শ্রীচরণেষু মা,
বহুদিন পর তোমার চিঠি পেয়ে মন আনন্দে ভরে উঠেছে। তুমি লিখেছ সংবাদপত্রে আর টিভিতে আমার দৃপ্ত ছবি ঘন ঘন দেখছ ইদানীং। তাতে দেখা যাচ্ছে আমি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছি। কাগজে ছবি বেরোচ্ছে দেখে, তুমি লিখেছ, গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে।
মাগো, কতদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয় না। আমরা চার ভাই, পিতৃদেবের পদাঙ্ক অনুসরণে, তোমার উৎসাহে ছোটোবেলার থেকে শরীর চর্চা করেছিলাম। তুমি বলেছিলে আমাদের বংশের ধারা মেনে কোনও না কোনও শৃঙ্খলাবদ্ধ সেনা বা আধাসেনা বাহিনীতে যুক্ত হতে হবে। সেই মত উদ্বুদ্ধ হয়ে কঠোর পরীক্ষাবিধি আর তার পরের রক্ত জল করা ট্রেনিংএর পরে আমরা সব কজন ভাইই নানান বাহিনীতে ঢুকেছি। কিন্তু মা, তোমাকে বলি, আমরা কেউই শান্তিতে নেই। না মা, দেশে বা সীমান্তে যে বলবার মত খুব অশান্তি আছে তা না। কিন্তু তবু আমাদের মনে শান্তি নেই। এই কিন্তুর কথাগুলি একে একে বলি।
এই কথাগুলি ভাইয়েরা নিজেরাই যে আমাকে জানিয়েছে তা নয়। এই কথাগুলি দেশ যারা চালায় সেই বিভিন্ন মাপের বীর নেতারাই একে অপরকে গালি দেবার সময় সোচ্চারে জানিয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলনে, টিভিতে সর্বত্র বলেছে। সব জেনে লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে গেছে আমার। ভাইদেরও এই সব শুনলে নিশ্চয়ই মাথা নীচু হয়।
আমাদের মেজভাই লক্ষ্মণকান্ত, যে বিএসএফএ আছে, তার সীমান্ত পাহারায় অতন্দ্র থাকার কথা। তার বদলে তাকে নাকি বাহিনীর বিপথগামী কমান্ডারের নির্দেশে সীমান্তে গোরু পাচার, নারী ও শিশু পাচার, এমনকি নারীনির্যাতনেরও সহায়তা করতে হয় আজকাল। তোমার দেওয়া আজন্ম শিক্ষা আর কর্মস্থলের কাণ্ডকারখানার মধ্যের বিরোধ এতই তীব্র যে আন্দাজ করি, ইছামতীতে ডুবে মরতে নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে তার।
আমাদের চতুর্থভাই শত্রুঘ্নসিংহ খুবই সম্মানের বাহিনী সিআইএসএফএর জওয়ান। তার আসল কাজ কী তা তো তোমাকে সে বিস্তারিত জানিয়েছিল, ট্রেনিং চলাকালীনই। কিন্তু বড়ই খারাপ কাজ করতে হয় তাকে ইদানীং। খনিজ কালো মাণিক নাকি পাচার হয়। চোরেদের নির্দেশে তাকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে হয় তো বটেই, এমনকি সহায়তাও নাকি করতে হয়।
তোমার বড় স্নেহের সেজ পুত্র ভরতসুন্দর রাজ্যের পুলিশ বাহিনীতে ঢুকেছিল। তুমি বড় মুখ করে বলতে পাড়ার সবাইকে, সেজ খোকার দাপটে দেশের চোর ডাকাত সবাই জব্দ হবে। মা গো শুনি সেও নাকি দারুণ ব্যর্থ। চোরদের ধরা পড়ার উদ্যোগ হলেই তাকেই নাকি আজকাল কী কী সব নামের আড়ালে তদন্ত ভণ্ডুল করতে পাঠানো হয়। তাকে জোর করে চোখ বুজে থাকতে হয়। গোরু তো আর ঝড়ের মুখে কুটো নয় যে গোরুহাট থেকে সীমান্ত অবধি সে উড়ে উড়ে চলে যাবে! কয়লা-বালি-পাথরও তাই। এ ছাড়াও মধ্যবিত্ত লোভের জন্য আর যা যা সে করে পাপমুখে বলতে ইচ্ছে করছে না।
সব শেষে আমার কথা বলি। আমি যে সিআরপিতে আছি সে তো তুমি জানো। হ্যাঁ, যে চোরেরা এতদ্সত্ত্বেও গিরেফতার হয়েছে, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা আর হোল বডি চেকিংএর জন্য দামী গাড়িতে যখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনা নেওয়া করা হয়, সে চোরেদের নিরাপত্তার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পাহারা দেয় তোমার এই সন্তান। তুমি আমার সেই পাহারারত ছবিই কাগজে দেখেছ।
আমাদের চার ভাইকেই ভোট পাহারায় মানে গণতন্ত্র রক্ষার কাজেও যথাকালে নিয়োগ করা হয়। সেখানে কী হয় তারও সাক্ষী নিরুপায় আমরা এই কজন ভাই।
বস্তুত আমরা খুবই কষ্টে আছি মাগো!
ইতি,
তোমার লজ্জিত আত্মজ,
শ্রী রামচন্দ্র সামন্ত।