আমরা যারা বেড়াতে টেড়াতে যাইনা, দশ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে জীবন কাটাই, প্রকৃতি তাদের নিয়ে হেব্বি বিব্রত। হয়তো আমাদের চমক দেওয়ার জন্যই প্রকৃতি মাঝে মাঝে ভোল বদলায়।
আজ যেমন সকাল সাড়ে ছটায় স্কুটার বের করে পিলে চমকে গেল। চারিদিকে ভয়ানক কুয়াশা। মনে হচ্ছে গায়ের উপর দিয়ে মেঘ ভেসে যাচ্ছে। বছর তেরো আগে একবার মেঘালয় গিয়েছিলাম। মাস দেড়েক ছিলাম। বেড়ানোর জন্য নয়। এক হেলথ্ সার্ভের কাজে। সেখানেই এরকম ঘন কুয়াশা দেখতাম।
এমনিতেই মাস্ক পরলে চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে যায়। কুয়াশা হলো গোদের ওপর বিষফোঁড়া। ফাঁকা ওভারব্রিজে যখন স্কুটার নিয়ে উঠলাম আমার গতিবেগ ঘন্টায় কুড়ি।
যে দু’চারটে গাড়ি যাচ্ছে তাদের হেড লাইট জ্বলছে। ঘনঘন হর্ন দিচ্ছে। সমস্যা সাইকেল নিয়ে। বেচারাদের হেডলাইট নেই, জোরদার হর্নও নেই।
তবু সাইকেল রাস্তার এক ধারে থাকে। সাবধানে যায়। কিছু প্রকৃতি প্রেমিক ফটোগ্রাফার সাইকেলের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক।
এমনই এক ছোকরা ফ্লাইওভারের ঠিক মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে কুয়াশা ঢাকা মধ্যমগ্রাম স্টেশনের ছবি তোলার চেষ্টা করছিল। শেষ মুহূর্তে ব্রেক চাপলাম। আমার বাহন ছোকরাটিকে মৃদু আদর করে দাঁড়িয়ে গেল।
বললাম, ‘এভাবে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানে?’
ছেলেটি প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘ফটোগ্রাফি করতে হলে রিস্ক নিতেই হয়। যারা ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করেন, তাঁরা বাঘ-সিংহের প্রায় মুখের সামনে গিয়ে ছবি তোলেন।’
বাঘ-সিংহের দুঃখে সমব্যথী হওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। তাই চশমার কাঁচ সোয়েটারের মুছে আবার স্কুটারে স্টার্ট দিলাম।
গৌড়ের চেম্বারে যখন পৌঁছালাম হেলমেট থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। এই কুয়াশার সাত সকালেও দু’চার জন রোগী এসেছেন।
চেম্বারে উল্টোদিকে সৌমেনের মুরগির দোকান। মুখোমুখি দুটো খুপরিতে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কাজ চলে। একটাতে মানুষের আয়ু বাড়ানোর চেষ্টা চলে, অন্যটাতে অবাধে হত্যালীলা।
মুরগিদের অন্তিম আর্তনাদ শুনতে শুনতে রোগী দেখি। লকডাউনের একদম গোড়ার দিকে- একদিন রোগী দেখা শেষ করে ব্যাগ গোছাচ্ছি, সৌমেন দুটো মুরগি এনে টেবিলে ছেড়ে দিল। বলল, ‘ডাক্তারবাবু, নিয়ে যাবেন।’
মুরগি দুটো প্রাণপণে ডানা ঝাপটাচ্ছে। তাদের পা একসাথে বাঁধা বলে পালাতে পারছে না। বললাম, ‘না না। মুরগি নেওয়া যাবে না।’
‘না নিলে দুঃখ পাব। আপনিও তো আমাদের বাড়ির সবাইকে দেখেন। ভিজিট নেন না। আমি আপনার স্কুটারের পেছনে কায়দা করে ঝুলিয়ে দিচ্ছি।’
বললাম, ‘দুটো জ্যন্ত মুরগি নিয়ে গেলে মুরগি তো দূরের কথা, আমাকেই বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।’
‘ডাক্তারবাবু, লোকে করোনার ভয়ে মুরগি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। রটে গেছে মুরগি থেকে করোনা ছড়াচ্ছে। একশো টাকায় বিক্রি করছি, তাতেও খরিদ্দার নেই। আপনি স্কুটারে ঝুলিয়ে নিয়ে গেলে লোকজন দেখত। মুরগি খাওয়ার সাহস পেত।’
এরকম পরিস্থিতিতে আগেও পড়েছি। এক মিস্টির দোকানে বাসী মিস্টি টেস্ট করেছিলাম। সে গল্প শোনানো হয়ে গেছে।
কুয়াশার মধ্যে রোগী পত্তর কম। যারা এসেছেন সকলের এমার্জেন্সি। একটি সাতেরো আঠারো বছরের ছেলের পেটে ব্যথা প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে। মাঝে মাঝে বমি হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোনো ওষুধ পত্র খেয়েছিস?’
‘হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, ইলেকট্রিক খেয়েছি।’
‘ইলেকট্রিক খেয়েছিস মানে?’ আমি চমকিত হই।
‘ওই যে প্যাকেটে থাকে। জলে গুলে খায়।’
‘ওটা তো ইলেক্ট্রলের পাউডার। পরীক্ষা নীরিক্ষা কিছু হয়েছে নাকি?’
‘হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, মাধ্যমিক- উচ্চমাধ্যমিক সব হয়ে গেছে।’
এতক্ষণে কুয়াশার সকাল জম জমাটি হয়ে উঠল। এমন রোগীদের ছেড়ে কোথাও গিয়ে সুখ নেই।