স্বার্থ-র (পিতৃদত্ত নাম নয়, মাতৃদত্তও নয়। অনিরুদ্ধদত্ত নাম) গল্প আগে বলেছি। মহা দুষ্টু ছেলে ছিল। দুষ্টুমি বুদ্ধি পেট থেকে সোডার মতো ভসভসিয়ে বেরোত, এবং সেগুলো কাজে লাগাতে মোটে দেরি করত না। একবার প্রিনসিপ্যালের গাড়ির ড্রাইভার গাড়ির ভেতরে বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছিল, তখন পুট করে দরজাটা বাইরে থেকে খুলে দিয়ে পালিয়েছিল – অন্য জায়গায় লেখা আছে । সে গল্প পড়ে আমার এক বন্ধু আমাকে ইনহেলারের রসিদ পাঠিয়েছিল। হাসতে হাসতে তার নাকি হাঁপানি-জনিত শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছিল। কভারিং নোটে রি-ইম্বার্সমেন্ট দাবি করেছিল। আবার ইনহেলারের দাম দাবি করার গল্প শুনে, আর এক দাদাস্থানীয় বন্ধু জানতে চাইলেন যে তিনি খাটে বসে পড়ছিলেন। হাসতে হাসতে পড়ে গিয়ে কোমরে লেগেছিল। রসিদ রাখেননি, কিন্তু আয়োডেক্সের খালি কৌটো পাঠালে আমি তার দাম আমি দেব কি?
স্বার্থর গল্প লেখা – যাকে বলে নট উইদাউট ডেন্জার, জেনেও লিখছি।
স্বার্থর একটা ফেভারিট খেলা ছিল জুলজি প্র্যাকটিকাল ক্লাসে। সে ক্লাসে আমাদের ব্যাঙ কাটতে হত। তখনকার দিনের বুদ্ধিমান শিক্ষাবিদরা ভাবতেন ব্যাঙ কাটলে আমরা খুব উচ্চ মানের বায়োলজিস্ট হব। এই বিশ্বাস যাঁরা ডাক্তারি সিলেবাস লিখেছেন, তাঁদেরও ছিল। এঁদের বুদ্ধির কল্যাণে কত লক্ষ ব্যাঙ যে অকারণে ইহলোক ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে, তার হিসেব নেই। সে এক দিন ছিল বটে…
এহ বাহ্য, ফিরে আসি স্বার্থর কথায়। ক্লাসের শেষে ছাত্ররা সবাই যখন স্যারের টেবিলে ভীড় করেছে ল্যাব খাতা সই করাতে, বা অমন কিছু এক কাজে, ও টুক করে কোনও একটা ডিসেকশন ট্রে থেকে একটা কাটা, নাড়িভুঁড়ি বের করা ব্যাঙ নিয়ে কোনও একজন মেয়ের ডিসেকশন বক্সে ঢুকিয়ে দিত। তারপরে বাক্সটা বন্ধ করে হাত ধুয়ে দু হাত পকেটে পুরে শিষ দিতে দিতে বেরোত যেন কিছুই জানে না। যার বাক্সে ব্যাঙ, সে তো স্যারের টেবিল থেকে ফিরে এসে বন্ধ বাক্স আর খুলে দেখত না, এবং ডিসেকশন বক্স এমন কিছু টিফিন বক্স না, যে বাড়ি গিয়ে সব ধুয়ে মুছে রাখতে হবে – ফলে ব্যাপারটা ধরা পড়ত পরের জুলজি প্র্যাকটিকাল ক্লাসে – অন্তত এক সপ্তাহ পরে। প্রায়ই মেয়েদের চিল চিৎকারে আমাদের পাজঞ্জুরিতে তিড়িতঙ্ক লাগত সে দিনগুলোতে।
স্বার্থ মন দিয়ে সেদিনের কাজ করতে ব্যস্ত। ওর শিশুসুলভ নিষ্পাপ মুখ দেখলে কে বুঝবে যে ও-ই এই চিৎকারের জনক?
সব্বাই। সব্বাই স্বার্থকে দোষ দিত, স্বার্থও ভালোমানুষ হয়ে এমন আপত্তি করত, যে শিক্ষক থেকে অন্য ছাত্র (যারা প্রায় কেউই ওকে কাজটা করতে দেখেনি) সবাই ভাবত, তাহলে কি ভুল লোককে দোষারোপ করছি? ফলে ব্যাপারটা বেশি এগোত না – আবার কিছুদিন পরে অন্য কারও বাক্সে ব্যাঙ পাওয়া যেত।
স্বার্থ ধরা পড়ত না বলে সবচেয়ে বেশি অসুবিধে হত দেবদত্তর আর আমার। একে তো আমরা সেই ক্লাসে স্বার্থর সবচেয়ে ভালো বন্ধু, তার ওপর, স্বার্থ বাদে সম্ভাব্য অ্যাননিমাস ব্যাং-স্টকিস্টের তালিকায় আমাদের নাম সবার ওপরে। সত্যি বলতে কী, বুদ্ধিটা স্বার্থর মাথা থেকে না বেরোলে আমাদের মাথা থেকে বেরোন’র সম্ভাবনাও অতটাই ছিল।
কিন্তু বেরোয় তো আর নি, তবু সারাক্ষণ মেয়েরা আড়চোখে তাকাচ্ছে, যেন আমরাও সমান দোষী, সেটা বিরক্তিকর। তাই ঠিক করলাম, কিছু একটা করে আমাদের নাম কালিমামুক্ত করতে হবে।
বুদ্ধিটাও স্বার্থই যোগাল। একদিন কারও বাক্স খুলে একটা বিচ্ছিরি রকম কাটাকুটি করা ব্যাঙের অবশিষ্টাংশ বেরোল, মেয়েটি বমিটমি করে ফেলল, সে নিয়ে খুব হট্টগোলও হল, সবাই বলল স্বার্থ খুব খারাপ – এরকম ওর মোটেই করা উচিত হয়নি। স্বার্থও খুব করুণভাবে বার বার বলল, ও কিছুই জানে না। ফলে সবার আড়চোখ আমাদের দিকেই ঘুরল। দেবদত্ত গলা নামিয়ে বলল, “শালা…”
বাড়ি ফেরার সময় স্বার্থ বলল, “মাইরি, সবাই শিওর, আমিই ব্যাঙ ঢোকাই।”
আমরা বললাম, “এবারে শুধু হাতেনাতে ধরা পড়ার অপেক্ষা।”
স্বার্থ বলল, “ভাবছি – এবারে আমার বাক্সেই ব্যাঙ রাখব। ক্লাসে যদি আমার বাক্স থেকেই ব্যাঙ বেরোয়, তার পর থেকে আমাকে আর দোষ দিতে পারবে না।”
আমি আর দেবদত্ত মুখ তাকাতাকি করলাম।
কিন্তু বুদ্ধি যতই ভালো হোক, নিজের বাক্সে ব্যাঙ রাখা সহজ নয়। কয়েকটা ক্লাস গেল, স্বার্থ কিছু করল না বলে আমরা দুজন ওকে সাহায্য করব স্থির করলাম। কিন্তু সাবধানী স্বার্থর বাক্সে ব্যাঙ ঢোকান’ সহজ নয়। কাজ শেষ হলে তৎক্ষণাৎ ডিসেকশন বক্স ব্যাগবন্দী করে ফেলে। বাধ্য হয়ে মেয়েদেরই সাহায্য চাইলাম। যাদের বাক্সে ব্যাঙ পাওয়া গেছিল, তারা কেউ কেউ সেদিন ক্লাসের শেষে স্বার্থর চারিদিকে দাঁড়িয়ে ওকে নানাবিধ প্রশ্ন শুরু করল, আর আমরাও টুক করে, আরও কয়েকজন মেয়ের বেষ্টনীর মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা কাটাকুটি করা ব্যাঙ ওর বাক্সে ভরে, বন্ধ বাক্স আবার যত্ন করে ওর ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলাম।
আমাদের হিসেবে একটাই ভুল হয়েছিল।
সেদিন ছিলে গরমের ছুটির আগের শেষ ক্লাস। পরের ডিসেকশন ক্লাস একমাসেরও পরে। সেদিন যে দৃশ্য ও (এবং সবাই) দেখল, তাতে একাধিক জ্ঞানলোপের কেস যে ঘটেনি, আমরা ভাগ্যবান। পচে কালো হয়ে যাওয়া ব্যঙের গা বেয়ে ম্যাগট হাঁটছে (বন্ধ বাক্সে ম্যাগট কোথা থেকে এল, সেটা একটা সাইন্টিফিক প্রশ্ন হতে পারত, কিন্তু সে প্রশ্ন কেউ করেনি), গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার জোগাড়। বাধ্য হয়ে স্বার্থ বাক্সসুদ্ধ সবটাই ওয়েস্ট বিনে ফেলে এল।
আমরা (দেবদত্ত আর আমি) মন দিয়ে সেদিনের কাজ করছি। স্বার্থ আমাদের দিকে ক্ষুণ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলল, “নিশ্চয়ই তোদের কাজ! এতদিন তোরাই নিশ্চয়ই মেয়েদের বাক্সেও ব্যাঙ রাখতি…”
এই রে! এ তো বন্দুক উলটে আবার আমাদের দিকে ঘুরেছে! স্বার্থ আগে থেকেই এই ধান্দা করেছিল – নিজে ব্যাঙ রাখলেও আমাদেরই দোষী করত!
মাথায় বুদ্ধি এসে গেল। বললাম, “ব্যাটা, এতদিন মেয়েদের বাক্সে ব্যাঙ তুই-ই রাখতি। এটাও তোরই কাজ। যাতে লোকে তোকে সন্দেহ না করে, তাই নিজেই নিজের বাক্সে ব্যাঙ ভরেছিলি – শুধু ভুলে গেছিলি গরমের ছুটির কথা। বেশ হয়েছে…”
সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের প্রায় সাত আটজন মেয়ে – যারা গরমের ছুটির আগের দিন কেউ স্বার্থকে ঘিরে ছিল, আর কেউ আমাদের – হই হই করে বলে উঠল, “ঠিক, ঠিক। তুইই রেখেছিস, তুইই, তুইইইইই… এখন বেচারা অনিরুদ্ধ আর দেবদত্তকে দোষ দিচ্ছিস।”
স্বার্থ সত্যিই তখন বেচারা। আমাদের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল, কিন্তু বলার কিছু রইল না।
তবে একটা ভালো জিনিস হয়েছিল। তার পর থেকে আর কখনও কারও বাক্সে ব্যাঙ পাওয়া যায়নি।