এ’বার Sucharitaর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর।
প্রশ্ন ছিল, – মনে হয় না ডাক্তার না হয়ে কেবল কবি হলে প্রথম জীবনেই যথেষ্ট কাব্যচর্চা করতে পারতেন?
উত্তরঃ– কেবল কবি হওয়া মানে শুধুই যথেষ্ট কাব্যচর্চা তো নয়! কবিতা লিখে জীবনধারণ তথা ক্ষুধা নিবারণও। না, তা মনে হয় না সম্ভব ছিল। ডাক্তার বা অন্য যে কোনও পেশাজীবী আমাকে হতেই হত।
এতক্ষণে হয় তো বোঝাতে পেরেছি, কবিতাকে ততখানি নিবিড় ভালোবাসা আমি দিইনি। অন্তত তখন তো দিতামই না। আমার থেকে বয়সে সামান্য মাসকয়েকের ছোটো এই বাংলার এক প্রধান কবি যে ভাবে কবিতার জন্য অনেক কিছু ছেড়েছেন, তাঁর সাহিত্য-পড়াশুনোর যা ব্যাপ্তি, কোনওটাই আমার মধ্যে ছিল না। প্রতিভার কথা বাদই দিলাম।
সেই সত্তরের দশকে সময় যে কম পেয়েছিলাম তা না। বস্তুত পরীক্ষা পিছিয়ে পিছিয়ে হাতে তখন সময়ই সময়। কী ভাবে কাটিয়েছি সেই সময়? কবিতার দিক দিয়ে ভাবলে নেহাতই অপচয়।
আমি কিন্তু অপচয় ভাবি না। না এখনও নয়। সেই সব মিছিলের দিন, হার্ডিঞ্জ হোস্টেলের সামনে বোমা, কলেজে নিত্য দিনের হাঙ্গামা তার স্বাদ আলাদা। সেও তো এক সঞ্চয়।
আমি কবিতার তন্নিষ্ঠ পাঠক হয়ে কবিতাকে মর্যাদা দিইনি। সাহিত্যকে ভালোবাসিনি। সেও আসেনি। শোধবোধ।
অথচ আমার প্রায় সমসাময়িক Arun Ain সেই সময়েই জামশেদপুর থেকে কৌরব নিয়ে কলকাতায় হানা দিচ্ছেন নিয়মিত। তাঁর লেখা গল্প উপন্যাস প্রতিষ্ঠিত পত্র পত্রিকায় কিশোর ভারতীতে নিয়মিত বেরুচ্ছে। আমার থেকে মাত্র তিন বছরের বড় অনীশ দেব। অনীশ দা’ তখন রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত লেখক। দেশ পত্রিকায় তাঁর কবিতা বেরোয়, বিভিন্ন জায়গায় গল্প উপন্যাস। লেখা পড়লেই বোঝা যায় কী বিপুল পড়াশুনো তাঁদের।
না, পল্লবগ্রাহী আমাকে সেই জগৎ মোটেই টানেনি। বরং কলেজ ক্যান্টিনে বা তার সামনের কদমগাছ তলায় বসে রণনীতি আর রণকৌশলের আঁচ পোয়ানো টানত অনেক বেশি। পড়বার পরিশ্রম নেই।
প্রসঙ্গত বলি, রাজনীতিও ঠিক ভাবে করতে হলে পড়াশুনো করতে হয় প্রচুর। আমি শুধুই আঁচ পোহাতাম। পড়তাম না। ছায়াচ্ছন্ন ঘরে অলোকদার পার্টি ক্লাসে একটা হেলান দেবার কোণা খুঁজে ঘুমিয়ে পড়তাম। ক্লাস শেষে আমাকে ডেকে তোলা হত – অ্যাই অরুণাচল, ওঠ্ রে। হোস্টেলে ফিরতে হবে।
আমি জানতাম লিখবার এলেম বা প্রতিভা যাই বলুন আমার নেই। লেখা যদি বা এক আধটা লিখে ফেলি, তা প্রকাশের কোনও তাড়া নেই মনের মধ্যে, কোথাও লেখা জমা দেবার ইচ্ছেই নেই।
নাকি ইচ্ছে কোথাও ছিল, সেই ইচ্ছেকে মাথায় পা দিয়ে চেপে দিত আমার ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স। ঈর্ষায় দগ্ধ হতাম হয়তো। জনান্তিকে বলি, হতাম নয় হই। আজও ঈর্ষাদগ্ধ হই। কেন ওরা যা লেখে তার ধারে কাছে যায় না আমার অকিঞ্চিৎকর শব্দ সাধনা?
তবে লিখতাম কিন্তু। অন্য অর্থে। মেডিক্যাল কলেজের ভেতরে বাইরে এমন কোনও দেওয়াল ছিল না যেখানে আমার লেখা (আমরা বলতাম ওয়ালিং) বা পোস্টার ছিল না। অবশ্য সেখানেও আমি নই, তারকা শিল্পী ছিল সোমেন দা’ আর অন্যরা। আমাকে হাতের লেখা আর দেওয়াল লিখন শিখিয়েছিল ওরা।
হায়, আজ মনে হয় দেওয়ালে লিখেছি বটে কিন্তু দেওয়াল লিখন পড়তে আমি পারিনি। উদ্বায়ী বয়স হাতের তালু থেকে উবে গেছে কখন! অজান্তেই।
কবিতার কথায় ফিরি। শুধু কবিতা না, অন্য লেখাও আমার কাছে ধরা দেয়নি। কবিতা বা অন্য কিছু লিখে সংসার প্রতিপালন, আমার মেধার সেই এলেমই ছিল না।
আর কতবার এই এক কথা আমাকে দিয়ে বলানো হবে?
এই বারে সেই ২০০৪ রহস্যের গিঁট খুলি। যদিও প্রশ্ন বহির্ভূত এই প্রসঙ্গ। ইতিহাসের উত্তরপত্রে এই রকমের অতিরিক্ত লিখতে হয় নম্বর বেশি তোলার জন্য।
সেই সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় রবিবাসরীয়তে মাঝে মাঝেই বিষয় বলে দিয়ে লেখা চাওয়া হত। সে বারের বিষয় ছিল নোয়ার নৌকোর রোমান্টিক জুটি। গদ্য বা পদ্য বলা ছিল না। আমার যা সম্বল, অন্ত্যমিল দিয়ে একটা লেখা পাঠালাম লালু রাবড়িকে নোয়ার নৌকোয় চাপিয়ে। সেই লেখাটা সম্পাদকের প্রশংসা পেল। যথারীতি হারিয়ে গেছে আমার সেই সৃষ্টি।
দু’টো লাইন শুধু মনে পড়ে
– পশু খাদ্যের রণবাদ্যের সেই ভরা দুর্দিনে
লালু কহিলেন, বুঝেছ উপেন, সিবিআই নেব কিনে!
যাই হোক, কেমন যেন আবছা হলেও বুঝলাম আমার লেখা একেবারে মূল্যহীন নয়। এ’রকম বেশ কয়েকবার। তখন ওঁরা মাঝে মধ্যে ক্রোড়পত্র বার করতেন ছোটো মাপের বইয়ের মত। এখন যে রকম প্রতিদিন তাদের রবিবার বার করে। সেই ক্রোড়পত্রের জন্যও কখনও কখনও লেখা নিতেন ওঁরা।
এই সব লেখার সুবাদেই আমার নবজন্ম হল। অনীশ দা’র হাতে।
খোলসা করে বলি। সেই এক বইমেলায়, পত্রভারতীর অনুষ্ঠান। পরিচালনা করছেন অনীশ দেব। আমার যৌবন বেলা থেকেই আমি ওঁর লেখা কল্পবিজ্ঞান আর রহস্যগল্পের ভক্ত। অনুষ্ঠান শেষে দেখা করলাম। আমার নাম শুনেই বললেন, – আপনিই সেই অরুণাচল? আপনার লেখা আমি পড়েছি।
২০০৬ সালে সপ্তম বামফ্রন্ট জেতার পর ওই আনন্দবাজারেই একটা উত্তর সম্পাদকীয়র সঙ্গে আমার একটা পদ্য ছাপা হয়েছিল। তার কয়েকটা লাইন উনি গড়গড় করে বলে গেলেন, যেন কোনও বিখ্যাত কবির লেখা সেটি। আশ্চর্য স্মৃতিমান সেই মানুষ।
সেই যে অনীশদা’র স্নেহ পেলাম এবং ধারাবাহিক ভাবে আমি হেন অলসকেও উৎসাহ দিয়ে যাওয়া! সত্যিই যেন পুনর্জন্ম ঘটল। তিনিই ঠেলে আমাকে দিয়ে লেখা পাঠানো করালেন বিভিন্ন লিটল ম্যাগে আর নবকল্লোল ইত্যাদিতে। ছাপাও হল। তারপর স্নেহ আর ভালোবাসা পেলাম কতজনের। কবি শঙ্কর চক্রবর্তী, শ্যামলকান্তি দাশ, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়। কত নাম আর বলি! আমার সঙ্গে অনীশ দা’র সুবাদেই আলাপ হল সৈকত আর সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী আর দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের। আমার অতি প্রিয় গদ্য লেখক এই চারজন। আলাপ হল ত্রিদিব-চুমকি-রূপার সঙ্গে। পরিচিত হলাম চন্দ্রিল ভট্টাচার্য, শোভন তরফদার, প্রচেত গুপ্ত, চন্দন নাথের সঙ্গে। সহৃদয় প্রকাশক রোহন আর চিরঞ্জিত এলো অভাবিত ভাবে।
অনীশ দেব আমার কী আর কতখানি ছিলেন, তা নিয়ে আলাদা করে লিখব একদিন। লিখবই।
ইতিমধ্যে বারাসতের বহুস্বর নামের সাহিত্যগোষ্ঠির সদস্য হয়েছি। কবি কমলেশ পালের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। নেহাতই একটা অপচয় করা জীবনে যা পাবার নয় তার অতিরিক্ত অনেক পেলাম।
এবং এখন আমি সেই মানুষটির মত জিজ্ঞেস করতেই পারি – বাহবা দিচ্ছ দাও, কিন্তু আগে বলো ঠেলে আমায় জলে ফেলেছ কে?
নিঃসন্দেহে তাঁর নাম অনীশ দেব!
এক এবং একমাত্র অনীশ দা’।