কর্মসূত্রে আমায় যেতে হয়েছিল ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তের একটি শহরের ক্ষুদ্র এক হাসপাতালের সুপারের দায়িত্ব নিয়ে।
প্রথম দিন অফিসে বসে সব সহকর্মীদের সাথে পরিচিত হলাম। প্রায় একশো শয্যার এই হাসপাতালে চিকিৎসকের বড়ই অভাব। জনা তিনেক স্থায়ী আর কয়েকজন অস্থায়ী চিকিৎসক নিয়ে কোনো মতে কাজ চলছে।
কাজ শুরু করার কিছুক্ষণ বাদেই একটি ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ দলবল নিয়ে উপস্থিত। ইউনিয়নের সম্পাদক মহোদয় আমার গলায় একটি গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে আমায় অভ্যর্থনা করলেন। তারপর কিঞ্চিৎ খেজুরে আলাপের পর বিদায় নিলেন।
অনতিকাল পরেই অন্য একটি ইউনিয়নের দলবলের প্রবেশ, আবার গাঁদার মালা ! আমি ক্ষুদ্র মানুষ । গাঁদার মালা গলায় পরে, মনে কেমন কু ডাক ডাকল। বলি দেওয়ার ছাগলকে গাঁদার মালা পরায় না? তদুপরি কানা ছেলেকে পদ্মলোচন বলা মাতৃহৃদয় স্নেহভরে আমায় যতই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলুক না কেন আমার গাত্র বর্ণ বলতে নেই, জুতো পালিশের ‘ বুট ব্ল্যাক ‘কে হার মানায়। আর বলির জন্যেতো ঘন কৃষ্ণবর্ণ ছাগলই উৎকৃষ্ট। মনের মধ্যে কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তা নিয়েই কয়েক দিন কাটলো।
এক সপ্তাহের মধ্যেই আমার আশংকা সত্যি হয়ে উঠলো। সব জায়গার মতোই এইখানেও এক একটি ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের সাথে ডিভিশনের সমস্ত আধিকারিকদের নিয়মিত বৈঠক হয়। যেখানে ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ তাঁদের অভাব অভিযোগ ব্যক্ত করেন। ডিভিশনের প্রবন্ধক, সংশ্লিষ্ট আধিকারিককে সেগুলির কারণ দর্শাতে বলেন এবং যথা সম্ভব সেগুলি সমাধানের চেষ্টা করেন। তো আমার কাজে যোগ দেওয়ার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এই রকম একটি বৈঠক ছিলো। চিকিৎসাবিভাগের পক্ষ থেকে সমস্ত অভাব অভিযোগের জবাবদিহির দায়িত্ব এই অধমের উপর বর্তালো। ক্রমানুসারে আমার জবাব দেওয়ার পালা এলে ওই ইউনিয়নের সম্পাদক মহোদয় আমায় প্রায় তুলোধোনা করলেন। হাসপাতালের প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই, হাসপাতালের যত কিছু অভাব অভিযোগ, চিকিৎসকের অপ্রতুলতা, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, কর্মচারীদের সুষ্ঠু কাজের পরিবেশহীনতা এই সমস্ত কিছুর জন্যে যে একমাত্র আমিই দায়ী এবং এগুলির কোনো সমাধান না করে সরকারের কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা টাকার বেতন গ্রহণ করছি এবং খোদার খাসির মতো এই ধরাধামে বিচরণ করছি, এইসব অতি উদাত্ত কণ্ঠে প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন। বক্তৃতা শুনে আমার চোখে প্রায় জল এসে গেল। নিজের কৃতিত্বে নিজেই চমকিত হলাম। দিন পনেরো আগেও আমি ভারতবর্ষের পূর্ব প্রান্তে কর্মরত ছিলাম, আমার হাত যে এতখানি সুদূরপ্রসারী হতে পারে, স্বীয় ক্ষমতা সম্পর্কে এতখানি অনুভব নিতান্তই আমার অগোচরে ছিল।
সেই শুরু হলো, তার পর থেকে প্রতিনিয়ত ওই ভদ্রলোক পদে পদে আমায় লাঞ্ছনা এবং হেনস্থার কারণ হয়ে দাঁড়ালেন। আমার হাসপাতালে তাঁর দলভুক্ত কোনো কর্মচারীকে কোন কাজের দায়িত্ব দিলেই তাঁর সপার্ষদ আবির্ভাব ঘটতো এবং চীৎকার, চেঁচামেচি, ফাইল ছোঁড়া ইত্যাদি প্রায় নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়াল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে তিনি আমায় আরো ধৈর্যশীল হওয়ার পরামর্শ দিতেন। আমিও নিত্যদিন ধৈর্যের পরীক্ষা দিতাম।
মাস দুই বাদে একদিন দুপুরে ঘরে খেতে গেছি, দূরভাষে খবর এলো ওই ভদ্রলোকের স্ত্রীর পদস্খলন ঘটেছে এবং হাতে আঘাত লেগেছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছলাম। গিয়ে দেখি ভদ্রমহিলার দুটি হাতই কব্জির কাছে আক্ষরিক অর্থেই ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। এই ধরনের রোগীকে সাধারণত সাতশো কি.মি দূরে মুম্বাই এর বড়ো হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হয়। তার উপরে নেতা মহোদয়ের ধর্মপত্নী ! কার ঘাড়ে কটা মাথা, যে এই ঝুঁকি মাথায় নেবে! কিন্তু নিজের ওপর এক অসহায় আক্রোশে সিদ্ধান্ত নিলাম এই হাসপাতালেই যা করার করবো। দ্রুত সেই কাজই করলাম , যথোপযুক্ত চিকিৎসা ভালোয় ভালোয় মিটলো। ভদ্রলোকের ধর্মপত্নীর হাত সম্পূর্ণ ঠিকঠাক হয়ে গেলে মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশা হলো এই বার হয়তো উনি আমায় কিঞ্চিৎ রেহাই দেবেন।
কিন্তু ধন্য আশা কুহকিনী! আমার উপর লাঞ্ছনা ও হেনস্থা, উনি আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোকের এক কথার মতো , সেবা নিবৃত্তির শেষ দিন অবধি এই কাজে উনি সতত সঞ্চারমান ছিলেন।
আমি এই ভেবে সান্ত্বনা পেতাম যে বীরসিংহের বাড়ববহ্ণিমান মানুষটি যদি আজীবন কৃতঘ্নের অত্যাচার সইতে পারেন, তাহলে আমার মতো অতি নগন্য মানুষের কোন খেদ থাকাই উচিৎ নয়।
এই হাসপাতালে প্রতিটি কর্মচারী কোন না কোন ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন এবং এঁদের মধ্যে খেয়োখেয়ি লেগেই থাকতো। ‘ আমরা একই হাসপাতালের কর্মী ‘ এই ধরনের কোন একাত্মতাবোধ এঁদের ছিলো না। আমি যদি কোনো ভাবে এই বোধ সামান্য হলেও সঞ্চারিত করতে পারি এই আশায়, প্রতি রবিবার হাসপাতাল সাফাই অভিযান শুরু করলাম।
আমার হাসপাতাল ভেতরে পরিচ্ছন্ন থাকলেও বাইরের বিশাল চত্বর বেশ অপরিষ্কারই ছিলো। প্রতি রবিবার সকালে, সকলে মিলে ওই চত্বরটি পরিষ্কার করার কাজে লাগলাম। কয়েক ঘন্টা ধরে এই কাজ করে সবাই মিলে চা আর জিলিপি খেয়ে ক্ষান্তি দিতাম। সবচেয়ে নোংরা জায়গাটা আমি নিজে হাতে পরিষ্কার করতাম যাতে সকলেই হাত লাগায়। প্রথম প্রথম এই সাফাই অভিযান দারুণ সাড়া ফেললো। সব বিভাগের কর্মীরাই এতে অংশ নিলো। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরে আস্তে আস্তে হারাধনের দশটি ছেলের মতো আমার লোকবল কমতে লাগলো। একজন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার শেষ দিন অবধি আমার সাথে ছিলেন, তিনিই জানালেন দুই ইউনিয়নেরই নেতৃবৃন্দ, সবাইকে বারণ করে দিয়েছেন, এই কাজে অংশ নিতে। কারণ এই কাজ সাফাই কর্মীদের, সকলের করা উচিৎ নয় আর আমার মাথা সম্পূর্ণ খারাপ তাই এই সব অকাজ কুকাজ সবাইকে দিয়ে করাই। নিজের এই বিশেষ পরিচয়ে যারপরনাই আল্হাদিত হলাম।
আমার অফিসের সামনে লোহার গ্রীল লাগানো দুটি বেশ বড়ো জায়গা ছিলো। পুরোপুরি ধুলো ভরা। সবুজের একটি কণাও তার মধ্যে ছিলো না। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও আমার কর্মীদের সাহায্যে ওই জায়গাদুটিতে রোজ জল দেওয়া চালু করলাম। ইচ্ছে ছিলো মাটি একটু নরম হলে ওখানে কিছু গাছ লাগানো যাবে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, কিছুদিনের মধ্যেই ওই জায়গাগুলি সবুজ ঘাসে ভরে গেলো। ইতিমধ্যে বর্ষা এসেছে, অনেক খোঁজ করে জানলাম শহরের অনতিদূরে বনবিভাগের একটি বিশাল বাগান আছে, যেখান থেকে কিছু চারাগাছ পাওয়া যেতে পারে।
আমাদের একটি সিকি শতাব্দী প্রাচীন বড়ো অ্যাম্বুলেন্স ছিলো, এক শুক্রবার দুপুরে একজন সহকর্মী চিকিৎসক ও দুই সহকারীকে নিয়ে ওতে করে পাড়ি জমালাম। বনবিভাগের ওই অফিসের ভারপ্রাপ্ত এক ভদ্রমহিলা, তাঁকে হাসপাতালে লাগানোর জন্য কিছু চারা গাছ প্রয়োজন বলায় উনি সানন্দে রাজী হলেন এবং আমায় গোলাপ, নয়নতারা, টেকোমা, দেবদারু, বকুল, বাগানবিলাস, ইত্যাদি চারার সংখ্যা নির্দিষ্ট করে একটি তালিকা আমার হাতে দিলেন। চারাগুলি ছিল প্রায় ফুট চারেক মতো উঁচু একটি মাটির বাঁধের পাশের নীচু জমিতে গ্রো ব্যাগের মধ্যে লাগানো। তালিকা মিলিয়ে বারংবার বাঁধ ডিঙিয়ে ওই নীচু জমিতে নেমে নিজের হাতে চারাগাছগুলি তুলে এনে গাড়িতে ভর্তি করতে লাগলাম। ইতিমধ্যে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে, ওই বৃষ্টির মধ্যে বারংবার ওঠানামায় বেশ কষ্টই হচ্ছিল। কিন্তু উপায় কি। আমার সহকর্মীরা গাড়ির ভেতরেই ছিলেন। সম্পূর্ণ সিক্ত অবস্থায় প্রায় সত্তর আশিটি চারাগাছ সংগ্রহ করে হাসপাতালে ফিরে ওগুলিকে সেই লোহার বেড়া দেওয়া জায়গায় রাখা হল। আমি পোশাক পাল্টে অফিসে ঢুকে গেলাম।
পরদিন সকালে কিছু রোগী দেখছিলাম, হঠাৎ আমার সঙ্গে গতকাল যাওয়া সহকর্মী চিকিৎসক এসে জানালেন, আমার আনা গাছগুলি প্রায় সবই চুরি হয়ে গেছে। এই কাজ আমার সহকর্মীদেরই ! আমি সিঁড়ি বেয়ে ওই জায়গাটিতে নেমে এলাম। গেটে তালা লাগানো রয়েছে। আমার সহকর্মীরা সকলেই জানেন যে ওই গাছগুলি আমি বৃষ্টির মধ্যে যথেষ্ট পরিশ্রম করে নিজের হাতে তুলে এনেছি। তবুও এই চক্ষুদান করতে তাদের একটুও বাধেনি।
আবার ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো। মাটিতে ইতস্তত পড়ে থাকা অল্প কয়েকটি চারাগাছের দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে অঝোরে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির ধারা স্নানে দুচোখ বেয়ে নামা জল একাকার হয়ে গেল। দমকা লোনা হাওয়ায় মিশে গেল আমার দীর্ঘশ্বাস।
‘আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো’।
হুমমমমমমম। অবিমৃষ্য…. কী একটা কথা আছে না? ইয়ে মানে মুখে আসছে পেটে আসছে না। এটাও ঐ রকম কান্ড।
পরমকল্যাণবরেষু ? আম্মো বেভ্যুল হয়ে যাচ্ছি। অনেক ধন্যবাদ, খুব ভালো থাকবেন।
পরমকল্যাণবরেষু ? আম্মো ভুলে মেরেছি। খুব ভালো থাকবেন।
পথে পাথর ছড়ানো তো থাকবেই।সেই পাথরের ফাঁকে ফাঁকে ফুটে থাকা ফুলগুলো নিশ্চয়ই তোমার সংবেদনশীল মন চিনেছে এবং তুলেছে।ভালো লোক এখনো পৃথিবীতে আছে এটা তুমি আমার থেকে বেশিই জানো।
কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার অনুভব প্রকাশের মাধ্যম যে শব্দচিত্র তা সত্যিই ব্যতিক্রমী, যমন ব্যতিক্রমী আপনার মতো মানুষ-ডাক্তার। যে বিশেষ পরজীবীকুল আপনাকে মোটামুটি শ্রেণীশত্রু বানিয়ে তুলেছিল, সেটাও তো সমাজে দীর্ঘলালিত চিন্তারই ফসল।
অনেক ধন্যবাদ খুব ভালো থাকবেন।
অনেক ধন্যবাদ, খুব ভালো থাকবেন।
এ এক অনন্য চিত্রন! অনবদ্য লেখা। শুধু স্বাদু নয়, পরতে পরতে মানুষের স্তরায়িত চরিত্রের উন্মোচন।
কুর্ণিশ!
Thank you so much.
আপনার উন্নয়নশীল কাজের চিন্তা আমার আনন্দের কারণ। আপনি হারার বা জেতার জন্যে এই কাজগুলো করেননি। পরিবেশের দৈন্যদশা সংস্কারের চেষ্টা করেছেন। অনেক ধন্যবাদ। আরও আরও লিখুন।
আপনার উন্নয়নশীল কাজের চিন্তা আমার আনন্দের কারণ। আপনি হারার বা জেতার জন্যে এই কাজগুলো করেননি। পরিবেশের দৈন্যদশা সংস্কারের চেষ্টা করেছেন। অনেক ধন্যবাদ। আরও আরও লিখুন।
kichu samay kichu strict action nile kaj bhalo hoi. Union er naam e ei mastani aaj union gulor baje abosthar karon. Ki audacity. Galpo ti hotath jeno sesh hoye gelo. Choto galpo bhalo kintu ati choto galpo aro ekto baro hote chai……Satti galper gatisilata chamotkar.
Thank you so much.
এতো সঠিক ও সুন্দর ভাবে লিখলেন। এই সব নিম্নমেধা কুপমুণ্ডুক ইউনিয়নের নেতা সমগ্র ভারতীয় রেলওয়ে তে ছেয়ে আছে। পদে পদে ওরা আমাদের অন্য শ্রেনীর মানুষ হিসেবে হেনস্থা করার জন্য প্রস্তুত থাকে। আর হাস্পাতালের কর্মী রা তো প্যরাসাইট।