আচ্ছা, এমন যদি হয় যে রোগীকে অপারেশন টেবিলে তোলা হল, অজ্ঞান করা হল, চামড়া কাটা হল, কিন্তু তারপরে আসল অপারেশন না করে কাটা চামড়া জুড়ে দেওয়া হল? রোগীকে বলাও হল না তাঁর অপারেশন হয়নি? আজকালকার দিন হলে নিঘঘাত খবরের কাগজে “ডাক্তার না কশাই” বলে বিশাল হেডিং হত। লোক ঠকানোর জন্য কনজিউমার কোর্টে ধরে নিয়ে যেত, টেলিভিশনের পর্দায় দেখাত, ডাক্তারবাবুর মুখ আমসি, বুম হাতে গগন ফাটাচ্ছেন অ্যাঙ্করের দল।
নাঃ, গোড়া থেকে বলি। ‘ইন্টারন্যাল ম্যামারি আর্টারি’-র নাম শুনেছেন? না শুনে থাকলেও ক্ষতি নেই। হার্টের রোগের কথা শুনেছেন তো? হার্টের যে রোগে বুকে চিনচিনে ব্যথা হয়, আর ইসিজি করে দেখা যায় হার্ট তথা হৃদযন্ত্র অক্সিজেনের অভাবে ভুগছে, সেটার কথা বলছি। আজকাল এসেছে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি। অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করলে দেখা যায় হৃদযন্ত্রকে রক্ত সরবরাহ করার ধমনীগুলো সরু হয়ে গেছে, যথেষ্ট পরিমাণে রক্ত পাঠাতে পারছে না। যদি কোনো সময়ে হৃদযন্ত্রে রক্ত সরবরাহ এতোটাই কমে যায় যে তার একটা অংশ অক্সিজেন না পেয়ে ‘মারা যায়’, তখন বুকে খুব ব্যথা হয়। ডাক্তারবাবু গম্ভীর মুখে বলেন, ‘হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, প্রাণ নিয়ে টানাটানি’।
১৯৩৯ সালে হার্ট অ্যাটাক আটকানোর জন্য একটা অপারেশন করা শুরু হল। ইন্টারন্যাল ম্যামারি আর্টারি বলে একটা ধমনী বেঁধে দিয়ে তার মধ্যে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেওয়া। এতে তেমন ক্ষতি নেই—ঠিক যেমন গল ব্লাডার আমাদের কাজের জিনিস হলেও তাকে কেটে বাদ দিলে বিশেষ ক্ষতি নেই। ডাক্তারেরা ধারণা করলেন, ইন্টারন্যাল ম্যামারি ধমনী বন্ধ করে দিলে তার রক্তের অনেকটা হৃদ-ধমনীর মধ্যে দিয়ে বইবে, হৃদযন্ত্রে যাবে। একটি নদীর দুই শাখানদীর একটি বাঁধ দিয়ে আটকে দিলে অন্য শাখাটিতে যেমন জল বেশি পরিমাণে বয়ে যায়, অনেকটা সেরকম।
অপারেশন চালু হল। বহু মানুষ জানালেন তাঁরা অপারেশনের ফলে ভাল আছেন। তাঁদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও দেখা গেল যে তাঁদের আগের মতো সহজে বুকে ব্যথা হচ্ছে না। সবাই খুশি। কিন্তু পাশ্চাত্য মেডিসিন ততদিনে নানা ভুলপথের অলিগলিতে ঠোক্কর খেয়ে শিখেছে, আপাতদৃষ্টিতে কাজ করে যা কিছু, তার সব কিছু সত্যিকারের কাজ নাও করতে পারে। তাই একটা পরীক্ষা করা হল। (১)
- কয়েকজন হৃদরোগীকে বেছে নেওয়া হল।
- তাঁদের জানানো হল, তাঁদের ইন্টারন্যাল ম্যামারি আর্টারি লাইগেশন হবে, কিন্তু এই অপারেশন কতটা কাজের তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
- পরীক্ষাটার মূল দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাঁরা রোগীদের ‘র্যান্ডম’-ভাবে দু’দলে ভাগ করে ফেললেন।(২)
- এবার অপারেশন টেবিলে রোগীকে তোলার পর সার্জেনের সামনে একটা বন্ধ খাম খুলে ধরা হল। তাতে লেখা রোগীর ‘সত্যি অপারেশন’ হবে নাকি ‘মিথ্যে অপারেশন’ হবে।
- একদল রোগীর ওপর ‘সত্যি অপারেশন’ হল—তাঁদের বুক কেটে ইন্টারন্যাল ম্যামারি ধমনী বেঁধে দেওয়া হল।
- অন্যদলের রোগীর ওপর ‘মিথ্যে অপারেশন’ হল, অর্থাৎ তাঁদের বুকের ওপর কাটাকুটি ও সেলাই করা হল ঠিকই, কিন্তু ইন্টারন্যাল ম্যামারি ধমনীকে স্পর্শ করা হল না।
- রোগীরা জানতেও পারলেন না তাঁদের ‘মিথ্যে অপারেশন’ হয়েছে; তাঁদের খাওয়া-দাওয়া-ব্যায়াম-বিশ্রাম ইত্যাদি সংক্রান্ত উপদেশ, অ্যানাস্থেসিয়া, অপারেশন, হাসপাতালে যত্ন-আত্তি এসবেতে ‘সত্যি অপারেশন’ রোগীদের সঙ্গে কোনো ফারাক রাখা হল না।
- আর রোগীর যত্ন নিচ্ছিলেন ও তাঁদের উন্নতি-অবনতি মাপছিলেন যেসব ডাক্তার, তাঁরা জানতেন না কোন রোগীর সত্যি অপারেশন আর কোন রোগীর মিথ্যে অপারেশন হয়েছে।
- অর্থাৎ রোগী যেমন তাঁর চিকিৎসা বিষয়ে অন্ধ রইলেন, ডাক্তারও তাঁর অধীনস্থ রোগীর চিকিৎসা বিষয়ে অন্ধ রইলেন। (৩)
অপারেশনের পরে রোগীদের বেশ কিছুদিন ধরে দেখা হল, প্রশ্ন করে জানা হল তাঁরা কেমন আছেন, নানা পরীক্ষা করে তাঁদের হৃদযন্ত্রের অবস্থা জানার চেষ্টা করা হল। দেখা গেল, ‘সত্যি অপারেশন’ করা হোক আর ‘মিথ্যে অপারেশন’ দুদলের রোগীর উন্নতি মোটের ওপর সমান। তার মানে অপারেশনের ফলে যা লাভ হয়েছে বলে ভাবা গেছিল সবই ভুয়ো। ১৯৩৯ সালে অপারেশন শুরু হয়েছিল, কুড়ি বছর পরে বলা হল যা করা হয়েছিল তা সব ভুল।
মুজতবা আলি মশাই বলেছিলেন না, সর্দিজ্বর চিকিৎসা না করলে সারতে সময় লাগে সাত-সাতদিন, আর চিকিৎসা করলে মাত্র এক সপ্তাহ! কিন্তু এই ইন্টারন্যাল ম্যামারি আর্টারি লাইগেশন অপারেশনটা ঠিক সে গোত্রে পড়ে না। অপারেশনের ফলে রোগীর খানিক উন্নতি হতই। সেটা হত তাঁরা হার্টের রোগের জন্য খাদ্য ও ব্যায়াম সংক্রান্ত পরামর্শ ভালভাবে মানতেন বলে—অপারেশন করাটা রোগটাকে আলাদা গুরুত্ব দিত। তাছাড়া ছিল ‘প্লাসিবো এফেক্ট’ বা রোগীতোষ ক্রিয়া।
প্লাসিবো এফেক্ট নিয়ে বলা যাবে অন্য কোনো সময়।
পাদটিকা
১। প্রকৃতপক্ষে একটি নয়, দুটি প্রায় একই রকম পরীক্ষা হয়েছিল। প্রথমটি ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন স্কুল অফ মেডিসিন, ইউএসএ—তার ফলাফল জার্নালে প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে (তথ্যসূত্র ১ দেখুন)। দ্বিতীয়টি ইউনিভার্সিটি অফ কানসাস মেডিক্যাল সেন্টার, ইউএসএ, এটির ফল প্রকাশ হয় ১৯৬০ সালে (তথ্যসূত্র ২ দেখুন)।
২। ‘র্যান্ডম’-ভাবে কথাটার এমনিতে বাংলা হল ‘এলোমেলোভাবে’, কিন্তু পরিসংখ্যানশাস্ত্রে ‘র্যান্ডম’-ভাবে কথাটার একটা বিশেষ পারিভাষিক অর্থ আছে। ‘র্যান্ডম’-ভাবে একদল রোগীকে দুটো আলাদা দলে ভাগ করার মানে হল, কোনও একজন বিশেষ রোগীর দু’দলের কোনো একটিতে যাবার সম্ভাবনা সমান। এতে সুবিধা হচ্ছে যে পরীক্ষকদের কোনও দলের ওপর যদি পক্ষপাত থাকেও, দুই দলে রোগীরা এমনভাবে ভাগ হয়ে যাবেন যে একদলে অপেক্ষাকৃত খারাপ রোগী আর অন্য দলে তুলনায় ভাল রোগী—সে রকম হবার সম্ভাবনা খুব কম। ‘র্যান্ডম’-ভাবে ভাগ করার ফলে দু’দলের সদস্যরা ছিলেন মোটামুটি একই বয়সী, এবং তাঁদের রোগ ছিল একই রকমের তীব্র।
৩। একেই বলে ‘দুই অন্ধ’ পদ্ধতি। পুরো পরীক্ষার নাম দাঁড়াল, ‘ডাবল ব্লাইন্ড র্যান্ডমাইজড প্লাসিবো কন্ট্রোলড ট্রায়াল’; সংক্ষেপে একে এখন র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়াল বা আরসিটি বলে।
চিত্র পরিচিতি (কেবলমাত্র অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য)
১। অ্যানজাইনা বা হৃদরোগের বুকে ব্যথা
২। সত্যি অপারেশন আর মিথ্যে অপারেশন করে কার্যকারিতা যাচাই করার একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ
তথ্যসূত্র
1. Cobb, L. A., Thomas, G. I., Dillard, D. H., Merendino, K. A., & Bruce, R. A. (1959). An Evaluation of Internal-Mammary-Artery Ligation by a Double-Blind Technic. New England Journal of Medicine, 260(22), 1115–1118. (https://scihub.wikicn.top/https://doi.org/10.1056/nejm195905282602204, accessed on 25 June 2020)
2. Dimond, E. G., Kittle, C. F., & Crockett, J. E. (1960). Comparison of internal mammary artery ligation and sham operation for angina pectoris. The American Journal of Cardiology, 5(4), 483–486.
(https://scihub.wikicn.top/https://doi.org/10.1016/0002-9149(60)90105-3, accessed on 25 June 2020) From the Departments of Medicine and Surgery,
3. Snake Oil Science: The Truth about Complementary and Alternative Medicine. R. Barker Bausell. Oxford University Press; 2009
ভালো লেখা।
আমাদের অজানা এরকম চিকিৎসা জগতের নানান ঘটনা গুলি যদি বলেন ভালো হয়। এই লেখাটি ভালো হয়েছে।