চল তোমাদের একটা গল্প বলি। জ্যোতি বসুর গল্প , না না তোমরা যা ভাবছ তা নয়। ইনি বিখ্যাত কেউকেটা নন অতি সাধারণ এক বাঙালি। আমার সঙ্গে আলাপ রুবি হাসপাতালের বেডে আজ থেকে বছর সাতেক আগে। ভর্তি হয়েছিলেন trochanteric fracture নিয়ে। বয়স ৭৯ বছর, এই বয়সে যেমন হয় রক্তে চাপ, চিনি সবই বেশি তার ওপর হিসির সমস্যা, রক্তে নোংরা জমেছে। তবু সব ঠিক করে দিন তিনেক পরে হাড়ে গুঁজে দিলাম একটা রড। ভালো মন্দয় মিলিয়ে কাটলো দিন তিনেক, যন্ত্র দিয়ে একবার রক্তের ময়লাও পরিষ্কার করা হল। পাঁচ দিন পর বাড়ি গেলেন দিব্যি। আমার মত দূর্মুখ ও বদমেজাজি ডাক্তারকেও ভালোই বললেন, ছেলের কাছে শুনলাম বলেছেন “ওষুধ যত তিতা তত ভালো কাজ”।
বাড়ীতে চলল ব্যায়াম, ওষুধ । একমাসের মাথায় Walker নিয়ে হেঁটে এলেন চেম্বারে, হাড় ভালোই জুড়ছে। অনেক কথা বললেন, বেশ অবাক করল ভাবনার গভীরতা। এরপর বেশ কয়েকবার এলেন হাড় জোড়া অবধি, তৈরি হল এক অসমবয়সী সখ্যতা। ওনার সুপারিশে দেখিয়ে গেলেন ছেলে, বউমা, নাতি, ছেলের ভায়রা ভাই আরো অনেকে।
বছর খানেক পরে এলেন। গট গট করে এসে জানালেন ইদানিং কিডনি একদমই জবাব দিয়েছে, সপ্তায় তিন দিন dialysis, তবু ভালো আছেন, নাতি ডাক্তারি পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, ঢুকে গেলেই শান্তি তার পর নিশ্চিন্তে চোখ বুঝবেন। আমিও ভাবলাম dialysis dependant CKD আর ক’ দিন ৮১ বছর তো হয়েই গেল। কয়েক মাস পর জানলাম নাতি KPC Medical College-এ পড়ছে । পরের বছর আবার এলেন, তারপর প্রতি বছর এভাবে পাঁচ বছর, শেষবার গত বছর। শরীর ভাঙ্গছে কিন্তু জীবন চলছে যন্ত্রের কল্যাণে। প্রতিবার আসতেন আর বলতেন উদ্দেশ্যহীন যন্ত্রণাময় পরমুখাপেক্ষী জীবনের দূঃখ আর হতাশার কথা।
আজ এসেছিলেন ওনার এক আত্মীয়। দেখানোর পর বললেন একটা খারাপ খবর দিই আপনাকে, জ্যোতিবাবু এক মাস আগে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। হঠাৎ চমকে উঠলাম। ৮৬ বছরের মানুষটা, কতটা হতাশা থেকে এই চরম পথ বেছে নিয়েছেন ভাবতে গিয়ে সব কেমন গুলিয়ে গেল।
আমাদের বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে এই উদ্দেশ্যহীন, লক্ষ্যহীন, অর্থহীন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর এই জীবন কি কাঙ্খিত? পরিপূর্ণ জীবনের প্রাকৃতিক সমাপ্তি কি জীবনেরই উদযাপন নয়। আমরা কি ভালো করছি, না কি খারাপ। কানে বাজছে ওনার শেষ কথা গুলো …বলতে পারো ডাক্তার আমাকে কেন বেঁচে থাকতে হবে? উত্তরটা সত্যি আমাদের জানা নেই।
হ্যাঁ।এটা আমারও প্রশ্ন।আমরা কোথায় গিয়ে থামবো, সেটা আমাদের ঠিক করতে হবে।মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে, আমরা রোগীর জীবনটাকে মৃত্যুপুরি করে তুলি।