লকডাউনের পঞ্চমপর্বে বেশ কিছু ছাড় দেবার পর শহরের রাস্তাঘাটে জনসমাগম উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বেড়েছে, ফলে বহু মানুষকে বাস, অটো ইত্যাদি ধরার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে হাপিত্যেশ করছে। এসব ছবি দেখে আমরা অনেকেই আঁতকে উঠছি—না জানি এবার করোনার বৃদ্ধি কোথায় পৌছয়? মধ্যবিত্তরা বলছেন আরও কিছুদিন লকডাউন চালিয়ে যাওয়া দরকার। আসলে আমাদের সবার মাথায় একটা ধারণা গেঁথে দেওয়া হয়েছে তা হলো লকডাউন একটি করোনা রোগহর অব্যর্থ বটিকা, এটা লাগু রাখতেই হবে।
বৈজ্ঞানিক তথ্য হলো করোনা সংক্রমণ রোখার মূল হাতিয়ার হলো দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখা। এর সঙ্গে ঘন ঘন হাত ধোওয়া এবং বাইরে বেরলে নাকে মাস্ক আঁটা। সেই অর্থে ঘরবন্দি বিশেষ কোনো মাত্রা জোগায় না শুধুমাত্র ঐ পারস্পারিক দূরত্ব বজায় রাখার কাজটা নিশ্চিত করে।
দ্বিতীয়ত কোনো দেশের পক্ষেই অনাদিকাল জুড়ে লকডাউন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাতে বহু মানুষ অপুষ্টি, অনাহারে মারা যাবে। যে সংখ্যা করোনার কারণে মৃত্যুর সংখ্যার থেকেও বেশি হবে।
তৃতীয়ত, যাঁরা প্রতিদিনের খবরে চোখ রাখেন তাঁরা জানেন এই লকডাউনে করোনা কি হারে বাড়ছে এবং বেড়ে চলেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানেন আমাদের মতো জনবহুল শহরগুলোতে লকডাউনের প্রয়োগ পঞ্চাশ শতাংশও সম্ভব নয়। অন্যদিকে ইউরোপের যে সব শহরে লকডাউনের সফল প্রয়োগ হয়েছে সেখানেও লকডাউন রোগবিস্তারে বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। ইংল্যন্ডে সমীক্ষা অনুযায়ী সে দেশে লকডাউনের প্রয়োগ ৮০ শতাংশ সফল হলেও এখন করোনায় মৃত্যু ৫০ হাজার ছুঁই ছুঁই, তাই লকডাউন কোনো অব্যর্থ বটিকা নয়। যে সব শহরে জনবসতি ঘন যেমন নিউ ইয়র্ক নিউ জার্সি বা লন্ডন সেই সব শহরে করোনা সংক্রমণ ঐ সব দেশের অন্য শহরগুলোর তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। সেই বিচারে মুম্বাই বা কলকাতার জনঘনত্ব লন্ডনের প্রায় দ্বিগুণ। আমাদের দেশে যে রাজ্যগুলিতে জনঘনত্ব ১১০০ প্রতি বর্গ কিলোমিটারে, যেখানে করোনা সংক্রমণের হার যে রাজ্যগুলিতে জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিমিতে ৯০০-র কম সেগুলির তুলনায় প্রায় ১৯ গুণ বেশি। তাই শহরে এবং রাজ্যে করোনা ছড়াবে, বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।
লকডাউনে করোনা বিলুপ্ত হবে না। আমাদের করোনা নিয়েই ঘর করতে হবে। কিন্তু লকডাউন থাকুক বা না-থাকুক যেটা অপরিহার্য তা হলো পারস্পারিক দূরত্ব বজায় রাখা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিগুলো পালন করা এবং সেই সংস্কৃতিতে আপামর মানুষজনকে জড়িয়ে ফেলা। এখন এই কাজটাই জোরকদমে করতে হবে।
সরকারকে কিছু নিয়মনীতি বেঁধে দিতে হবে যেমন আগামী একবছর কোনো সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক অনুষ্ঠান না করা বা সেসব ক্ষেত্রে জনসমাগম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যা কখনোই পঞ্চাশের ওপরে না ওঠে। এ কাজটা সরকার পুলিশ প্রশাসন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
কিন্তু পাশাপাশি যেটা খুব জরুরি তা হলো মানুষের ব্যবহারবিধিতে পরিবর্তন আনা এবং নতুন কর্মসংস্কৃতির জন্ম দেওয়া, যাতে মানুষের রুটি রুজিতে আঘাত না-আসে আবার করোনা রোগেরও প্রসার না ঘটে। সমস্যাটা কঠিন ও জটিল বিশেষ করে আমাদের দেশের শহরগুলোয় যেখানে ঘন জনবসতির কারণে বাসস্থান, হাটবাজার, রাস্তাঘাট তথা কর্মস্থানে পর্যাপ্ত জায়গার অভাব রয়েছে।
ম্যাকেঞ্জি ফার্মের হিসেব মতো এদেশের বড় ও মাঝারি মাপের ৫৪টা শহর দেশের মোট জিডিপির চল্লিশ শতাংশের বেশি জোগান দেয়। মানুষের রুটি-রুজির কারণে শহর চালু রাখতে হবে।মুখ্যমন্ত্রীর হাতে আলাদিনের প্রদীপ নেই যার এক ছোঁয়ায় মুহূর্তে শহরের জায়গাগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কয়েক গুণ করে দিতে পারেন। তাই এই অবস্থার মধ্যেই সমাধানের রাস্তা খুঁজতে হবে। ইউরোপ, আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকলে কিংবা তাদের নিয়মনীতির ‘কপি পেস্ট’ করে কাজ হবে না। হাটবাজার, কর্মস্থানে জায়গায় অভাব মেটাতে এই সমস্ত ক্ষেত্রে কাজের সময়কাল বাড়াতে হবে। ঐসব কাজ কয়েক সিফটে চালাতে হবে – যাতে কাজের সময় দুজন কর্মীর মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখা যায়। কলকারখানায়ও একই নীতিতে কাজের নতুন পদ্ধতি প্রকরণ সেই সব সংস্থার মালিক এবং কর্মীরা যৌথভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তৈরি করতে পারেন।
যাঁরা বাড়িতে বসে কাজ করতে পারেন সে সুযোগ গড়ে দিতে হবে পাশাপাশি আমাদের দেশে অসংগঠিত শ্রমে যুক্ত যেমন নির্মাণকর্মী, তাঁত, কুটির ও নানান হস্তশিল্পেযুক্ত কর্মীদের ক্ষেত্রেও একইভাবে নতুন কর্মসংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। এই সব ক্ষেত্রে কাজের প্রচলিত সময়সীমায় বদল আনতে হবে। বিষয়টা সময় এবং পরিসর (টাইম এবং স্পেসের)-এর নিরিখে সাজাতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই। সমস্ত কর্মক্ষেত্রে মাস্ক পরা এবং সাবান/স্যানিটাইজার-এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক হবে।
এসব পরিবর্তন ঘটানোর ফলে শহরগুলোতে কাজের সময় শুধু দিনের বেলায় আটকে না থেকে দিনরাত জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে এবং সেই অনুযায়ী রাস্তাঘাট এবং দিনরাত জুড়ে যানবাহন চলাচলের বিধিব্যবস্থা চালু রাখতে হবে কারণ শহর তখন সারা দিনরাত জুড়ে জেগে রইবে।
এই পরিবর্তনের ফলে যানবাহনে যাত্রীদের গাদাগাদি কমানো যাবে ফলে করোনা সংক্রমণে বাধা পড়বে। শহরে সাইকেলের ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি মূল রাস্তার পাশে সাইকেল চালানোর জন্য রাস্তা নির্দিষ্ট করতে হবে। সমস্ত ধরণের যানবাহনে ওঠা নামার রাস্তায় মাস্ক, স্যানিটাইজারের ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং থার্মাল গানের ব্যবহার শুরু করতে হবে।
লকডাউনের সময় আইন করে বাজারহাট দোকানপাট খোলা রাখার সময়কাল সংকুচিত করা হয়েছিল, যেটা মারাত্মক রকমের ভুল সিদ্ধান্ত। মানুষ তার প্রয়োজনেই হাটবাজারে যায় তা সে সবজি বাজার, ভূষিমাল বা মিষ্টির দোকান যাই হোক না কেন, এই সব বাজার ও দোকানপাট দীর্ঘকাল খুলে রাখাটা শুধু যৌক্তিক নয়, বাস্তবসম্মত বটে। এতে ক্রেতাদের সুবিধা হবে তথা করোনার জন্য পারস্পারিক দূরত্ব বজায় রাখা অনেক সহজ হবে। এ শহরে লক্ষাধিক বিক্রেতা সবজি থেকে শুরু করে নানান দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি করে পরিবার প্রতিপালন করেন তাঁরা হঠাৎ করে কর্মহীন হবেন না দিনরাত ভাগাভাগি করে বিক্রিবাটা করবেন। তাঁদেরকে করোনা সংক্রমণ রোধের ভূমিকায় উৎসাহিত করা যাবে।
সন্ধ্যে থেকে সকাল কার্ফু জারি করার মতো আত্মঘাতী নিয়ম-নীতি থেকে সরকার বাহাদুর যত দ্রুত সরে আসেন ততই মঙ্গল। এর মাধ্যমে আর যাই হোক করোনা নিয়ন্ত্রণ হয় না।করোনা নিয়ন্ত্রণের নামে লকডাউন, কার্ফু ইত্যাদি প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কার্যত আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রকল্পে পর্যবসিত করেছেন। এদেশের প্রায় সব সরকারের পছন্দের জায়গা হলো পুলিশ-প্রশাসনের মাধ্যমে সব কিছুর সমাধান খুঁজে বেড়ানো। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে কোনো স্বাস্থ্য প্রকল্প সাফল্য পায় নি, পাওয়া সম্ভবও নয়। করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য মানুষের স্বাস্থ্য ও ব্যবহারবিধির পরিবর্তনের রাস্তায় হাঁটতে হবে, যেখানে ধৈর্য্য ও সহনশীলতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়এবং তা সাধারণ মানুষকে যুক্ত করেই করতে হবে। ওপর থেকে পুলিশ প্রশাসন দিয়ে চাপিয়ে দিলে হবে না।
এইচআইভি নিয়ন্ত্রণে এদেশের সাফল্য আজ সারা বিশ্বে বন্দিত হয়, এই রাজ্যের যৌনকর্মীরা সোনাগাছিতে রোগ নিয়ন্ত্রণের যে রাস্তা দেখিয়েছিলেন তা শুধু এ দেশে নয়, সারা পৃথিবীই এই রাস্তা ধরেই আজ এডস নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প রূপায়ণ করছে। সমস্ত ইউএন সংস্থা ও বড় বড় দাতা সংস্থা সোনাগাছি মডেলকে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। করোনার সঙ্গে এইচআইভি-র মিল হলো যে, এই দুটো রোগের নিয়ন্ত্রণ লুকিয়ে রয়েছে মানুষের ব্যবহারবিধি পালটানোর বিজ্ঞান ও তার প্রয়োগের রাস্তায়। সম্প্রতি ইউএন সংস্থা কোভিড নিয়ন্ত্রণের দিকনির্দেশিকায় জনগোষ্ঠী ও তাদের সংগঠনগুলিকে এই কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে জোর দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন কোভিড নিয়ন্ত্রণে সীমান্তবর্তী মানুষদের যত বেশি যুক্ত করা যায়, তা সে গ্রাম, ব্লক এবং শহরে, সেই অনুযায়ী সরকারকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে।
মানুষের ব্যবহারবিধি পাল্টানোর প্রথম পাঠ শুরু হয় আমজনতা ও তার সুবিধা-অসুবিধার জায়গাটা বুঝে এবং তার প্রয়োজনকে সম্মান জানিয়ে। গরিব-অশক্ত মানুষেরা শুধু রোগেই ভোগেন না, তাঁরা যে রোগ নিয়ন্ত্রণের কান্ডারী হতে পারেন তা সে যৌনকর্মী থেকে শুরু করে ট্রান্সজেন্ডার, ট্রাক ড্রাইভার কিংবা পরিযায়ী শ্রমিক এবং এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিরা সকলের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের ভূমিকা আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত।
আজকে এদেশে তথা এ রাজ্যে বস্তিবাসী কিংবা অসংগঠিত শ্রমে যুক্ত এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের সেই রাস্তা ধরে কোভিড নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায় তুলে আনতে হবে। কোভিড নিয়ে যে ঘৃণা আর বিদ্বেষের পরিবেশ গড়ে উঠেছে তা দ্রুত বদলাতে হবে। এই কাজ এ রাজ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ক্লাব ও বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলি যাঁদের অনেকেই বছর বছর সরকারি বদান্যতা পেয়ে থাকেন স্পোর্টস বা অন্যান্য কাজের জন্য, তাঁদেরকে যুক্ত করতে হবে। কোভিড নিয়ন্ত্রণের সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে সরকারকে সদর্থক ভূমিকা নিতে হবে। বিভিন্ন শ্রমে যুক্ত মানুষদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে স্ব-স্ব জায়গায় রোগ নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায় যুক্ত করতে হবে। তাঁদেরকে দুর্বল আর ভিখিরি বানিয়ে রেখে সমস্যর সুরাহা হবে না, প্রয়োজন তাঁদের হাত শক্ত করা।
জনসাধারণকে করোনা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় বসানো গেলে রোগ নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সাফল্য তথা সমৃদ্ধি আসবে। করোনা নিয়ন্ত্রণ আর রোজগারের রাস্তাকে একই সুতোয় বাঁধতে হবে। তৈরি করতে হবে এক নতুন কর্ম-সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা। এভাবেই গড়ে উঠতে পারে এক নতুন বাংলা আর সেখানেই জড়িয়ে রয়েছে আমাদের উন্নয়ন, আমাদের ভবিষ্যৎ।
স্মরজিৎ জানা, মহামারী বিশেষজ্ঞ, আইসিএমআর-এর জাতীয় করোনা প্রতিরোধ টাস্ক ফোর্স-এর সদস্য।
সময়ূপযোগী দারুন লেখা। আমদের দেশে এই রকম অতিমারীর সময় গঠিত কোনো কমিটিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কে রাখতে নেই।