১৯৮১ সালে প্রথমবার, বিনা পরিচয়ে এবং বিনা আমন্ত্রণে আমি দল্লী-রাজহরা যাই। নিয়োগীজী তখন জেলে। তাসত্ত্বেও জনকলাল ঠাকুর, জি এম আনসার এবং অন্যান্য কর্মীরা আমায় সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ছিলেন। নিয়োগীজীর অনুপস্থিতিতে আমি সেখানকার কর্মীদের সাথে আমার স্বপ্নের স্বাস্থ্যপরিষেবা কর্মসূচী নিয়ে কথাবার্তা বলি। চার কি পাঁচ দিন পর আমি কলকাতা ফিরে যাওয়া মনস্থ করলাম। কারণ আমার মনে হয়েছিল স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে আমার কাজ করার যা স্বপ্ন তা নিয়োগীজীর সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ আলোচনা ছাড়া কখনই বাস্তবায়িত হবে না।
জনকলালজী ইউনিয়নের ড্রাইভার শ্যামলালকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে দুর্গ স্টেশনে আমায় পৌছে দিতে বললেন। আমরা নির্ধারিত সময়ের দু’ঘন্টা আগে দুর্গে স্টেশনে পৌছে গেলাম। খালি সময়টুকু কাটানোর জন্য শ্যামলাল আমাকে কাছাকাছি একটি কর্মীসভায় উপস্থিত থাকার পরামর্শ দিলো।
নিয়োগীজীর সেই সময়ের সাথী, কমরেড কুরিয়েন সভা পরিচালনা করছিলেন। সভা চলাকালীন দেখলাম নিয়োগীজী একটি জিপ থেকে নেমে এলেন। শুনলাম সেই দিনই তিনি ছাড়া পেয়েছেন। যখন নিয়োগীজী জানতে পারলেন আমি একজন ডাক্তার এবং কলকাতা থেকে তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছি, তিনি কুরিয়েনকে বললেন ভিলাইয়ে তাঁর (কুরিয়েনের) স্ত্রীর কোয়ার্টারে নিয়োগীজীর সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যেতে।
একটি বড়সড় কোয়ার্টার। আমরা হাতমুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হওয়ার পর মহার্ঘ ভোজন সেরে নিলাম—আমি মালায়লী পদ্ধতিতে রাঁধা গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেলাম এবং নিয়োগীজী নিরামিষ তরকারি দিয়ে ভাত খেলেন। তিনি কখনই গরু কিম্বা শুয়োর চেখে দেখেন নি।
খাওয়াদাওয়ার পর আমরা দুজন একটি আলাদা ঘরে বসে আমরা স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। নিয়োগীজী বললেন যখন আমরা দু’জনই কেবল আছি, তখন বাংলায় কথা বলতে পারি । অ-বঙ্গভাষীদের উপস্থিতিতে উনি কখনই বাংলা বলতেন না। কিছুক্ষন আলোচনার পর নিয়োগীজী বললেন—ডাক্তার সাহেব আজ আপনার কলকাতা যাওয়া হচ্ছে না। চলুন আমরা দল্লী-রাজহরাতে ফিরে যাই।
অগত্যা আমি নিয়োগীজীর সাথে আবার দল্লী-রাজহরায় ফিরে গেলাম। অন্যান্য কর্মীদের মতো, ইউনিয়ন অফিসের পাশে এক শ্রমিক মহল্লায় মাটির বাড়িতে সপরিবারে নিয়োগীজী থাকতেন। তাঁর স্ত্রী আশা এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং এক কাপ চিনি দেওয়া কালো চা দিয়ে তাঁরা আমায় অভ্যর্থনা জানালো।
নিয়োগীজী আমায় বললেন—সন্ধ্যায় আমরা এই মহল্লারই এক শ্রমিকের বাড়িতে বিয়ের আসরে যাবো। আমি এই ধরণের আসরে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তেমন উৎসাহ পাই না, কিন্তু ছত্তিশগড়ী বিয়ে দেখার অভিজ্ঞতা না থাকায় তাঁর সাথে যেতে রাজী হয়ে গেলাম। তখন চারিদিকে বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে।
বিয়ের আসর বেশ জমে উঠেছে। ছত্তিশগড়ী বিয়েতে কনে পক্ষ এবং বর পক্ষের মাঝে সাজানো লড়াই হয়, নকল যুদ্ধ এবং তার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা একে অন্যের বিপক্ষে চোখাচখি খিস্তি খেউর বর্ষণ করতে থাকে। তাই চলছিল। কিছুক্ষন পর সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে একঘেয়ে ক্লান্তিকর লাগতে লাগলো। হঠাৎ পাশে চেয়ে দেখি নিয়োগীজী নেই, কখন যে উঠে চলে গেছেন টের পাইনি। আমিও উঠে পড়লাম এবং নিয়োগীজীর বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।
দল্লী-রাজহরায় শ্রমিকদের বাড়িতে তালা লাগাবার কোনও রেওয়াজ ছিলনা। আমি দরজায় আস্তে ঠেলা দিয়ে উঠোনে পা রাখতেই দেখি বারান্দার একপাশে নিয়োগীজী ও তাঁর স্ত্রী পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনরত। অত্যন্ত সহজাত মানবিক আবেগের বর্হিপ্রকাশ। মনে রাখতে হবে দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর সদ্য ঘরে ফিরেছেন নিয়োগীজী। আমাকে দেখেই চকিতে ছিটকে সরে গেলেন তাঁরা। কিন্তু সেই এক লহমার দৃশ্য আমার মনে গভীরভাবে গেঁথে রইল।
কেরোসিন ল্যাম্পের আলোয়, মাটিতে বসে ভাত, ডাল এবং তরকারী দিয়ে আমরা রাতের খাওয়া সারলাম। চেটেপুটে খেয়ে থালা একেবারে ঝাঁ চকচকে করে তার উপরেই হাত ধুলাম, উদ্দেশ্য হাতধোয়া জলে থালাটিকেও প্রাথমিকভাবে ধুয়ে ফেলা। তারপর রান্নাঘরের লাগোয়া বাগানে আমরা মুখ ধুলাম, যাতে গাছ জল পায়। এভাবেই দল্লী—রাজহরায় দুর্মূল্য জলকে আমরা ছোট ছোট উপযোগী কাজে ব্যবহার করতাম।
আমি বারান্দায় একটি খাটে শুলাম, স্থানীয় ভাষায় যাকে খাটিয়া বা চারপাই বলে। আমি ছয়ফুট থেকে সামান্য লম্বা আর চারপাইটি কোনোমতেই পাঁচফুটের বেশী নয়। সুতরাং আমার অর্ধেক পা বাইরে ঝুলে থাকলো। নিয়োগীজী আমার মতই লম্বা এবং তিনিও আমার মতই এক চারপাইয়ে শুলেন। পরের দিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, আরেকটু বড় খাট তৈরী করে নেননি কেন? তিনি বললেন—ভেবেছেন করাবেন, হয়ে ওঠেনি। পরে তিনি নিজের জন্য একটি বড় চারপাই-এর ব্যবস্থা করেছিলেন।
সকালে আমি ঘুম ভাঙ্গতে দেখি, বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী জড়ো হয়ে উঠোনে বসে আছে। নিয়োগীজী তাদের অপেক্ষা করতে বলে এক লৌটা জল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। কেউ কেউ তাঁর সাথে চলল একই সঙ্গে, তাদের সমস্যা এবং অসন্তোষ নিয়ে আলোচনা সেরে নিতে।
যখন আমরা দুজনে থাকতাম তিনি আমাকেও তাঁর সাথে প্রাতঃকৃত্য সারতে মাঠে যেতে বলতেন। মানুষের এই সর্বক্ষণ তাঁকে সঙ্গ দেওয়া আমার কাছে বিরক্তিকর লাগত। পরে তাঁর কথায় এক কন্ট্রাক্টর খুশী হয়ে ডাক্তারসাহেবের প্রত্যহ প্রাত্যহিক শৌচকর্মের জন্য টয়লেটের তালা খুলে দিত।
আমি নিয়োগীজীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম—কেন শ্রমিকেরা নিজেদের টয়লেট নিজেরা বানিয়ে নেয় না। তিনি বলেছিলেন—আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের বিশ্বাস যে ঘরের চৌহদ্দি কিম্বা আসেপাশে শৌচ করা অপবিত্র এবং নোংরা কাজ। কিন্তু আমাদের এই বিশ্বাস ভাঙ্গতে হবে। মাঠঘাট ক্রমশ কমে আসছে, বিশেষ করে মহিলারা খুব অসুবিধায় পড়ে।
বেশ কয়েক বছর লেগেছিল এই বিশ্বাস ভাঙ্গতে। প্রথমে ইউনিয়ন অফিসে একটি টয়লেট তৈরী হলো, অতিথিরা এবং আমাদের মতো মানুষের সেই টয়লেট ব্যবহার করতো।
নিয়োগীজীর পরামর্শে ইউনিয়ন পরিচালিত স্কুলগুলি নিজেদের টয়লেট বানালো, যাতে কমবয়েসেই ছাত্রছাত্রীরা টয়লেট ব্যবহারের অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, পরে তাদের মা-বাবারাও যাতে তাদের অনুসরণ করতে পারে, শেষে এই উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল।
শহীদ হাসপাতালের শুরুর দিকে নিয়োগীজীকে নিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে আছে। নিয়োগীজীর সাত কি আট বছর বয়সের ছেলে জিৎ-এর একটি ছোটখাট অস্ত্রোপচারের দরকার হয়ে পড়ে। নিয়োগীজী জেদ ধরলেন তিনি অপারেশন থিয়েটারে উপস্থিত থাকবেন।
বাচ্চা বলে জেনারেল অ্যানাস্থেসিয়া প্রয়োজন ছিল। জেনারেল অ্যানাস্থেসিয়া মানে হলো রুগীকে ইথার প্রয়োগ করে অচেতন করা। দুই তিনজন মানুষ রুগীকে বিছানায় চেপে ধরে থাকবে যাতে ছটফট না করে এবং অ্যানেস্থেটিস্ট মাস্কের মধ্য দিয়ে মুখে ইথার দেবে। এক্ষেত্রে শৈবাল (ডাঃ শৈবাল জানা) অ্যানেস্থেটিস্ট, দুজন স্বাস্থ্যকর্মী তৈরী জিৎকে ঠেসে ধরার জন্য আর আমি সার্জন।
যেমন স্বভাবত হয়ে থাকে, জিৎ প্রথমে ভয়ানক ধ্বস্তাধস্তি শুরু করল, তারপর ইথারের প্রভাবে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ নেতিয়ে পড়ল।
এক কোনায় দাঁড়িয়ে নিয়োগীজী ঘামতে শুরু করলেন, তাঁর চোয়ালে চোয়াল আটকে গেল।
সবে আমি সার্জারি শুরু করেছি, একটি শিরা কাটতেই রক্ত চলকে বেরিয়ে এলো। রক্তপ্রবাহ বন্ধ করার জন্য আর্টারি ক্ল্যাম্প লাগাবার আগেই বিশাল এক পতনের শব্দ শুনলাম। নিয়োগীজী তাঁর ছয়ফুট দেহ নিয়ে মেঝের উপর অচৈতন্য হয়ে ধপাস করে পড়ে গেছেন। রক্তপাত দেখে তাঁর মাথা ঘুরে গেছে অর্থাৎ Vaso-vagal attack হয়েছে। কিছু স্বাস্থ্যকর্মী স্ট্রেচারে করে তাঁকে তুলে বাইরে নিয়ে গেল।
আধঘন্টার পর সার্জারি শেষে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে দেখি, নিয়োগীজী নিজেকে সামলে নিয়েছেন, বারন্দার একপাশে পায়চারি করছেন। আমায় দেখতে পেয়েই বলে উঠলেন—তোমরা ডাক্তাররা মোটেই স্বাভাবিক মানুষ নও।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: পূর্ণেন্দু শেখর মিত্র
সাক্ষাৎকারের এমন বিবরণ মনে রাখার মত। অশেষ ধন্যবাদ আশিস ডাক্তারকে এই কাহিনীটি শোনাবার জন্য।