু, তাদের ‘ছুম’ এর ভিতরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু বাবা তখন ঘরে ছিল না। এবার কে তাকে রক্ষা করবে?
হরিণসর্দার পরামর্শ দিল — “লুকিয়ে পড়ো ভালমানুষের বেটি, চাঁদের রাজা ভীষণ নাছোড়, সে কিন্তু ফের হানা দেবে এই ছুমে”।
“কোথায় লুকোব?” শুধোল মেয়ে।
সর্দার বলল — “চিন্তা কোরো না, আমি তোমাকে একখন্ড পাথরে রূপান্তরিত করে দিচ্ছি” —
“উঁহু, চলবে না। রাজা ঠিক চিনে ফেলবে আমাকে” — আপত্তি করে উঠল মেয়ে।
“তাহলে হাতুড়ি”?
“না, হবে না”।
“তাহলে তোমাকে একটা খুঁটি বানিয়ে দিই?”
“না”।
“দাঁড়াও, তোমাকে দরজার চামড়ার পর্দার পশম বানিয়ে দিচ্ছি, রাজা ধরতেই পারবে না।”
“না, না” — পছন্দ হলো না মেয়ের।
“তবে কি বানাবো? আচ্ছা, এসো, তোমায় একটা প্রদীপ বানিয়ে রাখি, রাজি?”
মেয়ে বলল —“আচ্ছা”।
“বেশ, বোসো তবে হাঁটু গেড়ে” —
বসল মেয়ে হরিণসর্দারের কথা মেনে — আর দ্যাখ না দ্যাখ, বদলে গেল একটা উজ্জ্বল বাতিতে। সেই দীপের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল গোটা তাঁবু।
আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁবুর পাশে বরফঢাকা জমিতে তাঁর বল্গাহরিণের গাড়ি চড়ে আকাশ থেকে নেমে এলেন চাঁদের রাজা। তাঁবুর বাইরে একটা খোঁটায় হরিণদুটোকে বেঁধে, সোজা ঢুকে পড়লেন সেই ছুমে। তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলেন মেয়েটিকে। ছুমের খুঁটি, বাসনপত্র, চামড়ার গায়ে লেগে থাকা লোম, বিছানার কাঠ, তাঁবুর মেঝে, সব উলটে পালটে তোলপাড় করে খুঁজলেন তিনি, পেলেন না।
কেবল লক্ষ্য করলেন না প্রদীপটিকে, কারণ যতই ঝলমল করুক, চাঁদের ঔজ্জ্বল্যের তুলনায় সেই বাতির দ্যুতি তখন নিতান্তই ফিকে।
“আশ্চর্য! এবারেও পেলাম না তার খোঁজ! যাই, ফিরেই যাই” — ব্যর্থমনোরথ চাঁদের রাজা তাঁর জোড়া হরিণের বাঁধন খুলতে খুলতে ভাবতে থাকেন। ফেরার জন্য তাঁর স্লেজগাড়িতে উঠতে যাবেন, এমন সময় মেয়েটি স্বরূপে ফিরে এসে দরজার পর্দার আড়াল থেকে উঁকি মেরে খিলখিল করে হেসে উঠল। “এ মা, আমায় খুঁজে পেলে না! এইত্তো আমি!”
চাঁদের রাজা চমকে উঠে তড়িঘড়ি তাঁর গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে ঢুকলেন তাঁবুর ভিতর। কোথায় কি! মেয়ে তখন ফের রূপ বদলে প্রদীপ হয়ে গেছে।
আবার আঁতিপাতি করে তাকে খুঁজতে থাকেন রাজা — প্রতিটি কাঠের টুকরো, প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি পশমের গুচ্ছে, প্রতি ইঞ্চি মাটিতে, সেই বাঞ্ছিতাকে খুঁজে চলেন তিনি, পান না।
কোথায় হারাল সে এক নিমেষে? কোথায় অদৃশ্য হলো? নাঃ, এবারও বোধহয় খালি হাতেই ফিরতে হবে চাঁদরাজাকে।
এইসব ভাবতে ভাবতে আবার যখন বল্গাহরিণদের খোঁটা থেকে খুলতে যান তিনি, সেই হাস্যমুখী মেয়ে ফের উঁকি দেয় পর্দার ফাঁকে।
“আমি এখাআআনে!” — জলতরঙ্গের মতো হাসি বেজে ওঠে তাঁবুর আড়াল থেকে।
আবার দৌড়ে আসেন রাজা। আবার খোঁজেন পাগলের মতো, অনেকক্ষণ ধরে খোঁজেন। খুঁজতে খুঁজতে ওলটপালট করে ফেলেন ছোট্ট ছুমটাকে। কিন্তু কই সে মেয়ে?
সন্ধান করতে করতে চাঁদের রাজা ক্লান্ত হয়ে পড়েন ধীরে ধীরে। শীর্ণ হয়ে আসে অবয়ব। শ্রান্ত পা দু’খানি আর যেন তুলতেই পারেন না তিনি, নাড়াতে পারেন না সবল হাত দুটি।
মেয়েটি এবার আর ভয় পেল না তাঁকে দেখে। নিজমূর্তি ধরে, দৃপ্ত পায়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে দুর্বল চাঁদের রাজাকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিল সে। তারপর আষ্টেপৃষ্ঠে রশির বাঁধনে বেঁধে ফেলল তাঁকে।
বেদনায় আর্তনাদ করে উঠলেন রাজা। “ওহ্, কি যন্ত্রণা! তুমি আমায় মেরে ফেলতে চাও, তাই না? মারো, আমার উচিৎ শাস্তি সেটাই। সব দোষ আমার। আমিই তোমায় এই পৃথিবীর বুক থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। মৃত্যুই আমার প্রাপ্য। কিন্তু শোনো, মারার আগে আমার গায়ে একটা উষ্ণ চামড়ার পোশাক জড়িয়ে দিও, কেমন? আমার বড্ড শীত করছে যে —”
মেয়েটি বিস্মিত হলো। “শীত করছে? তোমার? যার ঘর নেই, তাঁবু নেই, খোলা আকাশের নিচে যার বসত, তার গরম চামড়ার জামার কি দরকার?”
এই শুনে চাঁদের রাজা মেয়েটির কাছে মিনতি করলেন — “শোনো মেয়ে, সত্যিই আমার ঘরবাড়ি, চালচুলো কিচ্ছু নেই — আমি এক হতভাগ্য ভবঘুরে — আমায় তুমি মুক্তি দাও।
মুক্ত আকাশে আপনমনে ঘুরে বেড়াতে দাও আমাকে। যুগ যুগান্ত ধরে মানুষকে দৃষ্টিসুখ দিয়ে যাব আমি।
মুক্তি দাও আমায় — আমি তোমাদের প্রেরণা হবো।
এই বরফঢাকা অগম্য প্রান্তরে দুর্যোগে দুঃসময়ে আমিই হবো তোমাদের পথের দিশারী।
আমায় ছেড়ে দাও, দেখবে তোমাদের রাতকে করে তুলব দিনের মতো ঝকঝকে।
আমার বাঁধন খুলে দাও, আমি তোমাদের শিখিয়ে দিয়ে যাব চান্দ্রমাসী সময়ের মাপ।
প্রথমে আমি বুনো ষাঁড়ের চাঁদ হবো, তারপর হবো সদ্যোজাত মেষশাবকদের চাঁদ। তারপর একে একে বর্ষার চাঁদ, ঝরাপাতার চাঁদ, সূর্যের তাপের চাঁদ, সব হবো। আমি হরিণের ভাঙা শিংয়ের চাঁদ হবো, বনের পশুর বন্য ভালবাসার চাঁদ হবো, প্রথম শীতকালের হিমার্তও চাঁদও হবো আমি। সবশেষে বেলাশেষের চাঁদ হয়ে মিলিয়ে যাব দূর আকাশে —- মুক্তি দাও আমায়।”
“আর তোমাকে মুক্তি দিলে নিজের শক্তি ফিরে পেয়ে, হাত পায়ের জোর ফিরে পেয়ে, আমাকে তুলে নিয়ে যাবে বলে যদি আবার নেমে আসো পৃথিবীতে, তখন?” — দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে শুধোয় বরফদেশের কন্যে।
“না, কক্ষণো না” — চেঁচিয়ে ওঠেন চাঁদের রাজা —“আমি তোমার বাড়ি আসার পথটাই ভুলে যাবো এখন থেকে। তুমি বড় বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমার বাঁধন কেটে দাও, দোহাই তোমার, আমি আর জীবনেও নেমে আসব না মাটিতে। শুধু আকাশ থেকে আলো ছড়িয়ে যাব পৃথিবীর বুকে। চিরকাল”।
মেয়েটি খুলে দিল চাঁদের রাজার বাঁধন, আর বল্গাহরিণের রথে সওয়ার হয়ে তিনি উঠে গেলেন আকাশে, আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিলেন আমাদের আশ্চর্য জগতকে।
(সাইবেরিয়ার উত্তর পূর্বাঞ্চলের চাকচি উপজাতিদের রূপকথা)
রাশিয়ান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ: ইরিনা জেলেজনোভা
ছবি: আন্তর্জাল