একটা বেঞ্চে ধরুন পাশাপাশি বসে আছে ওরা। পেশেন্ট নম্বর এক। মহিলা মাঝবয়সী, মাছের বাজারে প্রতি সপ্তাহেই দেখেন। সামান্য পয়সার বিনিময়ে মাছ কেটে কুটে দেন। সেটাই পেশা। মাছ কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলে ফিনকি দিয়ে রক্ত। জল দিয়ে ধোয়ার পরে রুমাল বের করে বেঁধে দিলেন। মাছের বাজারে ফার্স্ট এইড আর কি বা হবে। হাসপাতালে যেতে বললেন। সেলাই লাগবে। মহিলার দু চোখ দিয়ে অঝোরে জলের ধারা। কেন মাসি কাঁদছো কেন। খুব ব্যথা ? ব্যাথা নয় বাবু। সেলাই মানেই তো সাত দিন কাজ বন্ধ। রোজগার বন্ধ। খাবো কি ?
পেশেন্ট নম্বর দুই। বছর দশেক এর একটি বালিকা। বেআইনি বাজি কারখানায় ততোধিক বেআইনি বাজি বানাতে গিয়ে মুখের ওপরেই ফেটেছে। চোখ মুখ আগুনে ঝলসে গেছে। পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। চোখটা বোধ হয় বাঁচবে না। সঙ্গে আসা স্বামী পরিত্যক্ত মায়ের আরো বড় চিন্তা, পরিবারে রোজগারের একটা লোক কমে গেল।
বেঞ্চে বসে থাকা তিন নম্বর। সতেরো আঠেরো বছরের কিশোর। গ্যারেজে কাজ করে। হেড মিস্ত্রির হেল্পার। কালি ঝুলি মাখা কিশোরটি কে সেই নিয়ে এসেছে। গাড়ির তলায় শুয়ে কাজ করছিল। জ্যাক উল্টে গিয়ে গোটা গাড়িটা তার সমস্ত ওজন নিয়ে পায়ের ওপরে পড়েছে। দুটো পাই বিশ্রী রকম থেঁতলে গেছে। একটা পা সম্ভবতঃ এমপুট করতে হবে। হেড মিস্ত্রির আকুল জিজ্ঞাসা, পা টা কোনভাবেই বাঁচানো যাবে না ডাক্তারবাবু ? পা চলে যাওয়া মানে তো বেকার হয়ে যাবে আবার।
পেশেন্ট নম্বর চার। চব্বিশ পঁচিশ এর যুবক। এ কাঁদছে না। ক্লান্ত দেহটা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। জন্ডিস হয়েছে, আমাদের ভাষায় ইনফেক্টিভ হেপাটাইটিস। অন্ততঃ একমাস বিশ্রাম নিতে হবে এই পরার্মশ শুনে একটু বাদেই ছেলেটার মুখ থমথমে হয়ে যাবে। কেনরে ছেলে ? বিএ পরীক্ষা দেব ডাক্তারবাবু। অভাবের সংসারে একটা সাইকেল নিয়ে। বিশ্রাম মানে কাজটাই চলে যাবে। শুধু রোজগার না। পড়বো কি করে ?
বেঞ্চের পাঁচ নম্বর ব্যক্তি মাঝবয়সী লোক। চিন্তা ভাবনায় বয়সের থেকে বেশি বুড়ো লাগছে। টিবি রোগ ধরা পরতে শপিং মলের সেলস ক্লার্ক এর চাকরিটা গেছে। দু মাস তো ওষুধ খেলাম ডাক্তারবাবু। আমার অসুখটা কি এখনো ছোঁয়াচে ? একবারটি লিখে দেবেন আমি সেরে গেছি। যদি চাকরিটা আবার ফিরে পাই ?
হাসপাতালের আউটডোর/এমার্জেন্সির বেঞ্চে বসা কয়েকটা লোক। মানুষ। পেশেন্ট আমাদের কাছে। আসলে এক টুকরো বাংলা। ডাক্তারের অপেক্ষায় আছে। কখন সেই ধন্বন্তরীর দেখা পাওয়া যাবে। যিনি দেখা দিলেই সব ভালো হয়ে যাবে। ঠিক হয়ে যাবে।
তাড়াতাড়ি ঠিক করে দিতেই হবে এদেরকে। দুদিন বাদেই ভোট। এরা ভোট দেবে। তাই ওষুধ খুঁজি। কোনো ডাক্তারি বই এ হদিস পাই না। হতাশ ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তখন মনে পড়ে লেটেস্ট ওষুধ নিয়ে হাজির হওয়া ফেরিওয়ালার কথা। সর্বরোগহর আশ্চর্য ওষুধ যার নাম “উন্নয়ন”। টিভিতে রোজ দুবেলা দেখায়। তাই কাউকে লাগাতে শুরু করি উন্নয়ন এর ইনজেকশন। কাউকে ব্যান্ডেজ এর সাথে জড়িয়ে মাখিয়ে দেবো উন্নয়ন। কেউ দিনে তিনবার করে খাওয়ার আগে এক গ্লাস জল দিয়ে গিলবে উন্নয়ন। সব্বাই লাইনে দাঁড়ানোর জন্য ফিট হয়ে যাবে। আশেপাশের লোক টেরই পাবে না যে তার সাথে একই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে এরা।
এদের একজনও যদি সেদিন লাইনে দাঁড়াতে না পারে, জবাব চাইবো সর্বরোগহর সেই উন্নয়নের বড়ি বিক্রি করতে আসা ফেরিওয়ালার কাছে। লজ্জা করে না তোমার ? ধাপ্পাবাজ ? কাজ করে না এমন ওষুধ বেচতে এসেছ ? আমি একা নই, প্রতিটা কাটা হাত, পোড়া মুখ, ভাঙা পা, বেড়ে যাওয়া লিভার, ফোপরা ফুসফুস জবাব চাইবে। জবাব তোমায় দিতেই হবে সেদিন।