কাকুর দোকানে বড় শান্তিতে রোগী দেখছিলাম। সাধারণত আমাদের মত খুপরিজীবি চিকিৎসকদের ভাগ্যে এতোটা শান্তি জোটেনা। রোগীরা পরপর আসছেন। সকলেরই সুগার প্রেশার কন্ট্রোলে। এক ভদ্রলোকের তেরোদিন ধরে জ্বর কিছুতেই কমছিল না। আমি ভয়ানক ভয়ানক ডিফারেন্সিয়াল ডায়াগনোসিসের কথা ভেবেছিলাম। তাঁরও তিনদিন ধরে জ্বর আসছে না। এখন তিনি কুঁচকির দাদ নিয়ে চিন্তিত।
ইদানীং যাঁদের বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে ষাট বছরের মধ্যে এবং যাঁদের সুগার, প্রেশার, হার্টের অসুখ ইত্যাদি আছে তাঁরা কোভিড ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য এক বিচিত্র ফর্ম ভরতে দলে দলে আসছেন। জিনিসটা বেশ বিরক্তিকর। আশ্চর্যের বিষয় আজ তাঁরা এখনও একজনও আসেননি।
এতো শান্তিতে রোগী দেখতে দেখতে আমার ঝিমুনি আসছিল। মাস্কের আড়ালে ঘন ঘন হাই তুলছিলাম। সেই সাড়ে পাঁচটায় উঠেছি। আজ আবার ভোর বেলায় মেডিকেল ক্যাম্প ছিল। তখন থেকে রোগী দেখেই যাচ্ছি। এখন সন্ধ্যা ছটা বাজে। আর কয়েক ঘণ্টা টেনে দিতে পারলেই আজকের মতো ছুটি। কিন্তু সেটুকু সময় সজাগ থাকতে হবে। রোগীর সামনে ঘুমিয়ে পড়লে কেলেঙ্কারি হবে।
তবে কাজের সময় ঘুম মানেই কেলেঙ্কারি নয়। এটা যে কখনও কখনও বেশ উপকারী হতে পারে সে ব্যাপারে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে।
এমবিবিএস পড়ার সময় দ্বিতীয় বর্ষে ফরেনসিক মেডিসিন বলে একটি সাবজেক্ট ছিল। তাতে নানারকম মেডিকো-লিগ্যাল ব্যাপার স্যাপার ছিল। তাছাড়া বিভিন্ন আইনের ধারা, উপধারা পড়তে হতো। সেই বিষয়ে মেডিকেল কলেজের ইন্টারনাল পরীক্ষার ভাইভা দিতে ঢুকেছি। যিনি পরীক্ষা নিচ্ছেন তাঁর নামে সেসময় কলকাতা পুলিশের বড়কর্তারা ঘাবড়ে যেতেন। ফলে আমার অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
আমার আগের মেয়েটি বিরস বদনে স্যারের ঘর থেকে বেরোতেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিরে কেমন?’
‘যা, গেলেই বুঝতে পারবি। হেব্বি চাটছেন।’
আমার হৃদগতি বেড়ে গেল। সহপাঠিনীটি ইংলিশ মিডিয়ামের এবং অত্যন্ত গাঁতু। তার যদি এমন কাঁদো কাঁদো অবস্থা হয়, তাহলে আমার স্যারের ঘরে ঢোকার আগেই কান্না শুরু করা উচিৎ।
শহীদ যখন হতেই হবে বুক চিতিয়ে হব। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম। স্যার একটা শ্বেত পাথরের টেবিলের একপাশে বসে আছেন। আমি অন্যপাশে বসলাম। স্যার নাম রোল নাম্বার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর বললেন, ‘টেল মি দ্যা ডিফারেন্স বিটুইন আন্টিমর্টেম হ্যাংগিং এণ্ড পোস্টমর্টেম হ্যাংগিং।’
আমি প্রাণপণে উত্তর সাজাচ্ছি। কী দেখে বোঝা যাবে মৃত ব্যক্তি নিজেই গলায় দড়ি দিয়েছে না কেউ তাকে মেরে টানিয়ে দিয়েছে? কী দেখে… মিন মিন করে বলার চেষ্টা করলাম, ‘ইন কেস অফ এন্টিমর্টেম হ্যাংগিং রোপ ফাইবার মে বি ফাউন্ড ইন দ্য হ্যান্ড অফ ভিক্টিম বাট…’
এই অব্ধি বলে থেমে গেলাম। কারণ ততোক্ষণে আমি একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেয়েছি। শব্দটা স্যারের নাক থেকে আসছে। স্যারের মাথা টেবিলে ঝুঁকে পড়েছে এবং তিনি মধুর স্বরে নাক ডাকছেন।
বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিৎ। দেওয়ালে বিভিন্ন সময়ের বিভাগীয় প্রধানদের ছবি টানানো। সেইগুলোই মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করলাম। সেগুলোও দেখা হয়ে গেল। তারপর আক্ষরিক অর্থেই ঘরের উঁচু ছাদের কড়িকাঠ গুনতে শুরু করলাম।
টিকটিক করে ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলেছে। চার মিনিট… পাঁচ মিনিট…দশ মিনিট… কুড়ি মিনিট… হঠাৎ শ্বেত পাথরের টেবিলে রাখা ফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল। স্যার ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসলেন। ফোন ধরে কাউকে বিষম ধমকালেন। তারপর আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই এখানে বসে কী করছিস?’
‘স্যার পরীক্ষা দিচ্ছি।’
‘তোকে প্রশ্ন করেছি?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘উত্তর দিয়েছিস?’
ইতস্তত করে বললাম, ‘হ্যাঁ স্যার।’
‘তাহলে বসে আছিস কেন, পালা।’
দম বন্ধ করে ঘরের বাইরে বেরোতেই সবাই আমায় ছেঁকে ধরল। ‘বাপরে, কতক্ষণ ধরে পরীক্ষা দিলি! নিশ্চয়ই হেব্বি দিলি। স্যার কী কী প্রশ্ন করলেন?’
তবে স্যার নিজের ছাত্রদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। ডাক্তারি জীবনের একেবারে শুরুতেই সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতালে এক ঘোরতর ঝামেলায় ফেঁসে গেছিলাম। প্রায় প্রাণ সংশয় হয়েছিল। সেদিন স্যারকে ফোন করায় তিনি যেভাবে তাঁর এই অত্যন্ত সাধারণ ছাত্রটিকে সাহায্য করেছিলেন, কোনোদিনও ভুলব না। সে গল্প আরেকদিন হবে। চেম্বারের গল্প শুরু করে ক্রমশ খেই হারিয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছি।
মোদ্দা কথা সেদিন স্যারের ঘুম আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমি ঘুমিয়ে পড়লে রোগীরা মোটেই খুশি হবেন না। তাও ভাগ্য ভালো, মাস্ক থাকায় রোগীরা আমার বিশাল বিশাল হাইগুলো চাক্ষুষ করতে পারছেন না।
হঠাৎ বাইরে হইচই। সঞ্জয়দা ও কাকুর সাথে কারও ঝামেলা লেগেছে। যাক, এসময় একটা ছোটো খাটো ঝামেলা হলে মন্দ হয়না। ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে যাবে।
কিন্তু ঝামেলাটা ক্রমশ ডালপালা মেলছে। আরও দু’চারজনের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। রোগী দেখায় মনসংযোগ করতে পারছি না।
একটু নাক গলানোর দরকার। দরজা ফাঁক করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হয়েছে? সবাই মিলে এতো চিৎকার করলে রোগী দেখবো কী করে?’
একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা হাউমাউ করে বললেন, ‘দেখুন ডাক্তারবাবু, আমার চার নম্বরে নাম লেখা। আপনার অ্যাসিস্টেন্ট বলছে আমার সবার শেষে হবে!’
সঞ্জয়দাও গলার জোরে কম যায় না। বলল, ‘আপনার আসার কথা পাঁচটায়। আপনি যদি ছটার সময় আসেন তাহলে সবার শেষেই হবে। এখন চৌদ্দ নম্বর চলছে।’
‘সকালে নাম লেখার সময় এই ভদ্রলোক বলেননি কেন পাঁচটার সময় আসতে হবে?’
কাকু নাম লিখেছে। কাকু বলল, ‘একেবারে মিথ্যা কথা বলবেন না। নাম লেখার সময়েই বলেছি ডাক্তারবাবু পাঁচটায় আসবেন।’
ভদ্রমহিলা এবারে গলা আরও চড়ালেন। ‘হ্যাঁ বলেছেন। কিন্তু তাতে হয়েছেটা কী। আমি অনেক ডাক্তার গুলে খেয়েছি। সব জায়গাতেই ডাক্তারবাবুরা এক থেকে দেড় ঘণ্টা দেরীতে ঢোকেন। উনি যে সময়মতো আসবেন আমি জানবো কী করে? সেটাও আপনার বলা উচিৎ ছিল।’
সঞ্জয়দা বলল, ‘সবাই জানে ইনি একেবারে সময়ে আসেন, আর আপনি জানেন না।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘ইনি সময়ে আসেন কী আসেন না, সেটা সকলকে জানতেই হবে এ কেমন কথা!’
এতো মহা মুশকিল। সময়ে আসার জন্যও যে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে কোনদিন ভাবিনি। বললাম, ‘শোনেন, এনারা সবাই ভুল কথা বলছে। ডা. ভৌমিক মোটেই সময় মতো আসেন না। এক দেড় ঘণ্টা নয়, ইনি প্রায় দু ঘণ্টা লেট করে আসেন। আপনার ডাক্তারবাবুর ঢুকতে ঢুকতে প্রায় সাতটা হবে। ঢুকলেই আপনাকে দেখে দেবেন।’
এবং তারপর… ? তারপর ভদ্রমহিলা যাই বলে থাকুন, তিনি আমার উপকারই করলেন। ঘুমটা পুরোপুরি কেটে গেল।